Ads Area

advertise

হিস্টোরিকাল সাইন্স এবং অপারেশনাল সাইন্সের দুরত্ব কতখানি?

0

লেখকঃ প্রজেশ দত্ত
কিছুদিন আগে নেট ঘাটতে ঘাটতে একটা কৌতুহল উদ্দীপক আর্টিকেল চোখে পড়লো। আর্টিকেলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বলা চলে হিস্টোরিকাল সাইন্স, অপারেশনাল সাইন্স এবং এদের পার্থক্য। পুরো আর্টিকেল জুড়ে সাইন্সের এই দুই ভাগের বিভিন্ন পার্থক্য দেখানো হয়েছে। সব তথ্য সঠিকভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে, যুক্তিও ঠিকঠাক আছে, কিন্তু পুরো লেখাটা পড়ে যখন শেষ করলাম তখন একটা জিনিসের অভাববোধ হতে শুরু করলো। লেখক তার লেখা রীতিমতো হিস্টোরিকাল সাইন্স বনাম অপারেশনাল সাইন্স দিয়ে শুরু করেছেন; আবার সেই হিস্টোরিকাল সাইন্স বনাম অপারেশনাল সাইন্স দিয়েই শেষ নামিয়েছেন। যেন এই দুই ক্ষেত্র একে অপর থেকে শত আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করে যাওয়া কোনো কপোত-কপোতী যাদের মিলন লেখকের চোখ এড়িয়ে যায়।

বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে তাদের কাজ করার পদ্ধতি, গবেষণা পদ্ধতিসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। যেহেতু আলাদা আলাদা ক্ষেত্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে সেহেতু যেকোনো দুই ক্ষেত্রের মধ্যে কিছু না কিছু পার্থক্য অবশ্যই থাকবেই। কিন্তু তাই বলে তাদের একজন মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স এবং অপরজন ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সে অবস্থান করছে না যে তাদের মধ্যে ক্রসওভার ঘটবে না কোনো ক্ষেত্রে। অবশ্যই বিজ্ঞানের এক ক্ষেত্রের সাথে আরেক ক্ষেত্রের গভীর সম্পর্ক রয়েছে, এক ক্ষেত্রের প্রভাব আরেক ক্ষেত্রে স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু যখন কেউ কোথাও ন্যাচারাল সাইন্স বনাম সোশ্যাল সাইন্স, ফিজিক্যাল সাইন্স বনাম লাইফ সাইন্স শিরোনামে আলোচনা শুরু করেন, তখন শুধু তাদের পার্থক্যগুলোই মোটা দাগে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করার প্রবণতা দেখান তারা, এসব ক্ষেত্রের মধ্যকার সম্পর্কগুলো বিবেচনায় আনতে বেমালুম ভুলে যান, ফলে তাদের এত এত যুক্তির শেষে যে সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে সেটাও হয় বায়াসড, মিসলিডিং। হয়তো অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে এই কাজ করে থাকেন নিজের আর্গুমেন্টকে টিকিয়ে রাখার জন্য, আবার হয়তো অনেকে উদাসীন থাকেন নিজের যুক্তির সীমাবদ্ধতা নিয়ে।

তো এবার আসি আসল কথায়। বিজ্ঞানকে আমরা এর কাজ করার ধরণের উপর ভিত্তি করে দুইটা ভাগে ভাগ করতে পারি।

১) অপারেশনাল/ফাংশনাল/এক্সপেরিমেন্টাল সাইন্স: এটা হলো গবেষণামূলক বিজ্ঞান। আপনি সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন, হাতেকলমে প্রয়োগ করতে পারবেন, পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালাতে পারবেন। বলা চলে, এই বিজ্ঞান বর্তমানকে পর্যবেক্ষণ করে, বর্তমানকে নিয়ে ময়নাতদন্ত চালায়। কোথাও কোথাও এর নাম অভজার্ভেশনাল সাইন্স কিংবা এক্সপেরিমেন্টাল সাইন্স লেখা পেতে পারেন। সবগুলো টার্মের অর্থ একই।

২) হিস্টোরিকাল সাইন্স: অতীতকে জানার বিজ্ঞান। আমরা বর্তমানে কোনো কিছু পর্যবেক্ষণ করার পর তার উৎপত্তি বা তার পিছনের কারণ জানতে আগ্রহী হয়ে উঠি। কিন্তু আমাদের পক্ষে কী অতীতে গিয়ে নিজ চোখে পর্যবেক্ষণ করে আসা সম্ভব? উত্তরটা হলো, না। হিস্টোরিকাল সাইন্স কোনো কিছুর অতীত রহস্য উদঘাটন করে আমাদের জ্ঞানতৃষ্ঞা মিটায়।

