লেখকঃ রওনক শাহরিয়ার
টাচ স্ক্রিনের ইতিহাসটা বেশ পুরোনো। ১৯৬৫ সালে ইংল্যান্ডে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এর জন্য প্রথম টাচ স্ক্রিন তৈরী করা হয়। এবং ১৯৭৫ সালে প্রথম কম্পিউটারে টাচ স্ক্রিন তৈরী করা হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো এটা তখনও সহজলভ্য এবং মানুষের ব্যবহার উপযোগী না হওয়ায় সেই বাজার কি-বোর্ড ও মাউস দখল করে নেই। আগের দশকে ডিভাইসসমুহের এক রেভ্যুলেশন ঘটে, যেখানে টাচ স্ক্রিনের ব্যবহারের বিষয়টা নতুনভাবে ওঠে আসে। বর্তমানের প্রায় সকল স্মার্টফোন, ইবুক রিডার, কিছু এমপি থ্রী প্লেয়ার এই দিকে কাজ করে যাচ্ছে, সাথে কিছু ল্যাপটপেও এই পদ্ধতি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
তবে প্রশ্ন আসে টাচ স্ক্রিন ব্যবহার আসলে কতটা সহজ এবং এটা কীভাবে কাজ করে?
টাচস্ক্রিন ও কি-বোর্ড!
একটি টাচস্ক্রিনকে একটি অদৃশ্য কি-বোর্ড এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এটা কীভাবে কাজ করে তা জানার জন্য আগে সাধারণ কি-বোর্ড কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার।
কি-বোর্ড এর প্রতিটা কি হলো একটি ইলেক্ট্রনিক সুইচ। যখনই এটা প্রেস করা হয় তখন একটি ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। বিদ্যুতের প্রবাহ নির্ভর করে কোন কি -তে প্রেস করা হচ্ছে এবং এভাবে কম্পিউটার বুঝে নেই যে কী লিখা হচ্ছে।
একটু বিস্তারিত বললে বিষয়টা এমন যে, একটি কি-বোর্ড এর মধ্যে বিদ্যুৎ পরিচালনে সক্ষম দুটি প্লাস্টিক স্তর থাকে, যা একটি অন্তরক প্লাস্টিক দ্বারা বিভক্ত থাকে এবং অন্তরক প্লাস্টিকের মধ্যে একটি ফুটো থাকে। এখন কি-বোর্ডের প্রতিটা কি -তে এমন ফুটো থাকে। যখন একটি কি প্রেস করা হয়, ওপরে থাকা পরিবাহীটি নিচের পরিবাহীর সাথে সেই অন্তরকের মধ্যে থাকা ফুটোর মাধ্যমে পরস্পরকে স্পর্শ করে। আর তখন একটি নির্দিষ্ট বিদ্যুৎ প্রবাহ হয়, এবং এর মাধ্যমে কম্পিউটার জানতে পারে কোন কি প্রেস করা হয়েছে। আর ছোট্ট একটি স্প্রিংয়ের মতো রাবার ব্যবহার করা হয় প্রতিটা কি -তে, যেন প্রেস করার পর আবার সেটা আগের স্থানে ফিরে আসে এবং সার্কিটের বিদ্যুৎ প্রবাহও ব্রেক করিয়ে দেয়।
সকল টাচস্ক্রিনই প্রায় একই ধরণের। এটা ঠিক যে এখানে সুইচ ব্যবহার করা হয় না, যার ফলে স্ক্রিণে কিছুই দেখা যাবে না বা ডিসপ্লে এর ভিজ্যুয়াল ব্লক করে দিবে।
তাহলে টাচ করার পরও কীভাবে ডিভাইস বুঝতে পারে, তাও অদৃশ্য মাধ্যমে!
কীভাবে টাচ স্ক্রিন কাজ করে?
