লেখকঃ সমুদ্র জিৎ সাহা
জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে জানে না এমন মানুষ কম। যদিও আসলে বোঝে কতজন বলা মুশকিল, একে ভুয়া প্রমাণের জন্য উঠে-পড়ে লাগা লোকজনেরও অভাব নেই।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন করা হ্রাসে কী কী করা যায় এ নিয়ে USA আর জার্মানিতে একটা সার্ভে করা হয়েছিল সাধারণ মানুষদের মধ্যে। যা দেখে বোঝা যায় মানুষের গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণ ও হ্রাসে করণীয় সম্পর্কে কী পরিমাণ ভুল ধারণা রয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে কত শতাংশ মানুষ কোন জিনিসটা করাকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং রোধে সবচেয়ে কার্যকরী মনে করে, বনাম বছরে এক জনের দ্বারা সেই ক্ষেত্রে কী পরিমাণে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসারিত হয়।
যেমন, বেশিরভাগ মানুষ (২২%) মনে করেন প্লাস্টিক সামগ্রী (যেমন প্লাস্টিক ব্যাগ) ব্যবহার কমানোটা সবচেয়ে ইফেক্টিভ গ্লোবাল ওয়ার্মিং রোধে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বছরে মাত্র ৩ কেজি কার্বন নিঃসারন হয় মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের কারণে। প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের অন্যান্য অসুবিধা আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সমুদ্রের প্রাণীদের জন্য প্লাস্টিক ব্যাগ কত ক্ষতিকর তার বীভৎস কিছু ছবি সবাই দেখেছেন, তবে ক্লাইমেট চেইঞ্জে বেচারার দোষ অতটা নেই. [1]
২য় স্থানধারীর ক্ষেত্রে অবশ্য মানুষ কাছাকাছি গিয়েছে, USA/জার্মানির মতো উন্নত দেশে বিমানের ব্যবহার জনসংখ্যা বিবেচনায় ও অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ বেশি। [2] বিমানকে আকাশে ওড়াতে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি লাগে, যা মূলত ফসিল ফুয়েল। [3]
আবার, পরিসংখ্যানটিতে দেখা যায়, ঐ দেশে কার্বন এমিশনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায় মডার্ন হিটিং ও ইনসুলেশনের। USA/জার্মানি আমাদের তুলনায় অনেক শীতল জলবায়ুর দেশ, তাদের প্রত্যেকের বাসাতেই হিটিং এর প্রয়োজন হয়।
অন্যদিকে মাংস খাওয়া বন্ধ করে কার্বন এমিশন কমানোকে কম গুরুত্ব দিলেও আসলে ব্যক্তিগতভাবে কার্বন এমিশন কমানোর সবচেয়ে বড়ো উপায় হচ্ছে এটা। মাথাপিছু কার্বন এমিশনে ৩য় সর্বোচ্চ দায় মাংস খাওয়ার। কীভাবে? মাংস আসলে শক্তির উৎস হিসেবে প্রচণ্ড ইনেফিসিয়েন্ট একটা জিনিস। [4] প্রথমত একটা প্রাণীকে আমরা যে পরিমাণে খাওয়াই তার তুলনায় সামান্য অংশের শক্তি পাই তাকে খাদ্য বানিয়ে। আর একটা প্রাণী তার পুরো জীবনে প্রচুর তাপ ও মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে। বলা বাহুল্য, মিথেন গ্যাস আরেকটা গ্রিনহাউজ গ্যাস। যার গ্রিনহাউজ ইফেক্টের ক্ষমতা কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে বেশি। আর অনেকক্ষেত্রে আমাদের খাবারের ছোটো অংশ, অর্থাৎ মাংসের জন্য প্রয়োজনীয় জমির পরিমাণ আমাদের খাবারের বড় অংশ (ভাত, শাকসবজি) এর তুলনায় বেশি হয়ে যায়।
এখন এই পরিসংখ্যানটা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে দেখি। এটা আমেরিকা/জার্মানির মতো শিক্ষিত দেশের অবস্থা। আমাদের বা সাউথ এশিয়ার দেশগুলোতে অবস্থা আরও খারাপ ধরা যায়।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ কোনোদিন বিমানে চড়েনি আর চড়বেও না। সাথে আমাদের মতো গরম দেশে বাসা গরম রাখতে হিটারের ব্যবহার খুব কম। তীব্র শীত পড়লে সামান্য কিছু বাসায় হিটার ইউজ করতে দেখা যায়। সুতরাং পরিসংখ্যান ছাড়াও এদেশে লিস্টের টপ দুইটা কার্বন এমিশনের ক্ষেত্র বাদ দেওয়া যায়। তাহলে টপে কোনটা থাকে? মাংস খাওয়া। হ্যা, এইযে তীব্র গরম পড়ছে, আর প্রতিবছরই “এবারের মতো গরম কোনোবার পড়েনি” বলা রোধে ব্যক্তিগতভাবে আপনার প্রধান করণীয় হলো মাংস খাওয়া কমানো, পারলে পুরোপুরি বন্ধ করা। না, ভেজিটেরিয়ান হলে প্রোটিনের অভাবে কেউ দুর্বল হয় না/মারা যায় না। আর এটা শুধু বাংলাদেশে করলেই যথেস্ট না, পুরো বিশ্বেই করতে হবে।
