লেখকঃ মোহাম্মদ নাইমুর রহমান
মানুষ সর্বোচ্চ কতটুকু লম্বা হতে পারে? ৮ফুট? ১২ফুট? ৬০ফুট নাকি ৯০? সাহিত্য, লোককাহিনী কিংবা মিথলজিতে দৈত্যাকার মানুষের অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় কিন্তু বৈজ্ঞানিক দিক থেকে চিন্তা করলে তা কতটুক বাস্তব? আর অত্যাধিক উচ্চতা কি আমাদের জন্য লাভজনক নাকি ক্ষতি?
জোনাথন সুইফটের গালিভার এর কথা শোনেনি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে বর্তমানে। সেখানে প্রথম কাহিনী তে গালিভার নিজেই ছিল জায়ান্ট। কিন্তু ২য় খন্ডে Brobdingnag দ্বীপে গালিভার তার নিজের চাইতে ১২ গুন লম্বা (প্রায় ৭২ ফুট উচ্চতা) মানুষ দেখতে পায়। কিন্তু এ তো ফিকশনাল কাহিনী। ধর্মীয় ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দৈত্যাকার মানুষ বলতে বাইবেল এ উল্লেখিত গলিয়াথ (৬ফুট ৯ইঞ্চি মতান্তরে ৯ফুট ৯ইঞ্চি) এবং অ্যাডাম এবং ইভ (৬০ফুট, মতান্তরে ৯০ফুট!!) কিন্তু এর ও কোনো ফিজিক্যাল এভিডেন্স নেই।
বাস্তবে এযাবৎ কালের সবচাইতে লম্বা মানুষ ছিলেন Robert wadlow (৮ফুট ১১ইঞ্চি) এবং বর্তমানে জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতার অধিকারী টার্কিশ সুলতান কোসেন (৮ফুট ৩ইঞ্চি)। কিন্তু এদের কারো উচ্চতা স্বাভাবিক ছিলনা, এরা উভয়েই পিটুইটারি গ্ল্যান্ড এর টিউমার এর কারণে এই অস্বাভাবিক উচ্চতার অধিকারী হন যা gigantism নামে পরিচিত। সহজভাবে জীবনযাপনের জন্য স্বাভাবিক সর্বোচ্চ উচ্চতার কোনো সীমারেখা টানা একটু কঠিন, তবে মোটামুটি ভাবে বলতে গেলে গড়ে ৭ফুট বা তার আশপাশে। এর বেশি উচ্চতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই (কিছু ব্যতিক্রম বাদে) অস্বাভাবিক কিছু ইঙ্গিত করে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে অন্তরায়। কেন? সেটা ব্যাখ্যা করার আগে আরেকটু তথ্য দেই। গত ১০০ বছরে মানুষের গড় উচ্চতা বেড়েছে প্রায় ৪সে.মি. এবং আমরা আমাদের উচ্চতার জেনেটিক লিমিটেশনের প্রায় চূড়ান্ত অবস্থায় আছি। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে হয়তো আর কিছু উচ্চতা বাড়ানো সম্ভব তবে এইটুকুই, এর চাইতে বেশি উচ্চতা বায়োলজিক্যালি এবং জেনেটিকালি অসম্ভব। কেন অসম্ভব এবারে আসি তার ব্যাখ্যায়।
## (১) ভারবহন ও চলাফেরা
Square-cube law অনুসারে কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য যতগুন বৃদ্ধি পাবে, তার পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি পাবে দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির বর্গের সমানুপাতে এবং আয়তন বাড়বে ঘনের সমানুপাতে। মানে হলো যদি কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য ২গুন হয় তবে তার surface area বাড়বে ৪গুন, আর আয়তন ও ওজন বাড়বে ৮গুন।
এখন যদি মানুষের উচ্চতা ৬০ফুট হয়, মানে ১০গুন বৃদ্ধি পায় তবে surface area বাড়বে ১০০গুন আর আয়তন ও ওজন বাড়বে ১০০০গুন। অর্থাৎ ভার বহনকারী হাড়গুলোর আগের তুলনায় ১০ গুন বেশি ওজন বহন করতে হবে। তাত্ত্বিক ভাবে এটা অসম্ভব না হলেও, কোনো রকম হাঁটাচলা করতে গেলেই হলো, হার ভাঙ্গা শুরু হবে। আর বাস্তবের কথা বললে ইতিহাসে যার ই ৮ফুটের বেশি উচ্চতা ছিল সবারই সহজেই হার ভাঙার সমস্যা ছিল। Robert wadlow কিংবা Sultan kosen এর মত ব্যাক্তিদের তাই সাপোর্ট হিসেবে আলাদা ভাবে knee brace কিংবা ছড়ি ব্যাবহার করতে হতো। ৮ ফুটেই এই অবস্থা তো ৬০ ফুট হলে কি হবে?