একেক টাচস্ক্রিন একেকভাবে কাজ করে। বা বিভিন্ন ধরণের স্কিন বাজারে প্রচলিত। এখন কিছু স্ক্রিন শুধু একটি আঙ্গুলের এর অবস্থান বুঝতে পারে। যখন দুই বা বেশি সংখ্যক আঙ্গুল ব্যবহার করা হয়, তখন সার্কিট কনফিউজড হয়ে যায় নির্দিষ্ট কোন অংশে আঙ্গুল স্পর্শ করা হয়েছে, সেটা নির্ধারণ করতে। আর অন্যগুলোতে সহজে একটার বেশি আঙ্গুল ডিটেক্ট করতে পারে ও স্ক্রিনে অবস্থানও নির্ণয় করতে পারে। নিচে কিছু অধিক প্রচলিত টাচ স্ক্রিন প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হলো-
সেজিসটিভ (Resistive):
রেজিসটিভ টাচস্ক্রিন বর্তমানের সবচেয়ে জনপ্রিয় টাচ স্ক্রিণ প্রযুক্তি। এটা কাজ করে কিছুটা "স্বচ্ছ কি-বোর্ড" এর মতো যা পুরো স্ক্রিনের এর ওপর আবৃত থাকে। তো কি-বোর্ডটির ওপরে একটি নমনীয় বিদ্যুৎ পরিচালনে সক্ষম পলিস্টার প্লাস্টিকের স্তর থাকে, যা নিচের স্তরের একটি শক্ত কিন্তু বিদ্যুৎ প্রবাহে সক্ষম গ্লাস থাকে এবং মাঝে একটি অন্তরক থাকে। যখনই স্ক্রিনে স্পর্শ করা হয়, তখন সেই পলিস্টারের স্তর গ্লাসের স্তরের সাথে যুক্ত হয় এবং কি-বোর্ড এর মতো একটি সার্কিট পুর্ণ করে ও বিদ্যুৎ প্রবাহ হয়। আর স্ক্রিনে থাকা একটি চিপ স্পর্শ হওয়ার স্থানের স্হানাঙ্ক নির্ণয় করে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে।
ক্যাপাসিটিভ (capacitive):
এই স্ক্রিনগুলো কয়েক স্তরের গ্লাস দিয়ে তৈরী হয়। ভেতরের স্তরগুলোতে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয় এমনকি বাহিরের স্তরেও।
এর ফলে স্ক্রিন কাজ করে দুইটা বৈদ্যুতিক পরিবাহীর মতো একটি অন্তরক দ্বারা পৃথক হয়ে থাকে, বা তাকে ক্যাপাসিটর বলা যায়। যখনই স্ক্রিনের ওপর আঙ্গুল রাখা হয়, তখন শরীরে সামান্য চার্জ র্বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তন ঘটায়, এবং এর ওপর অবস্থান নির্ণয় করা হয়। কিছু ডিজাইনে কর্ণারে সার্কিট থাকে, যেগুলা অবস্থা নির্ণয় করে।
মাল্টিটাচ স্কিনগুলোতে গ্রিড সিস্টেমে থাকে পরিবাহিরগুলো, যেটা আরও জটিল ইনপুট দেয়।
আর এটা রেজিসটিভ স্ক্রিনের চেয়ে বেটার কারণ
অযথা কোনো কিছুর স্পর্শে স্ক্রিন রেসপন্স করে না। বৈদ্যুতিক ফিল্ডে পরিবর্তন ঘটাতে পারবে এমন জিনিসে শুধু টাচ হবে।
বর্তমান স্মার্টফোনগুলোতে এই ধরণের স্ক্রিন বয়বহার করা হয়।
ইনফ্রারেড (Infrared):
ইনফ্রারেড টাচস্ক্রিনে মূলত ব্যবহার করা হয় এলইডি এর প্যাটার্ন এবং লাইট ডিটেক্টর ফটোসেল যা স্ক্রিন এর চারদিকে থাকে। এলইডিগুলো থেকে ইনফ্রারেড রশ্মি স্ক্রিনের সামনে জ্বলজ্বল করে যা দেখতে কিছুটা অদৃশ্য মাকড়সার জালের মতো। স্ক্রিমের কোথাও টাচ করা হলে দুই বা ততোধিক আলোকরশ্মি বাধাপ্রাপ্ত হয়। স্ক্রিনে থাকা একটি মাইক্রোচিপ আঙ্গুলের স্পর্শ কোথায় পরেছে যার জন্য আলো চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে তা নির্ণয় করে। সনি ইবুক রিডার এ এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
সারফেসের শব্দ তরঙ্গ (Surface Acoustic Wave):