উপরের সংজ্ঞা থেকে হিস্টোরিকাল সাইন্স এবং অপারেশনাল সাইন্সের পার্থক্য স্পষ্ট। অপারেশনাল সাইন্সের সবচেয়ে বড় গুণ হলো এটা সরাসরি আমাদের কোনো কিছু পর্যবেক্ষণ বা সেটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষার সুযোগ করে দেয়। উদাহরণস্বরুপ, মাই টিচার অক্টোপাস ডকুমেন্টারির কথা মনে আছে? আমরা দেখেছিলাম অক্টোপাস কীভাবে শিকারীকে পরাজিত করে, আমরা দেখেছিলাম অক্টোপাস কীভাবে সহজে একজন মানুষকে বিশ্বাস করে নিতে পারে, আমরা দেখেছিলাম একটা অক্টোপাস শিকারদের ধাওয়া না করে কোনো এক সকালে তাদের সাথে খেলা করছিলো মনের আনন্দে। অক্টোপাসের এসব বৈশিষ্ট্য আমরা সরাসরি পর্যবেক্ষণ থেকে জানতে পেরেছি। সোডিয়ামের সাথে পানি মিশালে ঠিক কিরকম বিক্রিয়া হবে, তাতে তাপ উৎপন্ন হবে নাকি তাপ শোষণ হবে, প্রভাবকের পরিবর্তনে বিক্রিয়ায় কীরুপ পরিবর্তন আসতে পারে এসবও আমরা সরাসরি ল্যাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারি। একটা ব্যাক্টেরিওফাজ ভাইরাস কীভাবে বংশবিস্তার করে সেটাও আমরা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারি। এসবই অপারেশনাল সাইন্সের অন্তর্ভুক্ত। আবার, অপারেশনাল সাইন্স কোনো ধারণাকে সরাসরি পরীক্ষা করেও দেখতে পারে। একটা ঘটনার জন্য পূর্বের কোনো ঘটনাকে দায়ী মনে হলে আমরা সেই ঘটনার রিপিট ঘটিয়ে পরীক্ষা করে দেখে নিতে পারব আসলেই ফলাফল দেখে করা অনুমান সঠিক কিনা।

হিস্টোরিকাল সাইন্স ফাংশনাল সাইন্স থেকে অনেকটা আলাদা। হিস্টোরিকাল সাইন্স কাজ করে প্রমাণাদির সাপেক্ষে যুক্তিপ্রয়োগ করে। অতীত নিয়ে এই যুক্তিপ্রয়োগ/রিজনিং এর একটা উদাহরণ প্রথমে দেখে নেওয়া যাক। ধরুন, আপনি এবং আপনার স্ত্রী প্রিয়া একটি বাগান ঘেরা বাড়িতে থাকেন। আপনাদের সাথে আর কেউ থাকেনা বাড়িতে। তো একদিন আপনি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে দেখলেন ঘরের দরজা খোলা। কিন্তু এরকম হুট করে দরজা তো খোলা থাকেনা, বন্ধই থাকে। আর প্রিয়ার তো এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফেরার কথা না। এই ঘটনার পিছনে কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আপনার মাথায় কয়েকটি সম্ভাবনা আসলো-
১) প্রিয়া ঘরের ভিতরেই আছে, সে হয়তো দরজার ছিটকিনি ভিতর থেকে আটকাতে ভুলে গেছে।
২) প্রিয়া এখনো ফেরেই নি, চোর দরজার তালা ভেঙে চুরি করে নিয়ে গেছে।
৩) কোনোভাবে হয়তো সকালে অফিসে যাওয়ার সময় তালা লাগাতে ভুলে গেছেন।

এক্ষেত্রে এভিডেন্স সংগ্রহের পূর্বে প্রতিটা ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা সমান সমান ধরে নিলাম। এবার আপনি উপরের ঘটনাগুলোর সাথে আপনার হাতে থাকা তথ্য-উপাত্ত মিলিয়ে তাদের সম্ভাবনা যাচাই করতে থাকলেন। 
১) চোর তালা ভেঙে নিয়ে গেলে ভাঙা তালা পেতেন, কিন্তু আপনি এসে দেখছেন তালা অক্ষত, খোলা অবস্থায় আছে। আর এই নতুন, মজবুত তালা আপনি আজকে সকালেই ব্যবহার শুরু করেছেন, ফলে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তালা খুলতে পারার সম্ভাবনা একেবারেই কম। ফলে চোর এসে আপনার ঘরের দরজার তালা খুলেছে এর সম্ভাবনা অনেকখানি কমে গেলো (একদম শূণ্য হয়নি এখনো) বাকী দুইটা ঘটনার তুলনায়। আপনি এবার ঘরের ভিতরে ঢুকলেন, ঢুকে দেখলেন সব জিনিসপত্র অক্ষত অবস্থাতেই আছে, কিছুই চুরি হয়নি। এর অর্থ চোর আসার সম্ভাবনা এখন একেবারেই শূণ্য।

২) আপনি এবার জোরে প্রিয়া, প্রিয়া চিৎকার করলেন, কিন্তু কেউ ডাক শুনলো না। তখন আপনি আপনার স্ত্রীর নম্বরে ফোন দিলেন, দেখলেন আপনার স্ত্রীর মোবাইল ফোন বাজছে, রিংটোনের আওয়াজ ড্রয়িং রুম থেকে আসছে। এসে একটু খুঁজে দেখার পর মোবাইল ফোন সোফার উপর পড়ে থাকতে আবিষ্কার করলেন। এবার আপনি নিশ্চিত হলেন প্রিয়া তাহলে বাসায় ফিরেছে এবং সে-ই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেছে। তাহলে তিন নম্বর ঘটনা অর্থাৎ অফিস যাওয়ার সময় তালা না লাগিয়ে যাওয়া- সেটার সম্ভাবনা আপনাআপনি কমে শূণ্যের কাছাকাছি চলে গেলে। 

তো রিজনিং শুরু হয়েছিলো বর্তমানে পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া একটা তথ্যের অতীত উৎস সন্ধানে। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আপনি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছে যেতে পেরেছেন। শুরুটা হয়েছিলো তিনটা পৃথক পৃথক ব্যাখা এবং তাদের সমান সমান সম্ভাবনা দিয়ে, তখন হাতে ইনফরমেশন ছিলো কম, ঐ ইনফরমেশন আবার সবগুলো ব্যাখাকেই সমানভাবে সাপোর্ট দিচ্ছিলো, আস্তে আস্তে আপনার সংগ্রহ করা তথ্য বাড়তে থাকলো, অন্যান্য ঘটনা ঘটার চান্স কমতে থাকলো এবং একটা ঘটনা ঘটার চান্স বাড়তে থাকলো, শেষমেশ এত পরিমাণ তথ্য পেয়েই গেলেন যা একটা মাত্র ব্যাখার সাথেই সঠিকভাবে খাপ খায়।