অনেকের মনে তার পরেও প্রশ্ন জাগতে পারে উচ্চতা বাড়বে সাথে পাশেও বাড়বে তো সমস্যা কি? তাদের জন্য বলি, square cube law আরেও বিস্তারিত পড়েন। যেই হারে পাশে বাড়বে ওজন তার চাইতে বেশি বাড়বে একই উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য। এই অতিরিক্ত উচ্চতা সামাল দিতে হয় হাড়ের গঠন পাল্টাতে হবে, নতুবা এতটাই পুরুত্ব বাড়াতে হবে যে মানুষের পায়ের স্বাভাবিক আকার ই আর থাকবে না। ও হ্যা, আর দুই পায়ে হাঁটার চিন্তা বাদ দিয়ে চার হাত পায়ে হাঁটতে হবে সাথে লাফালাফি ও বাদ। এত কিছুর পরেও আপনার গতি হবে খুবই ধীর (হাতি র কথা চিন্তা করেন)। বাতাসে প্লবতার মান কম হওয়া তে নিজের ভরে নিজেই পড়ে যাই, এমন একটা অবস্থা হবে। সেক্ষেত্রে ভারী প্রাণীদের জন্য খোলা জলাশয় better choice (যেমন নীল তিমি)
## শ্বাস - প্রশ্বাস ও রক্ত চলাচল:
সেই একই square cube law, যে অনুপাতে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে সে অনুপাতে ফুসফুসের কার্যকরী ক্ষেত্রফল কিন্তু কম। তাই হয় ফুসফুসের ফিজিওলজিক্যাল পরিবর্তন আনতে হবে কিংবা শরীর অনুপাতে বিশাল বিশাল ২টা ফুসফুস লাগবে। একেই কথা খাটে হৃদপিন্ডের জন্য। সারাদেহে রক্ত পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত চাপ তৈরি করতে হিমশিম খেতে হবে হৃদপিন্ডের। বিশেষ করে মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছানোর জন্য বেশি ঝামেলা হবে। অতিকায় বৃহৎ গলার অধিকারী ডাইনোসর একারণেই বেশিক্ষণ মাথা সোজা করে রাখতে পারতো না যাতে করে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল ঠিক থাকে। শুধু তাই নয়, এই অতিরিক্ত রক্তচাপ সইবার জন্য রক্তনালীতে ও আনতে হবে পরিবর্তন।
ঝামেলা আরো আছে, আমাদের পা থেকে রক্ত পুনরায় হৃদপিণ্ডে পৌঁছানোর জন্য পায়ের মাংপেশির সংকোচন প্রসারণ (সোজা কথায় নড়াচড়া) হওয়া দরকার। নতুবা অতিরিক্ত রক্ত পায়ের মাংসপেশিতে জমা হয়ে থাকবে। (এ কারণেই দীর্ঘক্ষণ দাড়িয়ে থাকলে অস্বস্থি হয় এবং পা নাড়াতে ইচ্ছে হয়) কিন্তু অতিরিক্ত ওজনের কারণে আপনার তখন নড়াচড়াই প্রায় বন্ধ, ফলে রক্ত ঠিকভাবে পা থেকে হৃদপিণ্ডে পৌঁছাবে না।
## স্নায়বিক সমস্যা:
আমাদের নিউরণের মধ্যে দিয়ে বৈদ্যুতিক সংকেত একটি নির্দিষ্ট গতিতে আদান প্রদান হয়। (ক্ষেত্র বিশেষে কয়েক সে.মি./সেকেন্ড থেকে কয়েক মিটার/সে.) বিশাল আকারের দেহের জন্য তাই স্নায়ু উদ্দীপনা অনেক ধীরে বাহিত হবে। ফলে বিভিন্ন স্নায়ু সংবেদ পেতে স্বাভাবিকের চাইতে অতিরিক্ত সময় লাগবে। শুধু তাই নয়, স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা করতেও অতিরিক্ত সময় লাগবে।
পা থেকে অনুভূতি কম পাওয়াতে পায়ে আঘাত পাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে আর পায়ে অস্বাভাবিক রক্ত চলাচল, এই দুইয়ে মিলে পায়ে বিভিন্ন ইনফেকশন ও অন্যান্য সমস্যা বেড়ে যাবে। (Gigantism এ ভুক্তভুগী মানুষের অন্যতম একটা কমন সমস্যা হলো এই পায়ের আঘাত ও ইনফেকশন)
মানব দেহের বিভিন্ন তন্ত্রে আরো বিভিন্ন রকম প্রভাব পড়বে কিন্তু এত গভীর আলোচনায় আর যেতে চাই না। বিভিন্ন সাইন্টিফিক কঠিন ভাষা পরিহার করে সহজ ভেবে সংক্ষেপিত এই আলোচনার মূল কথা হলো ফিজিওলজিক্যালি মানুষের অতি উচ্চতা অসম্ভব এবং সম্ভব হলেও টা মোটেও সুবিধাজনক কিছু হতো না। (আমরা যেমন আছি তেমন টাই পারফেক্ট) ৬০ফুট মানুষের বিভিন্ন অঙ্গের এত বেশি পরিবর্তন হতে হবে যে সেটা আর মানুষ থাকবে না, অন্য কোনো প্রজাতিতে পরিণত হবে। দৈত্যাকার মানুষ সম্পর্কে যত ধারণা প্রচলিত আছে তার সবই আপাতত conspiracy theory এর মধ্যে পড়ে। ইন্টারনেটে যেসব giant human ফসিল আবিষ্কারের নিউজ পাওয়া যায় তার প্রায় সবই হয় কোনো conspiracy theory তে বিশ্বাসী ওয়েবসাইট থেকে প্রচারিত নয়তো দেখা যায় ৭-৮ফুট ফসিল কেই clickbait হেডলাইন বানানোর জন্য "giant" উপাধি দেওয়া।
কিছু সহায়ক ইউটিউব ভিডিও লিংক:
- https://youtu.be/DkzQxw16G9w
-https://youtu.be/aYL7rAwsaQI
- https://youtu.be/h_ZDlJ61erY
-https://youtu.be/20Fq2huhvEI
-https://youtu.be/q0XgD2RY2Pc
ডাইনোসর কিভাবে এত বড় হলো?
-https://dinosaurtheory.com/big_dinosaur.html
Square cube law:
-https://en.wikipedia.org/wiki/Square%E2%80%93cube_law?wprov=sfla1
-https://dinosaurtheory.com/scaling.html
Other links:
-https://www.scienceworld.ca/stories/what-if-humans-were-giants/
-https://en.wikipedia.org/wiki/Allometry?wprov=sfla1
মোহাম্মদ নাইমুর রহমান,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।