Ads Area

advertise

নির্দিস্ট সময়ে গর্ভধারনের মাধ্যমে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারন সম্ভব!?

0
লেখকঃ সমুদ্র জিৎ সাহা

১৯৬০ সালে ল্যান্ড্রাম বি শ্যাটেলস ( Landrum B. Shettles) নামের এক গবেষক একটা নতুন ধারনা নিয়ে আসেন, রজঃচক্রের নির্দিস্ট দিনে গর্ভধারনের মাধ্যমে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারনের ধারনা। তার প্রকাশিত বই How to Choose the Sex of Your Baby বইয়ের মাধ্যমে এই ধারনাকে জনপ্রিয় করার মাধ্যমে মডার্ন মেডিকাল মিথ হিসেবে মোটামুটি জনপ্রিয় হয়ে যায় এই ধারনাটা।

মূল আলোচনার আগে জেনে নেই সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারিত হয়ে কীভাবে।

(যারা এ বিষয়ে আগে থেকেই জানেন তারা এই প্যারা টি স্কিপ করতে পারেন)

ছোট ক্লাসের পড়া, আমরা জানি মানবদেহে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম রয়েছে। ক্রোমোজোম হল বংশগতির বাহক। একটা জীবের সব বৈশিস্ট্য লিখে রাখা থাকে ডিএনএ তে, সেই ডিএনএ পেচিয়ে তৈরি হয় একেকটা ক্রোমোজোম। এই ২৩ জোড়ার মধ্যে ২২ জোড়া হলো অটোসোম, নন-সেক্স ক্রোমোজোম, এদের দিয়ে সন্তানের লিঙ্গ এর কিছু যায় আসে না। বাকি ১ জোড়া ক্রোমোসোম হলো সেক্স ক্রোমোসোম। সেক্স ক্রোমোসোমকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, Y বা মেল সেক্স ক্রোমোসোম আর X বা ফিমেল সেক্স ক্রোমোসোম। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে এদের কাজ। নারী দেহের সেক্স ক্রোমোসোম জোড়া হয় XX আর পুরুষ দেহের হয় XY. অর্থাৎ সেক্স ক্রোমোসোমে Y ক্রোমোসোম থাকলে সেই সন্তান ছেলে হবে, না থাকলে মেয়ে। প্রজননের জন্য ডিপ্লয়েড (জোড়া ক্রোমোসোম বিশিস্ট) জীব থেকে হ্যাপ্লোয়েড (বেজোড় ক্রোমোসোম বিশিস্ট) জনন কোষ তৈরি হয়। সেই জনন কোষ দুটি মিলিত হয়ে সন্তানের প্রথম কোষ বা জাইগোট গঠন করে। নারী থেকে আসা জনন কোষ বা ডিম্বানুর সেক্স ক্রোমোসোম থাকতে পারে শুধুই X, আর পুরুষের হতে পারে X বা Y. যেহেতু Y থাকলেই ছেলে সন্তান হবে। সুতরাং, সন্তানের লিঙ্গ নির্ভর করে কোন ক্রোমোসোম বিশিস্ট্য শুক্রানু ডিম্বানুকে নিষিক্ত করবে তার উপর। মনে আছে? ৯-১০ এর বইয়ে আমরা একটি জনপ্রিয় প্রশ্ন পড়েছি, সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারনের পিছে দায়ী পরোক্ষভাবে পুরুষ! এভাবে দায় করা একেবারেই উচিৎ নয়, পুরোপুরি চান্সের উপর নির্ভর করে, বইয়েও লেখা ছিল সেটা।

তো শেটলসের এই দাবীর পেছনে ব্যাখ্যা টা কী ছিল?

উনার মতে Y সেক্স-ক্রোমসোম বিশিস্ট স্পার্ম (শুক্রানু) X সেক্স ক্রোমোসম বিশিষ্ট শুক্রানুর চেয়ে দ্রুত, কিন্তু ভঙ্গুর* (Fragile). মাইক্রোস্কোপ দিয়ে (ফেজ শিফট মাইক্রোস্কপি) স্পার্মে চোখ রেখে তিনি দেখেছিলেন দুই ধরনের স্পার্ম, ছোট-বড় মাথা অলা, তিনি ধরে নিয়েছিলেন Y ক্রোমোসোম ছোট, তাই দ্রুত সাতার কাটবে আর ভঙ্গুর ও হবে।  তার উপর এসিডিক পরিবেশ নাকি Y ক্রোমোসমের জন্য ক্ষতিকর। আর যেহেতু যোনীপথের পিএইচ এসিডিক, তাই বাচ্চা জন্ম দিতে X ক্রোমোসম বেশি প্রাধান্য পায় এবং সন্তান মেয়ে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে! কিছু  রজঃচক্রের নির্দিস্ট কিছুদিনে নাকি পিএইচ লেভেল কম এসিডিক থাকায় Y ক্রোমোসোম টিকে যায় এবং দ্রুত সাতার কেটে ডিম্বানুকে আগে নিষিক্ত করে এবং তার দাবী ৭৫-৯০% ক্ষেত্রে এটা কাজ করে। অনেকের মতে রজঃচক্রের ১২-১৩ তম দিনে গর্ভধারন X ক্রোমাজোম প্রাধান্য লাভ করবে এবং মেয়ে হবার সম্ভাবনা বেশি এর কাছাকাছি আর ১৫-১৭ তম দিনে গর্ভধারন করলে Y ক্রোমোজোম প্রাধান্য বিস্তার করে এবং ছেলে হবার সম্ভাবনা প্রায় একই থাকে।
Shettles method: https://en.wikipedia.org/wiki/Shettles_method

