Ads Area

advertise

অন্তর্মুখীতা (Avoidant Personality Disorder)

0
লেখকঃ তাজউদ্দিন আহম্মদ


মানুষ সামাজিক জীব।একা একা বেশিরভাগ কাজ সে সম্পাদন করতে পারে না। সমাজে সবার সাথে খাপ খাইয়ে,তাল মিলিয়ে চলতে হয়।কোনো না কোনো কাজে তাকে অন্যের সাহায্য নিতেই হয়। অন্যের সাথে তাকে মিশতেই হয়।
এতেই তার দৈনন্দিন কার্যাবলীগুলো সুন্দর রুপে সম্পাদিত হয়।।

কিন্তু এমন কিছু লোক রয়েছেন,যারা একা একা থাকতে বেশি পছন্দ করেন। সনাজে অন্যান্য মানুষের সাথে তারা খুব কম মিশতে চান,বা মিশতে ভয় পান। তারা সামাজিক মেলামেশা এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন,কোনো কারণে তাদের সামজিক কোনো কাজে যোগদান করতে হলে তারা সেই কাজে স্বচ্ছন্দবোধ করেন না।তাদের অস্বস্তি হয়,কিংবা তারা ভয় পান,সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চান।
এদের অনেককে আমরা সাধারণ ভাষায় ইনট্রোভার্ট অন্তর্মুখী বলে থাকি।

মনোবিজ্ঞানে এ ধরণের অন্তর্মুখীতাকে একটি মানসিক সমস্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
একে বলা হয়-

Avoidant Personality Disorder.

অর্থাৎ এ সমস্যায় আক্রান্ন্ত ব্যক্তিরা মানুষকে avoid করতে পছন্দ করেন।হতে পারে তারা ভয় পান,হতে পারে তারা লজ্জা বোধ করেন অথবা তারা বিরক্ত বোধ করেন।তাদের কেউ কেউ সোশ্যাল ফোবিয়া বা সোশ্যাল এনজাইটিতে আক্রান্ত হন,অর্থাৎ সোশ্যাল সিচুয়েশনে ভয় পান।

উদাহরণস্বরুপ,
🏀আপনার গানের গলা খুবই সুন্দর,আপনি খুব সুন্দর গান গাইতে পারেন।কিন্তু আপনাকে যখন কারো সামনে গাইতে বলা হয়,আপনার মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোয় না।
🏀আপনি একজন ভালো শিক্ষার্থী, পরীক্ষার খাতার গড়গড় করে সব বিস্যে উগরে দেন।কিন্তু শিক্ষক মহোদয় যখন ক্লাসে সবার সামনে আপনাকে কোনো প্রশ্ন করেন তখন আপনি তার উত্তর দিতে ভয় পান,আপনার পাঁ কাপে।সবার সামনে আপনি কিছুই বলতে পারেন না।
🏀আপনি নিজে নিজে অনেক কবিতা লেখেন।সেগুলো সুন্দরও হয়,কিন্তু আপনি সেগুলোকে প্রকাশ করেন না। আপনি ভয় পান,লোকে কি বলবে?
🏀আপনি খুবই সুদর্শন,কিন্তু কোনো অনুষ্ঠানে আপনি যেতে চান না।সংকোচ বোধ করেন।এত লোকের মধ্যে আমাকে কেমন দেখাবে?

এসব সমস্যা যখন আপনার জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত করবে,তখন বুঝতে হবে আপনি একজন Avoidant.

প্রকারভেদঃ
Avoidant personality disorder এর এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে।আমরা আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষই দেখতে পাই,যারা "পাছে লোকে কিছু বলে" এই মতাদর্শ অনুসরণ করেন।তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে চান।
চলুন অন্তর্মুখীদের প্রকারভেদ জেনে নেই।