আমি এই উদাহরণটা ব্যবহার করেছি কীভাবে রিজনিং করতে হয় তার একটা খুব সাধারণ ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। অবশ্যই এই ধরনের থট এক্সপেরিমেন্টে আরও বেশি ক্রাইটেরিয়া এনে, আরও বেশি সম্ভাবনা এনে জটিল গোলকধাঁধা বানানো সম্ভব, এমন গোলকধাঁধা যার সমাধান হবেনা, কিন্তু কল্পনায় অনেক কিছু সম্ভব হলেও বৈজ্ঞানিক গবেষণা কোনোদিক থেকে কল্পনা না। ফলে বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করে প্রাপ্ত ফলাফলগুলো যুক্তির মাপকাঠিতে সাজাতে থাকলে সঠিক সিদ্ধান্তের দিকে আস্তে আস্তে অগ্রসর হন গবেষকরা, বাকী সম্ভাব্য ব্যাখাগুলো বাতিল হতে থাকে। অনেকটা "Process of elimination" এর মতো। অনেকগুলো সম্ভাব্য ফলাফল থেকে একটাকে বেছে নেওয়ার জন্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করে একটা একটা করে ফলাফলকে বিবেচনা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া। উপরের রিজনিং সম্পর্কিত উদাহরণেও প্রসেস অব এলিমিনেশন অনুসরণ করা হয়েছে। আর এখানেই এসে মিলবন্ধন ঘটে হিস্টোরিকাল সাইন্স এবং অপারেশনাল সাইন্সের।

আমরা এতসময়ে সঠিক ফলাফল নির্ধারণের জন্য রিজনিংয়ের সাথে যে তথ্য-উপাত্ত মিলানোর কথা জানলাম সেসব তথ্য উপাত্ত আসে অপারেশনাল সাইন্স থেকে। বিভিন্ন পৃথক পৃথক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের মধ্যে সেতু রচনা করে হিস্টোরিকাল সাইন্স, তারপর পরবর্তী গবেষণার সম্ভাব্য ফলাফল অনুমান করে। সম্ভাব্য ফলাফলগুলো যদি একাধিক হয় তবে দেখার বিষয় পরবর্তী গবেষণায় কী ফলাফল উঠে আসে এবং সেটা কোন কোন সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখে। এভাবে বারবার পরীক্ষণে পাওয়া তথ্য উপাত্ত মিলিয়ে মিলিয়ে শেষে একটা সম্ভাবনাই টিকে থাকে যেটা আর কোনো গবেষণায় বিপরীত ফলাফল দেয়না, ভূল প্রমাণিত হয়না। যতক্ষণ না এরূপ একটা সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে যেটা সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সামর্থ্য রাখে ততক্ষণ সবগুলো সম্ভাবনাই আমলে নেওয়া হয় কম-বেশি। উপরে হিস্টোরিকাল সাইন্সের কাজ করার পদ্ধতি বিশ্লেষণের সময় একটা কথা বারবার মনে নড়াচড়া দিয়ে উঠছিলো। বিজ্ঞানী হওয়ার প্রথম শর্ত সম্ভবত গোয়েন্দা হওয়া, শুধু তথ্য-উপাত্ত আর জ্ঞান দিয়ে সব দায় মিটে যায় না। বিজ্ঞানীরা একেকজন সুদক্ষ গোয়েন্দা, তারা অনুসন্ধান করে করে চলেছেন এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন ঘটনার অতীত কিংবা বর্তমান কারণ এবং সেইসব ঘটনার ভবিষ্যৎ প্রভাব।

হিস্টোরিকাল সাইন্স কী আমাদের পুরোপুরি সত্য জানাতে পারে?

এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আমাদের প্রশ্নটা সঠিকভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। এই প্রশ্ন শুনে যদি আপনার মনে হ্যাঁ/না কোনোটার উদয় ঘটে তাহলে আপনি ভূল পথে এগোচ্ছেন। এই প্রশ্নের উত্তর কখনোই হ্যাঁ-না এই দুই শব্দের যেকোনো একটি ব্যবহার করে দেওয়ার মতো কোনো প্রশ্ন না। হিস্টোরিকাল সাইন্সের অন্তর্ভুক্ত একেক ক্ষেত্রের একেক রহস্যের সমাধানের পক্ষে এভিডেন্সের কমবেশি পার্থক্য রয়েছে। কোনো কোনো ঘটনার ব্যাখা হয়তো কয়েক হাজার এভিডেন্সের আগুনে পুড়ে নিঁখাত স্বর্ণে পরিণত হয়েছে, অন্যদিকে কোনো ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য এখনো পর্যাপ্ত এভিডেন্স পাওয়াই যায়নি। তাই কয়েক হাজার এভিডেন্স নিজের ঝুলিতে নিয়ে বসে থাকা প্রথম ঘটনাটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখা যদি শতভাগ রিলায়েবল হয় বিজ্ঞানীদের কাছে তবে পরের ঘটনাটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখা তুলনামূলক কম রিলায়েবল হবে এর পক্ষে প্রমাণের ঘাটতির কারণে। এজন্য পুরো হিস্টোরিকাল সাইন্স কতটা সফল নিজের জায়গায় তা কখনোই আপনি নির্ধারণ করতে পারবেন না, পারবেন না এই পুরো ক্ষেত্রটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। বরং আপনাকে প্রথমে নির্দিষ্ট প্রশ্ন বাছাই করতে হবে, তারপর সাইন্স ঐ প্রশ্ন নিয়ে কী কী বক্তব্য পেশ করতে সক্ষম তা জানতে হবে, সেইসব বক্তব্যের কোনো বিকল্প সম্ভাবনাও পেশ করা হয়েছে কিনা জানতে হবে, কী কী এভিডেন্সের উপর ভিত্তি করে বাকী সকল সম্ভাবনা বাতিল করে এই একটা ব্যাখা বিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছেন সেটা বুঝতে হবে। এরপর খুঁজবেন আপনার মনে এখনো কী কী সংশয় রয়ে গেছে, সেগুলোর উত্তর পাওয়া যাচ্ছে কীনা, এরপর আপনি বিজ্ঞানীদের ঐ ব্যাখা কতটা গ্রহণযোগ্য সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, অবশ্যই আপনার সিদ্ধান্তের পক্ষে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক যুক্তি এবং তথ্য থাকতে হবে যা আপনাকে বিজ্ঞানী বা গবেষকদের ব্যাখা না মানতে সাহস জুগিয়েছে। 