আসলেই কি তাই? উনি এই ধারনা দিয়ে ছিলেন শুধুমাত্র মাইক্রোস্কোপে স্পার্ম দেখে ধারনা করে আর খুব কম সংখ্যক কেস দেখে।  এমনিতেই সন্তান হবার সম্ভাবনা ৫০% পর পর কয়েকটা মিলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। তাই দরকার ছিল অনেক অনেক মানুষের উপর পরীক্ষা করার।

১৯৭৯ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ৩৬৫৮ সন্তান, যাদের জম্ন ওভ্যালুয়েশনের পরপরই গর্ভধারনের ফলে হয়েছিল তাদের মধ্যে মেল সন্তান জন্মের হার বেশি, ৬৫% প্রায়। আর এই সংখ্যাটা গর্ভধারনের দিন ওভালুয়েশনের থেকে যতদিন পর হয় তত কম হয়। তবে অতটাও কম না যা এই ধারনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। আর এই পরিসংখ্যানে “গেজ করে” অভালুয়েশনের দিন নির্ধারন করা, যেটা বিজ্ঞানসম্মত না।
https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/NEJM197906283002601

অন্যদিকে, ১৯৯৫ এর এক পরীক্ষায় ২২১ জন মহিলার উপর এটা পরীক্ষা করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা নারীর হরমন লেভেলে নজর রেখে বেশ এফিসিয়েন্ট ভাবে ওভালুয়েশনের দিন মেপে সেই অনুযায়ী ই গর্ভধারন করিয়েছেন। তাদের সূক্ষ পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল হিসেবে জানিয়েছেন এটা কাজ করে না, অর্থাৎ কনসিভের দিনের সাথে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারনের কোন সম্পর্ক নেই । সেই রিসার্চ পেপারের লিংক:
https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/NEJM199512073332301

একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানীরা আবার গবেষনা করে X ক্রোমোসোম বিশিস্ট্য স্পার্ম এবং Y ক্রোমোসোম বিশিস্ট্য স্পার্মের গঠনগত তেমন পার্থক্য খুঁজে পাননি কোন অবস্থাতেই (পরিপূর্ন বা অপরিপূর্ন)। সুতরাং, Y ক্রোমোসোমের দূর্বলতা* বা ভঙ্গুরতার দাবী টি ভিত্তিহীন। দুই ধরনের স্পার্ম প্রায় একইরকম, তাই পিএইচ লেভেলও ম্যাটার করেনা, সাঁতারের গতিও কোন ম্যাটার করেনা। এবং সব গবেষনার উপর ভিত্তি করে বলা যায় গর্ভধারনে রজঃচক্রের দিনের সাথে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারনের কোন সম্পর্ক নেই।
https://www.bmj.com/content/332/7546/916.3.full
https://onlinelibrary.wiley.com/doi/abs/10.1002/j.1939-4640.2001.tb02161.x

এক্সট্রা: অনেকের কাছে শুনি, অমুক ডাক্তার নিজে অনেক পেশেন্টের ক্ষেত্রে এটা কাজ করতে দেখেছে। সেক্ষত্রে বলব হোমিওপ্যাথিকেও কাজ করতে দেখেছে, যেখানে হোমিওপ্যাথি কোন ঔষধ ই না! এমনিতেই সন্তানের লিঙ্গ ছেলে/মেয়ে হবার সম্ভাবনা ৫০-৫০। পরপর কয়েকটা মিলে যাওয়া খুব অস্বাভাবিক কিছুনা। অনেকটা ঝড়ে বক মরে, ফকিড়ের কেরামতি বাড়ে টাইপের!

ব্যাখ্যায় কিছু ব্যাপার সরলীকৃত করে লেখা, সময় ও লেখার সাইজের সীমাবদ্ধতায়। আশা করি কারো আপত্তি নেই। তারপরও আপত্তি থাকলে জানাবেন।
আর উপরের সব রেফারেন্স গুলো সাইন্টিফিক জার্নাল থেকে দেওয়া। খুলে দেখবেন।

সমুদ্র জিৎ সাহা,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad

Below Post Ad

advertise