🌓আত্মবিশ্বাসহীনঃ-
এসব ব্যক্তিদের আত্মবিশ্বাস একদম তলানিতে থাকে।এরা প্রচন্ড রকমের নৈরাশ্যবাদী হন।তৃয়ীয় উদাহরণের ব্যক্তিদের মতই এদের সৃজনশীলতা রয়েছে,কিন্তু তারা তা লোকসমক্ষে প্রকাশ করতে ভয় পান।তারা নিজের মনেই নিজের সৃজনশীলতাকে চেপে রাখেন।
এরা কামিনী রায়ের বিখ্যাত সেই কবিতা "পাছে লোকে কিছু বলে" র চরিত্রের মতই লোক-সমালোচনার ভয়ে সামজিকতা এড়িয়ে চলেন।অন্য দশজনের মধ্যে লোকে তাকে কি বলবে,এই চিন্তায় তারা তটস্থ থাকেন।এসব ব্যক্তিরা সাধারণত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা সমাবেশ এড়িয়ে চলেন।

🌓লাজুকঃ-
এই ধরণের ব্যক্তিরা সরাসরি মানুষের সাথে কথা বলতে লজ্জা পান।কোনো বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে এদের লজ্জার মাত্রা সর্বোচ্চ হতে পারে।যেমন,এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তির সামনেই যেতে পারেন না। তারা প্রচুর পরিমাণে লজ্জা পান।আবার অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করতে চান না, বা যোগদান করলেও কোনো মুখ্য ভূমিকায় থাকতে চান না।তারা লজ্জা পান।

🌓আত্মকেন্দ্রিকঃ-
অনেকেই রয়েছেন যারা এতদুর পর্যন্ত লেখাটি পড়ে এসে নিজেদের মাঝে এগুলোর কোনো উপস্থিতি খুঁজে পান নি। তারা অনেকেই এ অংশের সাথে নিজের মিল খুঁজে পাবেন।হ্যা, Avoidant দের মধ্যে এই শ্রেণির লোকই বেশি খুঁজে পাওয়া যায়।এ ধরনের ব্যক্তিরা নিজেকে সর্বোচ্চ উপরে স্থান দেন।তারা অন্যর উপর নির্ভরশীলতা কিংবা অন্যকেন্দ্রিকতা একেবারেই পছন্দ করেন না।তারা স্বতন্ত্র থাকতে ভালোবাসেন।তারা প্রয়োজন ব্যতীত অন্যের সাথে মেলা-মেশা পছন্দ করেন না।এজন্য ব্যক্তিজীবনের এদের বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা থাকে খুবই সীমিত।।
অর্থাথ এরা সংসারের প্রতি অনেকটা বিরাগভাজন হয়ে থাকেন।এসব ব্যক্তিরা অনেক রিস্কি কাজেও কারো সাহায্য নিতে পছন্দ করেন না।ফলে একা একা চলতে গিয়ে অনেক সময় ভয়ানক বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তাদের। 

🌓ভীতুঃ-
এই তালিকার সর্বশেষ ক্যাটাগরির ব্যক্তিরা একদম বেচারা প্রকৃতির।এনারা ভীষণ ভীতু হন।ভয়ের কারণেই মূলত এরা 
অনেক কিছু এড়িয়ে চলেন।কোনো সামাজিক সমাগমে নিজেকে জাহির করতে এরা ভয় পান।এদের ভয় সাধারণত বিশেষ ক্ষেত্রে ট্রিগার হন।এরা বিশেষ কোনো জায়গায় বা বিশেষ কোনো ব্যক্তির সামনে কথা বলতে ভয় পান। যেমন পুরো শ্রেণির সামবে পড়া বলতে ভয় পাওয়া,কোনো সমাবেশে সবার সামনে বক্তব্য দিতে ভয় পাওয়া ইত্যাদি।

উপরোক্ত লক্ষণগুলো কিন্তু কোনো সাধারণ সুস্থব্যক্তির ক্ষেত্রেও অল্প অল্প দেখা দিতে পারে।তবে এসব লক্ষণগুলো কারো জীবনে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করলে,তার কাজকর্মকে ব্যাহত করলে নিঃসন্দেহে তিনি এই সমস্যাগুলোর আওতায় পড়েন।