আশ্চর্যজনকভাবে এই টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি আলোর পরিবর্তে শব্দের দ্বারাই আঙ্গুল সনাক্ত করতে পারে। আল্ট্রাসনিক শব্দ তরঙ্গ (মানুষের শ্রবণ শক্তির বাহিরে) স্ক্রিনের প্রান্ত থেকে বের হয় এবং প্রতিফলন হয়ে ফিরে আসে এবং এর পৃষ্ঠতল জুড়ে প্রতিফলিত হয়। যখন স্ক্রিনে টাচ করা হয় তখন আঙ্গুলের দ্বারা শব্দ তরঙ্গ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং কিছু শক্তি ক্ষয় হয়। তখনই স্ক্রিনে থাকা মাইক্রোচিপ কন্ট্রোলার নির্ণয় করে সঠিক কোন বিন্দুতে স্পর্শ করা হয়েছে।
নেয়ার ফিল্ড ইমেজিং (Near Field Imaging):
তীব্র শব্দ উৎসের কাছে থাকলে দেখা যায় তা শরীরের উপর প্রভাব পড়ছে। আমাদের শরীর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের দ্বারা প্রভাবিত হয় যা উৎসের থেকে আসে। যদি কাছাকাছি যাওয়া হয় তবে এটি শরীরের উপর আরও বেশি প্রভাব ফেলে। নেয়ার ফিল্ড ইমেজিং (NFI) এই একই ভাবে কাজ করে। যখন স্কিনের টাচ করা হয় তা স্ক্রিনের ইলেকট্রিক ফিল্ডকে পরিবর্তন করে যা দ্রুত টাচ করা জায়গা চিহ্নিত করতে পারে। এটি অন্য প্রযুক্তি থেকে অনেক শক্তিশালী এবং যেকোনো খারাপ পরিবেশে কাজ করে। NFI কলম, গ্লাভবস সহ জিনিসগুলো সনাক্ত করে পারে। এই প্রযুক্তি মূলত সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
টাচ স্ক্রিনের সুবিধাঃ
টাচ স্ক্রিন টেকনোলজির সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো এটা মানুষ সহজে খুব সহজে ব্যবহার করতে পারে। টাচস্ক্রিনে মানুষের যতটুকু তথ্যের দরকার হয় তার সবটুকু প্রদর্শন করতে পারে এবং যে-কোনো কাজ করতে জটিল প্রসেসে না গিয়ে খুবই সহজ এবং সিস্টেমিক উপায়ে করা যায়। এজন্যই প্রায় সর্বক্ষেত্রে এর ব্যবহারের প্রচলন চলছে কারণ কম্পিউটারের স্ক্রিন ও কি-বোর্ডেও অনেক সময় সময় সমস্যা হয়।
বর্তমানে বেশিভাগ মানুষ অ্যাপল বা এন্ড্রয়েড স্মার্টফোন ব্যবহার করে যেগুলোতে মাল্টিটাচ স্ক্রিন থাকে। সব বড়ে সুবিধা হলো যখন যেটা দরকার স্ক্রিন তাই দেখাতে সক্ষম হয়। যখন ফোন কল করা হয় তখন ডিসপ্লেতে শুধু ০-৯ পর্যন্ত নম্বরের জন্য কাজ করে। আর ম্যাসেজ টেক্সট করার সময় এটি কি-বোর্ড এর জন্য কাজ করে। আবার গেম খেলার সময় এর অবস্থা আবার পরিবর্তিত হয়। টাচ স্ক্রিনগুলো বহুমুখি কাজে ব্যবহার করা যায়, প্রতি মুহুর্তে পরিবর্তন হয় প্রয়োজন অনুসারে।
আরেকটা বড়ো সুবিধা হলো এতে কোনো মুভিং পার্ট নেই। সাধারণ কম্পিউটারে কি-বোর্ড এ যেমন শতাধিক পার্টস থাকে সার্কিট থাকে তাই সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। স্মার্টফোন, ইবুক রিডার এবং ট্যাবলেটে এটি দেখা গেলেও পিসি ও ল্যাপটপে অনেকটা আনকমন। তবে মাইক্রোসফট তাদের আপডেট রেখেছে অপারেটিং সিস্টেম এ টাচ অপশন ও ভার্চুয়াল কি-বোর্ড অপশন রেখে। সময়ের সাথে এই প্রযুক্তি আরও উন্নত হচ্ছে যার কারণে প্রচলিত ৬০ হার্জের টাচ রেসপন্সের বাহিরে ১২০/১৪৪/২৪০/২৭০ হার্জ পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে, যা অন্তত দ্রুত ও স্মুথ এক্সপেরিয়েন্স দেয়। সময়ের সাথে এই প্রযুক্তির আরও উন্নত সংস্করণ আসবে এবং ভবিষ্যতের আরও কার্যকরী পদ্ধতি হিসেবে প্রমাণিত হবে এটাই আশা।
সোর্সঃ
১.
https://www.explainthatstuff.com/touchscreens.html
২.
রওনক শাহরিয়ার,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান