লেখকঃ জাভেদ ইকবাল
বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে মানুষ মারা যেতে পারে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, খালি পেটে যদি কোন শিশু অনেক লিচু খায়, তাহলে এটা ঘটতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এটার সম্ভাবনা খুব কম। বাংলাদেশে রামবুটান পাওয়া যায় আজকাল। সেটা এবং লিচু পরিবারের আরো কিছু ফল আছে যেগুলি খেলেও এই বিপদ হতে পারে।
প্রশ্ন: তাহলে কি লিচু খাওয়া নিরাপদ না?
উত্তর: নিয়মিত খাবারের পর পাকা লিচু খাওয়া নিরাপদ, অন্তত এই লেখায় বিবৃত রোগের জন্য।
প্রশ্ন: কেন এটা ঘটে? শুধু শিশুদের কথা বলা হচ্ছে কেন?
উত্তর: ছোট উত্তর হচ্ছে বিষ। লম্বা উত্তরের জন্য লেখাটা পড়তে হবে। শিশুদের শরীর ছোট, তাই অল্পতেই বিপদজনক হয়ে যায়।
লিচু খেলে কীভাবে মৃত্যু ঘটতে পারে, তা জানার আগে ডায়াবেটিস, ইনসুলিন আর রক্তের চিনির ব্যাপারে একটু জেনে নেই।
রক্তের চিনি সরাসরি আমাদের কোষে ঢুকতে পারে না। মনে করুন, কোষের দেয়ালে একটা তালাবদ্ধ বিশেষ রকমের দরজা আছে, আর শুধুমাত্র এই দরজা দিয়েই চিনি কোষের ভেতরে ঢুকতে পারে। এই দরজাটার তালা খোলার চাবির নাম ইনসুলিন নামে একটা হরমোন। আমাদের প্যানক্রিয়াস বা অগ্নাশয় ইনসুলিন তৈরি করে। ইনসুলিন না পেলে খাবার থেকে হজম প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া চিনি কোষের ভেতরে ঢুকতে পারে না। (১) যাদের ডায়াবেটিস হয়, তাদের ইনসুলিন কম থাকে, তখন রক্তে চিনি থাকলেও সেটা কোষে ঢুকতে পারে না। তাই রক্তে চিনির পরিমান (blood sugar) বেড়ে যায়, ও সেটা মেপে ডায়াবেটিস হয়েছে কি না বোঝা যায়।
বিকাল পাঁচটা বাজে, দবীরউদ্দিন সকাল থেকে কিছু খান নাই। যেহেতু পেটে খাবার পড়ে নাই, তার রক্তে চিনির পরিমান কম। কিন্তু নার্স এসে তার রক্তে চিনির পরিমান না মেপেই তাকে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দিয়ে দিল। বাড়তি ইনসুলিন পেয়ে সব কোষের চিনি-দরজা খুলে গেল, কোষগুলি সব চিনি হজম করে নিল। তার কিছু সময় পরে কোষগুলি আর চিনি পাবে না, এবং জ্বালানীর অভাবে তারা একে একে কাজ বন্ধ করে দেয়া শুরু করবে। তখন দুর্বল লাগবে, মাথা ঘোরাবে, ফিট হয়ে যেতে পারে। চিনি এই রকম অস্বাভাবিক রকম কমে যাওয়াকে বলা হয় হাইপোগ্লাইসেমিয়া (হাইপো = নিচু, গ্লাইকো = যা থেকে চিনি তৈরি হয়) বা ডায়াবেটিক শক। হাইপোগ্লাইসেমিয়া অন্য কারনেও হতে পারে, যেমন প্রচুর ব্যায়াম করলে, অথবা না খেলে, সব চিনি শেষ হয়ে গিয়ে স্বল্পকালীন হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। আবার দবীরউদ্দিন ঠিকমত খাওয়ার পর তাকে ভুলে ইনসুলিনের বেশি ডোজ দিয়ে দিলে, বা ভুল সময়ে দিলেও তার হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। সেটার চিকিৎসা হতে পারে সাথে সাথে চিনি বা গ্লুকোজ খাওয়ানো।
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার সবচাইতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে মস্তিষ্কে। জ্বালানী (চিনি) না পেয়ে মস্তিষ্কে এক ধরণের অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি হবে, ক্যালসিয়ামের পরিমান বেড়ে যাবে, এবং নিউরনের দেয়াল ভেঙ্গে যাবে। যথেষ্ট পরিমান নিউরন মারা যাওয়া মানে ব্রেইন ড্যামেজ, এবং এক সময় মৃত্যু। (২)
লিচুতে মৃত্যুর কারন ব্যখ্যাতে হাইপোগ্লাইসেমিয়া নিয়ে এত লম্বা ভূমিকা করার কারন, লিচুতে মিথাইলিন সাইক্লোপ্রপাইল গ্লাইসিন methylenecylopropylglycine (MCPG) নামে একটা অ্যামিনো অ্যাসিড আছে। এটার খুব কাছের আত্মীয় “হাইপোগ্লাইসিন এ” (hypoglycin A)। এখানেও হাইপো আর গ্লাইসিন। তাহলে এই অ্যামিনো অ্যাসিডটার কাজ কী হতে পারে? যদি নাম থেকে ভেবে থাকেন এটার সাথে চিনির পরিমান কমানোর কোন ব্যাপার আছে, তাহলে আপনি সঠিক। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে MCPG বা hypoglycin A দেখা যেতে পারে। দুইটা একই ভাবে কাজ করে, তাই দুইটাকে এই লেখায় সমার্থক ধরা হচ্ছে।
