লেখকঃ তাজউদ্দিন আহম্মদ
নাহ,কিছুতেই মানা যাবে না।
এত বড় অপমান!
মানুষ হয়ে আমাকে কিনা মানুষ হওয়ার প্রমাণ দিতে হবে!
টাকা দিয়ে মেগাবাইট কিনে কি এই হেনস্তার জন্য ইন্টারনেট চালাই?
ওয়েট,থামেন।
আপনি যেটাকে অর্থহীন অপমান ভাবছেন,সেটার আসলে গুরুত্ব আছে।
কিসের গুরুত্ব?
ক্যাপচার কথা বলছেন?
ইয়েস,ইন্টারনেটে অনেক সময় যে বিরক্তিকর একটা টাস্ক দেয়া হয় আপনাকে,"I'm not a robot",এটা প্রুফ করার,সেটার কথাই বলছেন তো!
নানা ছবি,অক্ষর,সংখ্যা এগুলো মিলিয়ে সে আপনাকে প্রমাণ করতে হয় আপনি মানুষ,রোবট না,সেটার কথা তো বলছেন,তাই না!
তাহলে শুনুন,দাদা।
এটার প্রয়োজনীয়তা টা কি,এটার ইতিহাস কি,সেটা জেনে আসি।
ইংরেজিতে Captcha শব্দটির পূর্ণরুপ হলো Completely Automated Public Turing test to tell Computers and Humans Apart। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষ এবং কম্পিউটার এর মধ্যে পার্থক্য যাচাইকরণের প্রক্রিয়াকে বলা হয় ক্যাপচা।
এই যে নানা সাইটে আপনি ঘুরে বেড়ান,নানা ধরণের কাজ করেন,এগুলো কি আপনি করছেন নাকি কোনো রোবট করছে সেটাই যাচাই করা হয় এটা দ্বারা।
কিভাবে এলো এই ক্যাপচা?
ইন্টারনেট যুগের প্রথম দিকে স্প্যামাররা বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্ট প্রোগ্রাম দিয়ে নানা অপরাধমূলক কাজ করে বেড়াত।
এই ধরুন,কোনো ইন্টারেস্টিং মুভি রিলিজ হতে চলেছে।মানুষ খুব উৎসাহী সেই মুভি দেখার জন্য।তো একজন স্প্যামার কি করল,সে একটা শক্তিশালী বট প্রোগ্রাম ব্যবহার করে অনেকগুলো টিকিট এক রাতেই কিনে নিল।তার উদ্দেশ্য হলো টিকিটগুলো কালোবাজারিতে বেশি দামে বিক্রি করে সে প্রচুর টাকা আয় করবে।একা একা তো আর বসে বসে এই বোরিং কাজ করতে পারবে না,তাই সে বট ব্যবহার করল।
আবার ধরুন,কোনো এক ওয়েবসাইটে একটা অনলাইন জরিপের আয়োজন করা হয়েছে।একদল লোক চায় নির্দিষ্ট একটা পক্ষকে জেতাতে।তাই তারা কি করল,একটি বুদ্ধিমান প্রোগ্রাম ব্যবহার করে কয়েক হাজার ভোট সেখানে দিয়ে দিল।ব্যস!
ইন্টেলিজেন্ট প্রোগ্রাম ব্যবহার করে এই ধরণের অসৎ কাজ আটকানোর জন্যই এই ক্যাপচার জন্ম হয়েছে।
ক্যাপচা সর্বপ্রথম কে বা কারা ব্যবহার করেন,সেটা নিয়েও কন্ট্রোভার্সি রয়েছে।
দুটি দল ক্যাপচাকে তাদের নিজেদের সৃষ্টিকর্ম বলে দাবি করে।প্রথম দলটি হলো মার্টিন অ্যবাডি,কৃষ্ণ ভরত এবং আন্দ্রেই ব্রোডার এর।ইনারা ১৯৯৭ সালের দিকে Alvista তে তাদের সার্চ ইঞ্জিনে বট প্রোগ্রাম দ্বারা স্প্যাম ইউআরএল যুক্ত করাকে আটকানোর জন্য ক্যাপচা ব্যবহার করেন।
একইসাথে লুইস ভিন অ্যান,ম্যানুয়েল ব্লুম ও নিকোলাস হপারের অন্য একটি টিমও দাবি করেন যে তারাই প্রথম গ্রাফিক্যাল ক্যাপচা ব্যবহার করেছিলেন।দুটি টিমই যথাক্রমে ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে তাদের পেটেন্ট পাবলিশ করেন।অনেক জায়গায় লুইস ভিন অ্যানকেই আধুনিক ক্যাপচার জনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর পর থেকে বিভিন্ন সাইটে বট প্রোগ্রাম আটকানোর জন্য বহুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে ক্যাপচা পদ্ধতি।
ক্যাপচা কিভাবে কাজ করে?