[আমি এখানে ভেজিটেরিয়ানদের প্রমোট করতে আসিনি। অনেক ভেজিটেরিয়ানদের মতো মায়াকান্না করা দয়ালু প্রজাতি আমরা না। অন্য প্রাণী মেরে খেয়েই আজ এই পর্যায়ে বিবর্তিত হয়ে এসেছে মানুষ। বড়ো ব্রেইন ডেভেলপের বিবর্তনের পেছনের ক্রেডিটটাও মাংসের। যে-কোনো প্রাণী হত্যা বর্বর, শিওর। আমরা আগে যতটা জানতাম রিসেন্ট গবেষণায় বোঝা গেছে তারা এরচেয়ে বেশ বুদ্ধিমান। তাতে আসলে তেমন কিছুই যায় আসে না। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত This planet just can’t support billions of meat eaters. অর্থাৎ, পৃথিবী জাস্ট শত শত কোটি মাংসাশী প্রাণীর আবাসস্থল হওয়ার যোগ্য না। মোবাইল ফোনে অ্যাপ ইনস্টল করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েননি? “This app is not supported by your device” বা এই টাইপের ওয়ার্নিং দেখেননি? এটাও একই জিনিস বলতে পারেন। হ্যাঁ, ঘুরে ফিরে একই সমস্যা। মানুষ বেশি হয়ে গেছে পৃথিবীতে]
তাছাড়াও, গাছ লাগানো ব্যাপারটা একটু ওভাররেটেড গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা কার্বন নিঃসারন কমানোর ক্ষেত্রে। গাছ অতটাও ইনেফিসিয়েন্ট না, বেশিরভাগ কার্বন শোষণ ঘটে সমুদ্রের অ্যালগি দ্বারা। আমরা অনেক জায়গায় দেখতে পাই অ্যামাজন নাকি পৃথিবীর ফুসফুস। না, অ্যামাজনের গাছগুলোর তৈরি অক্সিজেনের মোটামুটি প্রায় পুরোটা সেখানকার প্রাণীদেরই লাগে। যদিও উদ্ভিদের অনেক অনেক প্রয়োজন অন্যান্য ক্ষেত্রে (যেমন আদ্রতা বজায় রাখতে। হয়তো খেয়াল করেছেন, প্রচণ্ড গরম কিন্তু ঘাম হচ্ছে না, ঠোট ফাটছে। কারণ আদ্রতা কম)
এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে A Life in our Planet ডকুমেন্টারিতে। হাইলি রেকমেন্ডেড। সবাইকে দেখতে বলব।
পার্সোনালি মাংস খাওয়া ছাড়াটা বেশ কষ্টকর আমার পক্ষে। তাই অপেক্ষা করছি “প্ল্যান্ট বেইজড মিট” বাজারে নামার। ল্যাবে তৈরি মাংসের কার্বন ফুটপ্রিন্টও কম হওয়ার কথা অবশ্য, সেটাও ভালো চয়েজ।
এসব ব্যাখ্যা করে প্লাস মাংসের গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর পেছনে ভূমিকা ব্যাখ্যা করে ভালো একটা ভিডিয়ো: Feeding Bill Gates fake Burger [https://www.youtube.com/watch?v=-k-V3ESHcfA]
কমেন্টের কিছু কমন প্রশ্নের উত্তরঃ
১) হঠাৎ মাংস খাওয়া বন্ধ করলে পরিবেশে প্রানী বেড়ে যাবেনা?
না। স্তন্যপায়ীদের বায়োম্যাসের দিক দিয়ে ৯৬% ম্যামালই শুধু আমাদের খাওয়ার জন্য পালন করা, এগুলো নাই হয়ে গেলে অনেক উপকার হবে। সেখানে প্রাকৃতিক ভাবে যেসব প্রানী থাকবে সেগুলোই এনাফ। আর এদের খাওয়াতে যে পরিমানে জমি লাগে সে জমিতেও গাছ লাগানো যাবে, বা এমনিতেই গাছপালা উঠবে। https://www.ecowatch.com/biomass-humans-animals...
ভেবে দেখুন এতগুলো প্রানী না লাগলে কত কার্বন, মিথেন এমিশন আর এদের দাড়া হিট তৈরি কমে যাবে। সাথে বিশ্ব খাদ্যের পরিমানও অনেকগুন বাড়বে।
২) মাংস বাদ দিয়ে মাছ খেলে হবে কী?
হ্যা হবে। অনেকেই দিনদিন পেসকাটারিয়ান (মাছ খায়, মাংস না) এ পরিনত হচ্ছে দিনদিন। মাছের কার্বন পানিতে দ্রবীভূত হয়ে আবার ওশান পলিউশন সৃস্টি করে, সেখানেও সমস্যা। তবে আপাতত এটা একটা ভালো উদ্যোগ হতে পারে।
পরিসংখ্যানটি: https://www.linkedin.com/pulse/what-reduces-our-personal-co2-footprint-we-have-clue-frank-bilstein/
[1] https://en.wikipedia.org/wiki/Plastic_pollution
[2] https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_countries_by_airline_passengers
[3] https://en.wikipedia.org/wiki/Aviation_fuel
[4] https://www.foodnavigator.com/Article/2015/04/27/Jeremy-Rifkin-Meat-is-the-most-inefficient-way-of-feeding-the-human-race
A Life in Our Planet review: https://www.facebook.com/groups/bcb.science/permalink/3549043241845986/?__cft__[0]=AZXP1er70MNZDfzOUvPA6WX5n5GB8jOVLmy7YPPxRFUg3xIn3nG2WbJC47uc2WOiREYEI7pilo7WCqLdp87mRm6mRthpT6POXJEYGGoJ2N7glYOwBfUsR0IucCB-HbUhVjQtQ4U_r9DEPLAod9KAUyu1&__tn__=%2CO%2CP-R
সমুদ্র জিৎ সাহা,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।