গত কয়েকদিন আগে Z জিনোম নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখেছিলাম। সদ্য প্রকাশিত হওয়া তিনটা রিসার্চপেপারের ফলাফলে ফোকাস করা হলেও প্রথম সাতাত্তর সালে এই জিনোম আবিষ্কার থেকে আজ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য, এভিডেন্সের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা কী কী সিদ্ধান্তে পৌছেছেন সেগুলোও সংক্ষেপে আর্টিকেলে উল্লেখ ছিলো। তো Z জিনোম নিয়ে বিজ্ঞানীরা যা যা বলছেন বা ধারণা করছেন তার কোনটা কতটা নিশ্চিত আর রিলায়েবল তা একটু ঘাঁটা যাক এখন। 

১) Z নিউক্লিওটাইড উচ্চ প্রজাতির সদস্যে একদম নেই বললেই চলে। তবে বিবর্তনের ক্রমধারায় কিছু ট্রেস পাওয়া যেতে পারে। এই সিদ্ধান্ত প্রায় সম্পূর্ণ রিলায়েবল। এখন অবধি বিভিন্ন শ্রেণীর প্রচুর ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, উদ্ভিদ আর প্রাণীর জিনোম নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ২০০ প্রজাতির ব্যাক্টেরিওফাজ ভাইরাস ছাড়া আর কোথাও এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এটা গেলো পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যের কথা। এরপর আসে একটুখানি জৈবরসায়ন। দেখা গেছে এই জিনোমের উপস্থিতি ডিএনএ-র তাপমাত্রা সহনশীলতা বাড়ায়, তার অর্থ ভাইরাসগুলো প্রাচীন উত্তপ্ত পরিবেশে টিকে থাকতে কী ধরনের উপযোগিতা পেয়েছিলো তার একটা বেটার এক্সপ্লানেশন পাওয়া যাচ্ছে। আবার পরবর্তী সময়ে কেনো এই Z নিউক্লিওটাইড সমৃদ্ধ ডিএনএ পরিবেশে টিকে যেতে পারেনি, কেনো অধিকতর জটিল প্রজাতির সদস্যে এর ট্রেস পাওয়া যাচ্ছেনা তারও ব্যাখা বেরিয়ে আসে এখান থেকে। সাথে সাথে এই ব্যাক্টেরিয়োফাজে এই নিউক্লিওটাইড সিন্থেসিস করতে প্রয়োজনীয় প্রোটিন PurA, PurB এবং এনজাইমও ব্যাক্টেরিয়ায় উপস্থিত। তাই Z নিউক্লিওটাইড যে প্রধানত ঐসব ভাইরাসেই পাওয়া যাবে তা বুঝতে বাকী আছে কী?

২) এই Z নিউক্লিওটাইড সিন্থেসিস করতে প্রয়োজনীয় প্রোটিন উৎপন্ন হয়েছে PurA নামক আর্কেয়িদের এক প্রোটিন থেকে। এই তথ্যও রিলায়েবল আগের তথ্যের মতো।

৩) এই Z নিউক্লিওটাইড মূলত পৃথিবীর বাইরে থেকে আসছে। গত শতকের এক উল্কাপিণ্ডের অবশিষ্ট হতে Z নিউক্লিওটাইড সহ কিছু স্টান্ডার্ড, নন-স্টান্ডার্ড নিউক্লিওটাইড পাওয়া গেছে। এই পৃথিবীর বাইরে থেকে আসার বিষয়টা মূলত একটা সম্ভাবনা, নিশ্চিত কিছু না। এই সম্ভাবনার বিষয়টি আগের পয়েন্ট দুইটির তুলনায় অনেক কম রিলায়েবল। সামনে আরও গবেষণা এবং তথ্যের দিকে আমাদের চেয়ে বসে থাকতে হবে এই সম্ভাবনা কতটা সত্য তা জানার জন্য। তার আগে কোনো গবেষকই নিশ্চিতভাবে আপনাকে বলবেন না যে এমনটাই হয়েছে।

তো আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা বিষয় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা যেমন আমাদের কিছু বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পেরেছে, ঠিক তেমনই কিছু বিষয়ে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে আমাদের সামনে। আরও কিছু ফাংশনাল সাইন্সের ব্যবহার, আরেকটু রিজনিং, আরেকটু এভিডেন্স, এরপরই বোঝা যাবে ঠিক কোন দুয়ার দিয়ে গমন করলে আমরা সঠিক পথে পৌছাবো। 

ডারউইনবাদ বনাম বিবর্তনবাদ: কার সাথে কার কীসের সম্পর্ক?