লিচুর বিচিতে MCPGর পরিমান অনেক বেশি। কাঁচা লিচুতেও পরিমান বেশি। লিচু যত পাকতে থাকে, এটার পরিমান কমতে থাকে। ঠিক দবীরউদ্দিনের ইনসুলিনের মতই, এটা রক্তে চিনির পরিমান কমিয়ে দেয়। সুতরাং কেউ যদি খালি পেটে অনেক অনেক কাঁচাপাকা লিচু খায়, তাহলে তার হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।
লিচুর সিজনে, যখন গাছের নিচে মাটিতে অনেক লিচু পড়ে থাকে, বাচ্চারা সেগুলি কুড়িয়ে খায়। অনেক দরিদ্র ঘরের বাচ্চা সারাদিন আর কিছু খায় না, লিচু খেয়েই পেট ভরাট করে ফেলে। সব লিচু যদি ঠিকভাবে না পেকে থাকে, তাহলে সেগুলিতে এমসিপিজি-র পরিমান আরো বেশি থাকে। খালি পেট, শুরুতেই রক্তে চিনি কম ছিল। এখন লিচু হজম হয়ে রক্তে নতুন করে চিনি ঢুকল ঠিকই, কিন্তু বিশাল পরিমান এমসিপিজিও ঢুকল। ফলাফল—রক্তের সব চিনি দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।
মস্তিষ্কের প্রদাহ বা ইনফ্লেমেশনকে বলা হয় এনসেফালাইটিস। এটার অনেক কারন হতে পারে, তার মধ্যে আছে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, বিষ, ইত্যাদি। কয়েক ধরনের মশার কামড়েও এটা ছড়াতে পারে।
২০১২-র ১৬ জুন দিনাজপুরের একজন ডাক্তার IEDCRকে (কোভিডের কারনে যেটার নাম আমরা এখন সবাই জানি) জানালেন, তার এলাকায় প্রচুর বাচ্চার এনসেফালাইটিস হচ্ছে। আইইসিডিআর ও আইসিডিডিআরবি, যেটাকে আমরা কলেরা হসপিটাল বলে বেশি চিনি, ডাক্তার, মহামারী বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী দের সমন্বয়ে তৈরি একটা টিম পাঠায় সেই এলাকায়, এবং তারা ২০১২-র জুন ১৭ থেকে সেপ্টেম্বর ২০ পর্যন্ত উপাত্ত সংগ্রহ করেন। এই সময়ে ১-১২ বছর বয়সী যত বাচ্চা দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অজ্ঞান বা খিঁচুনি নিয়ে ৩১ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ভর্তি হয়েছিল, তাদের রেকর্ড নিরীক্ষা করেন, এবং সমাজবিজ্ঞানীরা তাদের বাসায় গিয়ে উপাত্ত নেন।
অসুখের শুরু থেকে অজ্ঞান হওয়ার গড় সময় দেখা গেল আড়াই ঘন্টা। যাদের মৃত্যু হয়েছে, সেটাও খুব তাড়াতাড়ি হয়েছে, তাই বিজ্ঞানীরা ইনফেকশন (ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি) হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম ধরে নিলেন, এবং ধারণা করলেন, কোন বিষের কারনে এটা হচ্ছে। তারা এই বাচ্চারা কোথায় গিয়েছে, সেখানে কী সার ও কীটনাশক দেয়া হয়েছে, তারা কী খেয়েছে, সেগুলির খোঁজ নিলেন। (৩)
দেখা গেল, এই সময়টা লিচু ধরার সময়, এবং বাচ্চাদের অনেকেই লিচু বাগানে গিয়েছিল। সুতরাং তারা এবার লিচুর দিকে নজর দিলেন। ভারতের কিছু ঘটনা থেকে তারা লিচু ও হাইপোগ্লাইসিনের সম্পর্ক জানতেন। বাংলাদেশের লিচু বাগানে তারা এন্ডসালফান নামে বিশ্বের ৮০টা দেশে নিষিদ্ধ একটা কীটনাশকের ব্যবহার দেখলেন, এবং লেবেল-বিহীন আরো অনেক কীটনাশক দেখতে পেলেন।
তাই তারা কোন নির্দিষ্ট উপসংহার বা সিদ্ধান্ত না দিলেও হাইপোগ্লাইসিন আর কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের দিকে আঙুল তুললেন। বাংলাদেশে এই রোগীদের সময়মত রক্ত পরীক্ষা করা হয় নাই, তাই তারা এর বেশি কিছু নির্দিষ্টভাবে বলতে পারলেন না, তবে ভবিষ্যতে রক্ত পরীক্ষা ও সরাসরি রক্তে (ইন্ট্রাভেনাস) চিনি দিয়ে চিকিৎসার কথা তারা বলেছেন। In Bangladesh, pesticide regulation may be difficult due to lack of monitoring and pesticide residue analysis50 as well as the more general difficulty that weak states face in enforcing environmental regulations. Educating farmers on pesticide handling including proper storage, use of aprons and gloves or washing hands and cloths with soap after pesticide spraying might reduce children’s pesticide exposures at their dwelling place.