ক্যাপচায় সাধারণত ব্যবহারকারী কিছু বিশেষ ছবি,অক্ষর সংখ্যা আইডেন্টিফাই করতে দেয়া হয়।অক্ষরগুলো সাধারণত আকাবাঁকা থাকে এবং ছবিগুলোতেও অনেকগুলো বস্তু থেকে একটা সিঙ্গেল অবজেক্ট আইডেন্টিফাই করতে হয়।যেটা বট প্রোগ্রাম সহজে বুঝতে পারে না কিন্তু একজন মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। এভাবেই ক্যাপচার সাহায্যে বট প্রোগ্রাম দ্বারা অপরাধ সংগঠিত করাকে আটকানো হয়।
ক্যাপচার নানা ধরণের প্রকারভেদ রয়েছে।
🌓টেক্সট ক্যাপচাঃ-
টেক্সট ক্যাপচাতে সাধারণত কিছু আঁকাবাকা অক্ষর দেয়া থাকে।যা একজন মানুষ বুঝতে পারে।এই অক্ষরগুলো একটি নির্দিষ্ট ঘরে লিখে সাবমিট করতে হয় কিংবা I'm not a robot লেখাযুক্ত বক্সে টিক চিহ্ন দিতে হয়।অক্ষরগুলো সাধারণত フ𝔣ꅐ卄乂-এধরণের নানা ফন্টের আঁকাবাকা অক্ষর হয়।
🌓গাণিতিক অপারেশনঃ-
এ ধরণের ক্যাপচায় সাধারণত কোনো গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে দেয়া হয়।যেমন 2*2=? বা 3+5×6=? ইত্যাদি দেয়া থাকে।সমস্যাটি সমাধান করে এর নির্দিষ্ট উত্তর যথাস্থানে লিখে ক্যাপচা পূরণ করতে হয়।
🌓সাউন্ড আইডেন্টিফিকেশনঃ-
এ ধরণের ক্যাপচায় আপনাকে শব্দ শোনানোর ব্যবস্থা থাকবে।শব্দটি শুনে তা সঠিক স্পেলিং সহকারে নির্দিষ্ট স্থানে লিখে ঘর পূরণ করতে হয়।
🌓হানিপটঃ-
আধুনিক ক্যাপচাগুলোর মধ্যে অন্যতম নিরাপদ ও উন্নত ক্যাপচা হলো হানিপট।
আগের তিনটি ক্যাপচা পদ্ধতিকে ওভারকাম করার মত বটও তৈরি হয়েছে। কিন্তু ক্যাপচা পূরণ করার মত ইন্টেলিজেন্ট বটও এখানে এসে ধরা খেয়ে যায়।
এ পদ্ধতিতে কিছু দৃশ্যমান শূণ্যস্থানের পাশাপাশি কিছু অদৃশ্য শূণ্যস্থানও দেয়া থাকে।কোনো মানুষ যখন ক্যাপচাটি পূরণ করবেন তিনি শুধুমাত্র দৃশ্যমান শূণ্যস্থানগুলো পূরণ করবেন কারণ তার চোখে অদৃশ্য শূণ্যস্থানগুলো ধরা পড়ে না। কিন্তু একটি বট অদৃশ্য শূন্যস্থানগুলোও পূরণ করে ফেলে কারণ সে সেগুলোকে চিহ্নিত করতে পারে।ফলে বট ধরা পড়ে যায়।
🌓পিকচার আইডেন্টিফিক্যাশনঃ-
এ ধরণের ক্যাপচাই বর্তমানে আমাদের বেশি চোখে পড়ে।এতে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক কিছু ছবি দেয়া হয়।অনেকগুলো ছবি থেকে সেই বিষয়সম্পর্কিত ছবি থেকে সঠিক ছবিগুলো বাছাই করতে দেয়া হয়।যেমন আপনাকে ছয়টি ছবি দেয়া হলো।এখানে তিনটি মোটরসাইকেলের ছবি রয়েছে এবং তিনটি ভিন্ন কোনো বস্তুর ছবি রয়েছে।আপনাকে সঠিক ছবি অর্থাৎ মোটরসাইকেলের ছবিগুলো বেছে নিতে হবে।ভুল কোনো ছবি গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ধরণের ক্যাপচাকে আরো নিরাপদ করার জন্য খুব ছোট অবজেক্ট বা একটি অবজেক্টকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে শুধু নির্দিষ্ট কিছু অংশ বেছে নিতে বলা হয়।যেমন একটি রোড থেকে শুধুমাত্র ক্রসওয়াকের ছবিগুলো বেছে নিতে দেয়া হয়।অনেক সময় খুব ছোট ও লো কোয়ালিটির ছবি দেয়া হয় যেটা বট তো বটেই, মানুষেরই বুঝতে অসুবিধা হয়।তাই এটি মোটামুটি একটি সুবিধাজনক ও আধুনিক ক্যাপচা পদ্ধতি।