ডারউইনবাদ বলতে চার্লস ডারউইন তার পর্যবেক্ষণ, অর্জিত জ্ঞান, হাতে থাকা তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে যেসব কথা বলেছিলেন, লিপিবদ্ধ করেছিলেন নিজের গ্রন্থগুলোতে সেসব কথাকে বুঝানো হয়ে থাকে। আসলে ডারউইনের আগেও বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে অনেকে কাজ করে গেছেন। কিন্তু তাদের যুক্তির নৌকায় পাল ছিলো না বলে নৌকা আগায়নি বেশিদূর। এখন মোটামুটি ল্যামার্কের মতবাদ থেকে শুরু করে বিবর্তন তত্ত্বের বিভিন্ন অংশ পড়ানো হয়ে থাকে একাডেমিক লেভেলে, কিন্তু ল্যামার্ক যেভাবে প্রাণী থেকে প্রাণীর উৎপত্তি চিন্তা করে গেছেন তা ছিলো ত্রুটিপূর্ণ, সবচেয়ে বড় কথা তার হাতে প্রমাণ, নিজের মতবাদের পক্ষে যুক্তিও ছিলো সীমিত। ডারউইন এসে প্রথম বিবর্তনের নৌকায় পাল লাগান। তিনিই প্রথম এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতির উৎপত্তির দাবীর পাশাপাশি এর পিছনে প্রচুর পর্যবেক্ষণলব্ধ উপাত্ত নিয়ে হাজির হন এবং এই প্রজাতির উৎপত্তির একটা ঠিকঠাক মেকানিজম ব্যাখা করেন। তার কথাবার্তায় ছিলো পর্যাপ্ত যুক্তি, সাথে এভিডেন্স এবং সবশেষে ভবিষ্যৎ বাণী। তিনি তার বইগুলোতে শুনিয়েছিলেন সিলেকশনের মাধ্যমে বিবর্তন কীভাবে পরিচালিত হয় সেই গল্প। বলেছিলেন ভবিষ্যতে দুই প্রজাতির মধ্যবর্তী প্রজাতি যারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে তাদের ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনার কথা। আমরা পেয়েছি। তবু ডারউইনের বলা কথাগুলো বিবর্তন তত্ত্বের জন্য শেষ এবং সম্পূর্ণ সত্য হিসেবে বিবেচিত ছিলো না কখনোই, তার ধারণা করা অনেক কথাই পরবর্তীতে প্রমাণাদির সাহায্যে সংশোধিত হয়েছে, তার বলা সিলেকশনের সাথে আরও অনেক মেকানিজম যুক্ত হয়েছে প্রজাতি থেকে প্রজাতি উৎপত্তির বিভিন্ন ধাপ ব্যাখায়, এমনকি বিবর্তনের যত আধুনিক গবেষণা তা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দাঁড়িয়ে আছে জেনেটিক্স এবং জিনোমিক্সের উপর। অথচ মজার বিষয় হলো ডারউইন যখন তার যুক্তি খাড়া করেছিলেন তখন জেনেটিক্সে "জ" নিয়েও কোনো জ্ঞান ছিলো না তার। 

ডারউইন তার প্রথম বই অরিজিন অব স্পিশিজের ভূমিকা অংশে কিছু কথা লিখেছিলেন। আজ আমি ডারউইনের সেই কথাগুলো আপনাদের শোনাব। ডারউইন যেমন এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতির উৎপত্তির ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন, ঠিক তেমনই তিনি জানতেন তার বলা সব কথা, যুক্তি পুরোপুরি সঠিক না। তিনি একটা সূচনা করে গিয়েছেন বিবর্তন নিয়ে গবেষণার, পৃথিবীতে এত এত প্রজাতির প্রাণী কীভাবে এসেছে তা জানার, বোঝার একটা বৈজ্ঞানিক উপায়ের। তিনি বলেছেন- তিনি তার অর্জিত জ্ঞানের যে সারাংশ তার বইতে তুলে ধরেছেন তা অবশ্যই ত্রুটিপূর্ণ। তিনি তার সব কথার, সব যুক্তির পর্যাপ্ত উদাহরণ এবং প্রমাণাদি তুলে ধরতে পারবেন না এখানে, তার অনেক স্টেটমেন্টের উপর পাঠকদের প্রমাণ ছাড়াই নির্ভর করে থাকতে হবে। তবে ভবিষ্যতে তার স্টেটমেন্টের স্বপক্ষে হয়তো এভিডেন্স পাওয়া যাবে আরও বিশাল গবেষণা সংগঠিত হলে। একটা দাঁড়িপাল্লার একপাশে এভিডেন্স, সংগৃহীত তথ্য এবং আরেকপাশে যুক্তি রেখে সঠিক পথে এগোনো যায়, আগেই আমরা জেনেছি হিস্টোরিকাল সাইন্স এভাবে কাজ করে, ডারউইনও এভাবে এগিয়েছেন। কিন্তু তার হাতে এভিডেন্স কম পড়েছিলো কিছু ক্ষেত্রে, তাই সেসব স্টেটমেন্ট সত্য কিনা তা জানার জন্য আশা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হয়েছিলো। ডারউইন তার বইয়ের ভূমিকা অংশ শেষ করেছিলেন এভাবে, 
"Furthermore, I am convinced that Natural Selection has been the main but not exclusive means of modiication." 
এই লাইনে বোঝাই যায় ডারউইনের ধারণা ছিলো তখন থেকেই যে নেচারাল সিলেকশন বিবর্তনের পিছনে প্রধান কলকাঠি নাড়লেও, এটা একমাত্র নিয়ামক ছিলো না প্রজাতি থেকে প্রজাতির উৎপত্তি হওয়ার। আমরা পরবর্তীতে বিবর্তনকে আরও অনেকখানি এগিয়ে যেতে দেখেছি। একে একে মিউটেশন, ড্রিফট, হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার, জিন সোয়াপের মতো জেনেটিক লেভেলের ঘটনা বিবর্তনে যুক্ত হয়েছে যা নিয়ে ডারউইনের কোনো আইডিয়াও ছিলো না। ডারউইনের ধারণাগুলো যেমন আরও নানা উপায়ে পরীক্ষিত হয়েছে, যাচাই করা হয়েছে, তার দেওয়া ভূল ধারণাগুলো সংশোধিত হয়েছে তেমনই নতুন নতুন মেকানিজম যুক্ত হয়েছে বিবর্তনের সাথে। ডারউইনের সিলেকশনের মাধ্যমে বিবর্তনও এইসব মেকানিজমের মতো একটা মেকানিজম বলা যায়, পুরো বিবর্তন না। তাই যারা মনে করেন বা ভাবেন ডারউইনের দেওয়া ধারণাগুলোই (কিছু মানুষের ভাষায় ডারউইনবাদ) বিবর্তন তত্ত্বের সবকিছু, তারা অনেক বড় একটা ভূল ধারণার মধ্যে বাস করছেন। আবার মাঝে মাঝে দেখা যায়, অনেক মানুষ একটা জিনিস ফলাও করে প্রচার করেন, "ডারউইনবাদ অমুক জিনিস ব্যাখা করতে পারে না বা ডারউইনের অমুক কথাটা ভূল প্রমাণিত হয়েছে", তারা মনে করেন এর মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্ব পুরোপুরি নাকচ হয়ে গেছে কিংবা ভূল প্রমাণিত হয়ে গেছে। আবার অনেকে দেখা যায় ডারউইনের অমুক কথা ভূল শুনে খুবই হতাশ, উত্তেজিত হয়ে উঠেন। এই দুই দলের মানুষেরই অরিজিন অব স্পিশিজ বইয়ের ভূমিকা অংশ ভালো করে বোঝা উচিত, জানা উচিত বিবর্তন তত্ত্বের পরিধি। ডারউইন নিজেও জানতেন তিনি বিবর্তনের সব ঘটনা প্রমাণ করে যেতে পারবেন না, তার দেওয়া ব্যাখার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাহলে তার কোনো যুক্তি আজ প্রমাণ কিংবা যুক্তির আগুনে পুড়ে, সংশোধিত হয়ে নিঁখাদ সোনায় পরিণত হলে একদল মানুষের খুশি হওয়ার এবং অন্য একদল মানুষের অবাক হওয়ার কী কোনো কারণ আছে? আমার দৃষ্টিতে তো নাই। 