Finally, in India, mortality decline among AES case-patients after rapid correction of hypoglycemia with intravenous dextrose. Although we were unable to measure blood glucose level among the case-patients, however, distribution of blood glucose meter among clinician may help identifying patients with hypoglycemia and rapid correction of hypoglycemia with intravenous glucose may reduce mortality in children in Bangladesh. (৩)
ভারতেও এটা নিয়ে আগে গবেষণা হয়েছে, তবে সবচাইতে গভীর গবেষণা হয়েছে ২০১৪তে। মুজাফফরাবাদ এলাকায় ভারতের সবচাইতে বেশি লিচু হয়। এবং প্রতি বছর লিচুর সিজনে সেখানে প্রচুর বাচ্চা মারা যায়। অন্তত ১৯৯৫ থেকে এই ধরনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ২০১৪তে কিছু বিজ্ঞানী সেটার কারন খোঁজা শুরু করেন।
২০১৪র ২৬ মে থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত খিঁচুনি বা এনসেফালাইটিস নিয়ে মুজাফরাবাদ এলাকায় ৩৯০টা বাচ্চা (বয়স ১৫-র কম) হাসপাতালে ভর্তি হয়, এবং তাদের ১২২ জন মারা যায়। বিজ্ঞানীরা অ্যাডমিশনের সময়ের রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টে তাদের মধ্যে ২০৪ জনের রক্তে চিনির পরিমান কম দেখতে পান। তারপর তারা আগের দিন কী খেয়েছে, সেই তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, তাদের অনেকেই আগের দিন রাতে লিচু ছাড়া আর কিছু খায় নাই। (৪)
বিজ্ঞানীরা তাই রিপোর্টে লিখলেন, হাইপোগ্লাইসিন এ আর এমসিপিজি-র কারনে ব্রেইনের সমস্যা (encephalopathy) হচ্ছে। যাতে না হয়, তাই তারা ঠিকমত খাওয়া, লিচু খাওয়ার পরিমান কমানো, আর কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে রক্তে চিনির পরিমান বাড়ানোর উপদেশ দিলেন
Our investigation suggests an outbreak of acute encephalopathy in Muzaffarpur associated with both hypoglycin A and MCPG toxicity. To prevent illness and reduce mortality in the region, we recommended minimising litchi consumption, ensuring receipt of an evening meal and implementing rapid glucose correction for suspected illness.
সুতরাং বাসার বাচ্চাদের পাকা লিচু পরিমিত পরিমানে দিতে পারেন, কিন্তু কেবলমাত্র নিয়মিত খাওয়ার পরে। শুধু লিচু দিয়ে পেট ভরানো উচিত না।
তথ্যসূত্র
(১) https://wa.kaiserpermanente.org/healthAndWellness/index.jhtml?item=%2Fcommon%2FhealthAndWellness%2Fconditions%2Fdiabetes%2FinsulinProcess.html
(২) https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/15554413/
(৩) https://www.ajtmh.org/view/journals/tpmd/97/3/article-p949.xml
(৪) https://www.thelancet.com/journals/langlo/article/PIIS2214-109X(17)30035-9/fulltext?rss=yes
(৫) https://www.thelancet.com/journals/langlo/article/PIIS2214-109X(17)30046-3/fulltext
লিচু ও হাইপোগ্লাইসিন অণু: ছবি ইন্টারনেট থেকে নিয়ে সংযোজিত
জাভেদ ইকবাল,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।