কারণঃ
এ ধরণের সমস্যার পেছনে কোনো নির্দিষ্ট কারণ থাকতে পারে,আবার নাও থাকতে পারে।কেউ কেউ বংশগতভাবেই এমন হন।একটু প্রাপ্তবয়স্ক হলেই তাদের এসব বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।
এ সমস্যা তৈরি হওয়ার কিছু পরোক্ষ কারণ থাকতে পারে।যেমন ব্যক্তিক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা,নিগৃহীতা ইত্যাদি।কোনো ব্যক্তি জীবনের কোনো এক ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থ হয়ে নিজেকে আড়াল করে ফেলতে পারেন।আর কোনো কাজ সবার সামনে করে দেখাতে ভরসা পান না।
শারিরীক প্রতিবন্ধকতার কারণেও কোনো ব্যক্তির এ ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে।যেমন দুর্ঘটবায় পঙ্গু হয়ে বন্ধুবান্ধবের সামনে না আসা,কোনো বিশেষ রোগ যেমন শ্বেতি,কুষ্ঠ ইত্যাদির কারণে নিজেকে আড়াল রাখা ইত্যাদি।
কেউ কেউ কোনো ঘটনায় তীব্র আঘাত পেলে নিজেকে অন্য সবার কাছ থেকে আড়াল করতে শুরু করেন।। পারিবারিকভাবে একাকী বড় হলেও শৈশব থেকে কোনো ব্যক্তি Avoidant হয়ে যেতে পারেন।

প্রতিকারঃ
Avoidant রা সাধারণত নিজেই তাদের সমস্যার কথা বুঝতে পারেন।এক্ষেত্রে তারা এই সমস্যা গুরুতর আকারে দেখা দিলে সাইক্রিয়াটিক কনসালটেন্সির প্রয়োজন পড়ে।এ সমস্যা দূর করার জন্য সোশ্যাল স্কিলস থেরাপি,কগনিটিভ থেরাপি,টকিং থেরাপি ও গ্রুপ থেরাপিসহ একাধিক চিকিৎসা রয়েছে।এসব থেরাপিগুলোতে তাকে সোশ্যাল এক্টিভিটি শেখানো হয়,সোশ্যাল মাইন্ডেড করে তোলা হয়।তবে কিছু Avoidant এতটাই Avoidant হন যে তারা চিকিৎসক ও চিকিৎসাপদ্ধতিকে পর্যন্ত avoid করতে শুরু করেন।তাই সর্বপ্রথমে আগে চিকিৎসার উপর তাদের বিশ্বাস অর্জন করানো জরুরি হয়ে পড়ে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যক্তিই তাদের মানসিক সমস্যাবলির প্রতি অত্যধিক অসচেতন থাকেন।অনেক সময় তারা বুঝতে পারেন না বা বুঝলেও কোনো প্রকার চিকিৎসা বা পরামর্শের প্রয়োজনবোধ করেন না।তাদের আশেপাশের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাও সমস্যা খেয়াল করলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না।ফলে মানসিক সমস্যা আরো বেড়ে যায়।এমতাবস্থায় সর্বোচ্চ ভূমিকা হবে তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের,বিশেষ করে পরিবারের লোকেদের।পীড়িত ব্যক্তিকে যথেস্ট পরিমাণে মানসিক সহযোগিতা ও সুপরামর্শ দিলে সমস্যা অনেকটাই কেটে যায়।এটা সকল সমস্যার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
Avoidant দের সোশ্যালি একটিভ করে তুলতে হবে,তাদেরকে মিলেমিশে থাকার গুরুত্ব বোঝাতে হবে।

সঙ্গীবিহীন জীবন বড়ই একঘেয়ে।কিন্তু Avoidant যেন তা বুঝতে চান না।নিজের একঘেয়েমিতার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নেন তারা।তাতে তাদের নানামুখী সমস্যায়ও পড়তে হয়।আসলে সকল কাজই তো একা একা করা সম্ভব নয়।
তাই আসুন,সবাই মিলে মিলে হাসিখুশি জীবনযাপন করি।নিজেকে যেন Avoidant এ পরিণত না করি আমরা। "দশের লাঠি একের বোঝা"-এই বাক্য যেন সবারই স্মরণে থাকে সবসময়।

সোর্সঃ
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Avoidant_personality_disorder

https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/9761-avoidant-personality-disorder

https://www.webmd.com/mental-health/avoidant-personality-disorders

তাজউদ্দিন আহম্মদ,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad

Below Post Ad

advertise