আমরা কী ডারউইনবাদ আর বিবর্তন তত্ত্বের মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে পেরেছি? ডারউইনের কোনো স্টেটমেন্ট সংশোধিত হওয়া মানে যে বিবর্তনের রহস্য উদঘাটনের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া সেই ধারণা কী পরিষ্কার হয়েছে? নাকী আমরা এখনো ভাবছি ডারউইন এমন বলেছিলেন, এমন হয়নি, তার মানে বিবর্তন তত্ত্ব বাতিল? যদি এতকিছু আমরা সত্যিকার অর্থে অনুধাবন করেই ফেলি সঠিকভাবে তবে আমরা বিবর্তন তত্ত্বে ডারউইনবাদের গুরুত্ব হয়তোবা বুঝতে পেরেছি, হয়তোবা নতুন করে আরেকটা বিভ্রান্তিরও জন্ম হতে চলেছে। সেটা হলো, "ডারউইনবাদ একদম ইউজলেস একটা জিনিস"। অনেকে প্রায়শই ডারউইনবাদ যে বিবর্তন তত্ত্বের একমাত্র বিষয়বস্তু না সেটা বুঝাতে বলে থাকেন, " ডারউইনবাদ ভূল হয়ে থাকলে কী যায় আসে?" কিংবা "ডারউইনবাদ ভূল প্রমাণিত হলে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় কোনো প্রভাবই পড়বে না।"- এই দুই ধরনের ধারণাই ভূল। ডারউইন তার স্বল্পজ্ঞানে যেটুকু কথা আমাদের জানায়ে গেছেন সেটুকুর গুরুত্ব আজও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, বিভিন্ন ঘটনা ব্যাখায় অহরহ প্রমাণিত হচ্ছে। 

