মনিফ শাহ চৌধুরী
“...প্রচন্ড গোলাগুলি হচ্ছে চারপাশে। স্থানীয়রা আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কখন মাথার ওপর কেমিক্যালের গোলা এসে পড়ে তারও ঠিক নেই। এসবের মাঝেই আমরা আমাদের প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি, ছোট্ট ভূখন্ডে আমাদেরও বেঁচে থাকার অধিকারের পক্ষে লড়াই করে চলেছি!
...হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে গেল। কেমো এট্যাক! আমরা হতবিহবল হয়ে পড়েছিলাম, ঠিক তখনই হেড কোয়ার্টার থেকে নির্দেশ এল লুকিয়ে পড়ার। আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করলাম তাদের রাডারে ধরা না পরতে, চুপচাপ প্রায় নিশ্চল হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম মেঘ কেটে যাওয়ার, এবং অপেক্ষা করতে লাগলাম ফিরে আসার, আরো শক্তিশালী হয়ে…!”
ওপরের বিবরণ এমন এক যুদ্ধক্ষেত্রের যার অবস্থান আমাদের শরীরের ভেতরেই। গল্পের নায়ক (কীংবা খলনায়ক) হল ক্যান্সার কোষ যাদের নির্মূল করার জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল থেরাপী দেয়া হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ক্যান্সার কোষ এই কেমিক্যালদের থেকে বেঁচে থাকার জন্য কিছু অদ্ভুত কৌশল রপ্ত করেছে এবং পরবর্তীতে উক্ত কেমোথেরাপীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। আজকে সেটা নিয়েই বিস্তারিত আলাপ।
শুরুতেই ক্যান্সারের পরিচিতি জানা প্রয়োজন। এটা নিয়ে আমার ছোট্ট একটা অগোছালো লেখা রয়েছে, সেটা পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করতে পারেন, নাও পারেন।
মূলত, ক্যান্সার কোষেরা আমাদেরই কোষ যাদের মাঝে বিভাজন নিয়ন্ত্রণ করার মেকানিজম কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকলে শক্তিচাহিদাও বৃদ্ধি পায় যার ফলে সেটা রোগীর জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায়। শুরুতে শরীরের ইম্যুনো সিস্টেম এদের বিরুদ্ধে ভাল কাজ করলেও ধীরে ধীরে যখন ক্যান্সার কোষ অস্থি মজ্জায় ছড়িয়ে পড়ে তখন কার্যকরী শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা কমতে শুরু করে। যার ফলে তাদের দমিয়ে রাখা আরো কঠিন হয়ে পড়ে।
চিকিৎসার জন্য কেমোথেরাপী নিতে হতে পারে আপনাকে। কেমোথেরাপীর ওষুধ সাধারণত সেই কোষদের মেরে ফেলে যেগুলোতে বিভাজন খুব দ্রুতগতিতে হয়, যেটার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে শরীরের সাধারণ কোষ যেগুলো দ্রুতগতিতে বিভাজিত হয় সেগুলোও মারা যায়, যেমন চুলের কোষ।
ক্যান্সার কোষ তাই এই কেমো এট্যাক এড়িয়ে চলার জন্য নিজেদের দ্রুতগতির বিভাজন শ্লথ করে দেয়।
দাড়ান দাড়ান, কী ব্যাপার?
ক্যান্সার কোষ যদি তাদেরই বলা হয় যাদের বিভাজিত হওয়ার প্রসেস অনিয়ন্ত্রিত তাহলে তারা কী করে সেই প্রসেসের গতি কমিয়ে দিতে পারে?
এখানেই শীতনিদ্রা কথাটা আসে। যদিও কোনো প্রাণী শীতনিদ্রায় গেলে তার কোষের যেমন অবস্থা হয় ক্যান্সার কোষের বিষয়টা তেমন নয়। এদের অবস্থা তুলনা করা যায় diapause শব্দটার সাথে। কিন্তু “ডায়াপজে ক্যান্সার কোষ” টাইটেল নিশ্চয়ই আকর্ষণীয় শোনায় না।
Diapause হল ভ্রুণ কোষের এমন অবস্থা যখন তার বিভাজিত হওয়ার হার কমে যায়। এটা একটা সুন্দর সার্ভাইবাল মেকানিজম। যদি গর্ভবতী মা খাবার কম পায়, কীংবা কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে যায়, যেমন কম তাপমাত্রা বা খরা ইত্যাদি, তখন মায়ের গর্ভে থাকা ভ্রুণ কম গতিতে বিভাজিত হয় যাতে প্রয়োজনীয় সময় পায় প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার। যদিও মানুষের ক্ষেত্রে এই diapause মেকানিজমটি এখন আর নেই, তবে পৃথিবীর প্রায় ১০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ীদের মাঝে এখনও এই মেকানিজম কাজ করে। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হল দুনিয়ার যে কোনো প্রাণীর যে কোনো ক্যান্সার কোষই এই diapause স্টেটে যেতে সক্ষম যদিও তার প্রজাতির embryo বা ভ্রুণে এই মেকানিজম হারিয়ে গেছে।
বিষয়টা নিয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন ক্যাথেরিন ও মিগেল নামক দুজন বিজ্ঞানী যখন তারা Human colorectal ক্যান্সার কোষ পেট্রি ডিশে রেখে সেখানে কেমোথেরাপী এপ্লাই করেছিলেন। দেখা গেল, তাদের বিভাজিত হওয়ার হার কমে গেল, তাদের শক্তিচাহিদা কমে গেল এবং যতক্ষণ কেমোথেরাপীর কেমিক্যাল সেখানে ছিল তারা কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই বেঁচে রইল, কিছু সংখ্যাক কোষ কেমোথেরাপির ড্রাগের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্টও হয়ে গেল।
ভ্রুণ কোষেরা যেভাবে diapause state এ থাকে সেখানে খাবারের ঘাটতি পড়লে তারা autophagy বা নিজেই নিজের মাঝে থাকা প্রোটিন ভেঙ্গে শক্তি চাহিদা পূরণ করে। এটা অনেকটা খাবারের অভাবে নিজের আঙ্গুল খাওয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ক্যান্সার কোষও একই কাজ করে কীনা তা দেখার জন্য সেই পেট্রি ডিশে এমন কিছু কেমিক্যাল দেয়া হল যেগুলো autophagy প্রসেসটা হতে দেয় না। দেখা গেল, ক্যান্সার কোষেরা আর diapause state এ থাকতে পারছে না এবং তাদের সহজেই কেমো দিয়ে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে।
এই গবেষণা থেকে আমরা কেমোথেরাপী আরো উন্নত করতে পারব। কেমো দেয়ার কারণে যদি ক্যান্সার কোষ diapause state এ চলে যায় তবে তাদের টার্গেট করে anti-autophagy drugs ব্যবহার করা যাবে যাতে তারা রেজিস্ট্যান্ট না হয়ে যেতে পারে।
ব্যস!
আচ্ছা, ক্যান্সার টিস্যু যদি কোনোদিন কনশাস হয়ে যায়?
(সমাপ্ত)
রেফারেন্স