🌓নো ক্যাপচা রিক্যাপচাঃ-
এটি গুগল দ্বারা উদ্ভাবনকৃত খুবই অত্যাধুনিক একটি ক্যাপচাপদ্ধতি। এক্ষেত্রে কোনো আলাদা টাস্ক নয় বরং শুধু I am not a robot লেখাযুক্ত একটি সাধারণ চেকবক্স থাকে।কিন্তু এতেই রয়েছে এর কেরামতি।কোনো বট সাধারণ চেকবক্সের মাঝখানে পার্ফেক্টলি ক্লিক করে যেটা মানুষের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়।তাই এই পদ্ধতির সাহায্যে খুব সুনিপূণভাবে বটের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়।
🌓ইনভিজিবন রিক্যাপচাঃ-
এটি আরো অত্যাধুনিক একটা ক্যাপচা পদ্ধতি।এ পদ্ধতিতে ব্যবহারকারীকে কিছু আইডেন্টিফাই করতে হয় না,বরং ক্যাপচাই ব্যবহারকারীকে চিহ্নিত করে।কোনো সাইটের কোণায় বা নির্দিষ্ট স্থানে ছোট করে এই ক্যাপচার একটি লোগো থাকে।এর কাজ হলো ব্যবহারকারীর গতিবিধির উপর নজর রাখা।অর্থাৎ এটি এমনভাবে প্রোগ্রাম করা,যাতে ওয়েবসাইট নিজেই বটকে পাকড়াও করতে পারে।
🌓সুইট রিক্যাপচাঃ-
এ ক্যাপচা ব্যবস্থা অনেকটা পিকচার পাজল মেলানোর মত।আপনাকে একটি ছবির কিছু এলোমেলো অংশ দেয়া হবে,সেখান থেকে অংশগুলো নাড়াচাড়া করে আপনাকে ছবিটি মেলাতে হবে।
মজার না?এটিও একটি উন্নত ও আধুনিক ক্যাপচা।
তাহলে বুঝলেন তো দাদা?যে জিনিসটাতে আপনি এত্ত বিরক্ত হন,সেটার প্রয়োজনীয়তা কতখানি?এই বোরিং ক্যাপচাই অনেক ওয়েবসাইটকে স্প্যামারদের হাত থেকে রক্ষা করে। আটকে দেয় অনেক অপরাধ।যদিও স্প্যামাররাও আজকাল দুর্ধর্ষ হয়ে উঠছে। এরা ক্যাপচা সলভ করতে পারে এমন ইন্টেলিজেন্ট বট প্রোগ্রাম তৈরি করছে। যদিও হানিবট,পিকচার আইডেন্টিফিক্যাশন,নো ক্যাপচা রিক্যাপচা,ইনভিবিজন ক্যাপচা,সুইট ক্যাপচা খুবই নিরাপদ এবং উন্নত ক্যাপচা।এসব বিরক্তিকর ক্যাপচাই বটকে আটকিয়ে আপনার ওয়েবসাইটকে নিরাপদ রাখে।
তাহলে দাদা,আজকের পর আশাকরি আর বিরক্তি থাকবে না আপনার। হাসিমুখে ক্যাপচাগুলো পূরণ করবেন আর এর উপকারের কথা ভাববেন।
হ্যাপি ব্রাউজিং!
References:
https://www.pandasecurity.com/en/mediacenter/panda-security/what-is-captcha/
https://en.m.wikipedia.org/wiki/CAPTCHA
https://dynomapper.com/blog/514-online-captcha-solving-services-and-available-captcha-types
তাজউদ্দিন আহম্মদ,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।