ডারউইনের মূল কথা ছিলো সিলেকশনের মাধ্যমে প্রজাতি থেকে প্রজাতির উৎপত্তি। তার যুক্তির পথ ধরে আমরা নেচারাল সিলেকশনের আলোকে বুঝতে শিখেছি প্রজাতির অন্তঃ এবং আন্তঃসম্পর্ককে। খাদ্য, আশ্রয় এবং প্রকৃতির অন্যান্য সম্পদ যে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সংঘর্ষ, লড়াইয়ের কারণ তা ডারউইনের সমসাময়িক প্রকৃতিবিদরা জানতেন। কিন্তু এই নিয়ামকগুলোই যে যোগ্যতমদের টিকিয়ে রাখতে রাখতে একসময় নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করতে পারে তা ভাবনায় আসেনি তেমন কারও। ডারউইন প্রথম বুঝেছিলেন এবং বলতে সাহস করেছিলেন, কোনো প্রজাতির কিছু প্রাণীর বৈশিষ্ট্যে কোনো কারণে পরিবর্তনের সৃষ্টি হয়, যদি এসব বৈশিষ্ট্য পরিবেশের অনুকূল হয় তবে ঐ প্রাণীগুলো পরিবেশে টিকে থাকতে বেশি সুবিধা পেয়ে থাকে। ফলে তারা প্রাকৃতিক নির্বাচনের লড়াইয়ে টিকে যায়, দুর্বলেরা বিলুপ্ত হয়ে যায়, এভাবে বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হতে হতে একসময় দুই প্রজাতি সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যায়। ডারউইন যদিও ধারণা করেছিলেন "কোনো এক কারণে প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হচ্ছে" কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি কেনো এই পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে যখন মিউটেশনের ধারণা ময়দানে আসে তখন বিবর্তনের নৌকার পালে একদফা বাতাস লাগে। ডারউইন নেচারাল সিলেকশনের পাশাপাশি বিবর্তনে সেক্সুয়াল সিলেকশনের ভূমিকাও শনাক্ত করেছিলেন। বিভিন্ন প্রাণীতে তিনি বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেন যেগুলো প্রকৃতিতে টিকে থাকতে কোনো বিশেষ সুবিধা দেয়না প্রাণীকে, কিন্তু এসব বৈশিষ্ট্য সুবিধা দেয় ব্রিডিংয়ের ক্ষেত্রে। এসব বৈশিষ্ট্য দেখেই বিপরীত লিঙ্গের সদস্য আকৃষ্ট হয়, ফলে মেটিং একসেস পাওয়া সুবিধাজনক হয়। আর তাই এসব বৈশিষ্ট্য বংশপরম্পরায় টিকেও যায়। তো ডারউইন দুই ধরনের সেক্সুয়াল সিলেকশনের সাথে আমাদের পরিচয় করান। প্রথমত, নিজ প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে যুদ্ধের মাধ্যমে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই যুদ্ধ হয় পুরুষ সদস্যদের মধ্যে। তারা নিজেরা মারামারি করে কোনো নারী সদস্যের জন্য। শেষ পর্যন্ত যে জয়ী হয় সে বংশবৃদ্ধির সুযোগ পায়। আর দ্বিতীয়ত, নারী সদস্যের মন জয় করার মাধ্যমে; সেটা হতে পারে লড়াই করে কিংবা নানাধরণের কীর্তিকলাপ দেখিয়ে। এক্ষেত্রে নারী সদস্য নিজের পছন্দমতো পুরুষ সদস্য বেছে নেন। তো দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিলেকশন মূলত ঘটতেছে পুরুষের, ফলে সব পুরুষ সদস্য মেটিংয়ের সুযোগ পাচ্ছেন না, সিলেকশন প্রেসার কাজ করতেছে। কেন পুরুষ সদস্যদের উপরেই এই সিলেকশন প্রেসার কাজ করতেছে এর উত্তরও ডারউইন জানতেন না। এর উত্তর জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ব্যাটমানের জন্য। না, না, ডিসি ইউনিভার্সের ব্যাটমান না, ইনি আমাদের এই জগতের ব্যাটম্যান (I am Bateman)। সম্ভবত নামের উচ্চারণ বেটম্যান হবে, তো এই বেটম্যানের নীতি (Bateman's principle) বিশ্লেষণ করে কেনো বেশিরভাগ প্রজাতিতেই পুরুষ সদস্যের সিলেকশন ঘটে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি ডারউইন অনেক কিছুর কারণ না বলে যেতে পারলেও পরবর্তীতে আমরা তা জেনেছি। এখন ডারউইনবাদ বাতিল হলে অর্থাৎ নেচারাল সিলেকশন, সেক্সুয়াল সিলেকশন ভূল প্রমাণিত হলে ঠিক কী কী ঘটবে? ইকোলজি নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের জীবন নিজেদের কাছে ব্যার্থ মনে হবে। কিছুদিন আগে একটা রিসার্চে দেখা গেছে বন্য গাধা এবং ঘোড়া নিজেদের টিকে থাকার লক্ষ্যে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার বিপরীতে লড়াইয়ের জন্য পানির উৎস নিজেরা তৈরী করে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে। ফলে ওই বন্য গাধা এবং ঘোড়া যে শুধু নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের দৌড়ে এমন নয়, তাদের তৈরী গর্ত থেকে ঐ এলাকার আরও অনেক প্রাণী পানি পান করে নিজেদের জীবন রক্ষা করে চলেছে যা ঐ স্থানের বাস্তুসংস্থানের অস্তিত্ব টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হোমোলজির মাধ্যমে সাধারণ পূর্বপুরুষের ধারণা ডারউইন তুলে ধরেছেন। ২০১৪ সালের একটা রিসার্চে দেখা যায় পাখির গান গাওয়ার সক্ষমতার জন্য দায়ী জিন (FOXP2) এবং মানুষের কথা বলতে শেখার জন্য দায়ী জিনের মধ্যে মিল রয়েছে। যদি যেকেনো দুই প্রজাতির সাধারণ পূর্বপুরুষ থাকার বিষয়টা ভুলই হয়ে থাকে তবে পাখি ও মানুষে এইরকম সাধরণ জিন যারা একইরকম বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে তাদের অস্তিত্ব থাকার বিষয়টা অর্থহীন হয়ে যায়। আর এই যে জিনের মিলের কথা উল্লেখ করলাম সেটা দশ বছর ধরে সরাসরি ল্যাব এক্সপেরিমেন্টেই পাওয়া গেছে। তাই ল্যাব এক্সপেরিমেন্টে পাওয়া ফলাফলের উপর ডারউইনবাদ কিংবা বিবর্তনের কোনো প্রভাব নেই সেটা শুনতে বড্ড নিষ্ঠুর লাগে এসব জানার পর। বিবর্তনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে ইভ্যুলশনারি সাইকোলজি, ইভ্যুলশনারি এথিক্সের মতো শাখাগুলো যেখানে সেক্সুয়াল সিলেকশন, নেচারাল সিলেকশন একটা মেজর ভূমিকা পালন করে কোনো সমাজের বা সংস্কৃতির মানুষের মনোভাবের পিছনে থাকা ইতিহাস বুঝতে। ডারউইনবাদ ভূল প্রমাণিত হলে অনেক "কেনো" প্রশ্ন; অন্যান্য প্রাণীদের, মানুষের এতসব রহস্যময় আচরণ সবকিছুই এক নিমেষে অর্থহীন হয়ে পড়বে। তাই যারা গর্ব করে বলেন, "ডারউইনবাদ বাতিল হলে বিবর্তনের কিছু যায় আসেনা" কিংবা যারা যুক্তি খুঁজেন "ডারউইনবাদ বাতিল হলে বিজ্ঞানের কোনো সমস্যা নেই" তাদের উভয় পক্ষেরই নিজেদের অবস্থান আরও যাচাই করা প্রয়োজন।

হোমোলজি এবং আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ: চক্রাকার যুক্তি নাকী বিভ্রান্তি সৃষ্টি?

কয়েকদিন আগে এক মহাশয় দাবী করেছেন হোমোলজি এবং সাধারণ পূর্বপুরুষের অস্তিত্ব থাকা একটা চাক্রিক যুক্তি। আর যেহেতু এটা চাক্রিক যুক্তি তাই এই জিনিসটা বুঝে গেলে আর বেশি পড়াশুনা করার দরকার নেই বিবর্তন নিয়ে। তো একটু তার যুক্তি বিবেচনা করা যাক।
১) তিনি বলেছেন বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী হোমোলজি সঠিক কারণ সবার সাধারণ পূর্বপুরুষ আছে।
২) আবার সবার সাধারণ পূর্বপুরুষ আছে এটা সঠিক কারণ হোমোলজি সত্য।

প্রথমে হোমোলজি কী বিষয়টা একটু দেখে আসি আমরা। দুইটি ভিন্ন প্রজাতির দুইজন সদস্যের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন এবং ফিচারে মিল রয়েছে। এই যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অ্যানাটমি এবং ফিচারের সাদৃশ্য থাকা এর নাম হোমোলজি। আর যেসব বৈশিষ্ট্যে সাদৃশ্য পাওয়া যায় সেগুলো হোমোলোগাস বৈশিষ্ট্য। তো এই হোমোলজি থেকে একটা অনুসিদ্ধান্ত পাওয়া যায়। দুইটি ভিন্ন প্রজাতি তাদের কোনো সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এই হোমোলোগাস বৈশিষ্ট্যগুলো লাভ করেছে। যেমন: মানুষ ও পাখির কিছু সাদৃশ্য আছে তাদের স্কেলেটনে, ফলে ধারণা করা যায় মানুষ ও পাখি সুদূর অতীতে কোনো সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়েছে। আবার মানুষ ও ক্যাঙ্গারুর হোমোলোগাস ট্রেইট হলো এদের চুল যা পাখির নেই। ফলে সহজে বোঝা যাচ্ছে মানুষ ও ক্যাঙ্গারুর সাধারণ পূর্বপুরুষের জন্ম হয়েছে পাখির বিবর্তনের ধারা এই তিনজনের সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে।

তো এবার ফিরে যাই সেই অপারেশনাল সাইন্স এবং হিস্টোরিকাল সাইন্সের কচকচানিতে। তো আমরা বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যকার হোমোলোগাস বৈশিষ্ট্যগুলো শনাক্ত করছি কীভাবে? তাদের সরাসরি পর্যবেক্ষণ করে, তাদের দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশ্লেষণ করে। এটাকে সত্য প্রমাণ করার জন্য আলাদা যুক্তির বা প্রমাণের দরকারই নেই। এ তো গেলো অপারেশনাল সাইন্স। সরাসরি পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষার মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা শেষ। এবার এই হোমোলোগাস বৈশিষ্ট্য কেনো আছে তার কারণ নির্ণয় করতে যখন যুক্তিপ্রয়োগ শুরু হলো তখন ধারণা বা সম্ভবনা সৃষ্টি হলো একটাই- এই মিলের কারণ এদের সাধারণ পূর্বপুরুষের উপস্থিতি। 
তো আমার কাছে পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্য রয়েছে, একটা সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। এখন এই কারণই সত্য কি-না তা যাচাই করে দেখার সময়। যেহেতু ধারণা করা হচ্ছে এসব হোমেলোগাস বৈশিষ্ট্য কোনো সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত তাহলে নিশ্চয়ই জেনেটিক মিলও সেই পরিমাণে থাকে। আগের উদাহরণে ফিরে যাই। হোমোলজি অনুসারে মানুষ আর ক্যাঙ্গারুর পূর্বপুরুষ অপেক্ষাকৃত পরে এসেছে পৃথিবীর বুকে মানুষ এবং পাখির তুলনায়। তাহলে এদের জিন সিকোয়েন্সের মিলও একই ফলাফল প্রদান করার কথা। মানুষ এবং ক্যাঙ্গারুর জিন সিকোয়েন্সের মিল অনুসারে এদের সাধারণ পূর্বপুরুষ প্রায় ১৫০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর বুকে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিছে। সেখানে পাখি এবং মানুষের সাধারণ পূর্বপুরুষ প্রায় ৩০০-৩৪০ মিলিয়ন বছর পূর্বে নিজেদের স্বরুপ তুলে ধরেছিলো। সুতরাং হোমোলজি থেকে প্রাপ্ত সাধারণ পূর্বপুরুষের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলো জেনেটিক্স দ্বারা।

সুতরাং, উপরে যে চাক্রিক যুক্তি (হোমোলজি→সাধারণ পূর্বপুরুষ→হোমোলজি→সাধারণ পূর্বপুরুষ→হোমোলজি) সেটা কোনোদিন সৃষ্টিই হচ্ছে না। বরং ডায়াগ্রাম হচ্ছে এমন:

হোমোলোগাস বৈশিষ্ট্য শনাক্তকরণ→হোমোলজির ভিত্তিতে সাধারণ পূর্বপুরুষ অনুসারে সাজানো→জেনেটিক্সের ব্যবহার এবং ফলাফল যাচাই।

প্রসেজ দত্ত,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad

Below Post Ad

advertise