লেখক- অনির্বান মৈত্র আবীর
(১)
"কান পেতেছি-চোখ মেলেছি,
ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,
জানার মাঝে অজানারে করেছি
সন্ধান,বিস্ময়ে—
তাই জাগে,জাগে আমার গান।"
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রাত তিনটে । এসএসসি পরীক্ষা শেষ । কাজকর্ম নেই তেমন । রাতে খেয়ে-দেয়ে শুতে গেছি,হাতে আব্দুল্লাহ আল মুতী স্যারের 'কিশোর বিজ্ঞান সমগ্র'।“আবিষ্কারের নেশায়” পড়ার পর থেকে ভদ্রলোকের বিশেষ ভক্ত হয়ে গেছি।এখন পড়ছি “সাগরতলে রহস্যপুরী”।আমার মতে,রবি ঠাকুরের “বিশ্বভরা প্রাণ”—এর আসল স্পন্দন আপনি টের পাবেন না,যতদিন না আপনার নিবিড় মিতালি গড়ে উঠছে অথৈ সমুদ্রের সাথে—সমুদ্রের সে স্পন্দন বড়ই বিচিত্র,বড়ই চমকপ্রদ এবং কখোনো কখোনো ভয়ংকর রকমের সুন্দর!
যাহোক, বইটার শেষদিকেই চলে এসেছিলাম প্রায়।সাগরের মৎস্যভাণ্ডার কিছুক্ষণ আগেই আমার অনুরক্ত চোখে ধরা দিয়েছে,বইয়ের পাতায়।সাথে ছিলো আমার ল্যাপটপ।যখন যে প্রাণীর নাম পাচ্ছিলাম,ল্যাপটপটা খুলে সার্চ করছিলাম গুগলে।মজার সব তথ্যের সাথে প্রায়-জ্যান্ত ছবির মজাই আলাদা!এর মধ্যে যে চোখ লেগে গেছে কখন,বুঝতেই পারিনি। একটা সময় পর অনুভব করলাম আমি যেনো ভাসছি জলের মধ্যে।চারদিকে অন্ধকার।কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, চোখ খুলে আছি,না বন্ধ করে আছি—সেটা পর্যন্ত বোঝার কায়দা নেই—এর মধ্যেই হাত-পা ছুঁড়ছি কোনোরকমে। সাগরেই এসে পরলাম নাকি,এতো নিচে যেখানে সমুদ্রের আলোও পৌঁছোয় না!সে হোক গে যাক—এখন তা ভাবার সময় নয়।হাঁচড়-পাচড় করছি কোনোরকম,এর মধ্যেই একটা মৃদু নীল আলো যেনো ঠিকরে এসে বিধলো চোখে।দেখলাম বেশ দূরে একটা আলো,সেটা দুলছে মৃদুমন্দ।উপায়ান্তর না দেখে আগে বাড়লাম,জল কেটে এগোচ্ছি কোনোমতে সেদিকে।আলোটা এখন খুব দূরে নয়।এগোচ্ছি আমি,খেয়াল করলাম আলোটাও যেনো এখন একটু পিছিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ সেই জলের ভেতরই একটা তীব্র আওয়াজ,আলোটাও নিভে গেছে হঠাৎ!আমি কি আটকা পরে গেলাম কোথাও? একি! একটা গাড়ি যেনো আমাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে একদিকে,আমি যেনো তার যাত্রী!হঠাৎ আবিষ্কার করলাম কিছু অর্ধতরল পদার্থ যেনো ছিটে ছিটে পরছে আমার গায়ে।তবে কি এক অবর্ণনীয়-মূর্তিমান সামুদ্রিক আতঙ্ক গ্রাস করছে আমায়!আর আমি ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছি তার পরিপাকনালীর আঁধারে..........!
আঁতকে উঠে পরলাম আমি।উঠেই চোখ পরলো ল্যাপটপ স্ক্রিনের দিকে—দেখলাম একটা বিকট অ্যাংলার ফিশ তার দুই চোয়াল ফাঁক করে যেনো আমাকেই গিলে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।তবে আমার চোখ আটকে গেছে অন্যখানে—আমি স্তব্ধচোখে চেয়ে আছি ওর শুঁড়ের নীল আলোটার দিকে।ওটাই কিছুক্ষণ আগে আর দশটা শিকারের মতোই আমাকে টেনে নিয়ে গেছিলো ঐ বিকটদর্শন দানবটার দিকে!ঐ সৌন্দর্যের সুরায় একবার যে মজবে,তার আর মনেই হবে না ওর আড়ালেই রয়েছে মৃত্যুর আহবান।সাধে কি শেকসপীয়র বলেছেন,All that glitters is not gold!
স্বপ্নের ত্রাস : অ্যাংলার ফিশ! ছবি: Pinterest.com
ঘরের এনার্জি লাইটটা মোটেও কমজোরি নয়,তারমধ্যেই আমার মনে হলো নীল আলোটা আবারো যেনো দুলছে—ঠিক স্বপ্নের মতোনই—ভাবাবিষ্টের মতো চাইলাম সেদিকে—কি ভয়ংকর সুন্দর!
সাল ১৮৬৪।সোমালিয়ার দক্ষিণ উপকূলে ভারত মহাসাগরের একটি বিশেষ এলাকার কথা বলছি।এ না কি এক ভুতুড়ে জায়গা!মাঝে মাঝেই এখানে দেখা মেলে দুধ-সাদা ফেনিল জলের।সেও আবার কম নয়,প্রায় আড়াইশো বর্গকিলো এলাকা জুড়ে।সাগরের জল তো নীলচে,তা আবার সাদা হয়ে জ্বলজ্বল করে কিভাবে?এরকম আজব কথা কেউ শুনেছে কোনোকালে?সমুদ্রের দেবতাদের রুষ্ট হওয়া ছাড়া আর কি হতে পারে ব্যাখ্যা!
রহস্যময় মিল্কি সি! ছবি: medium.com
সে এলাকা দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকান জাহাজ সিএসএস আলাবামা।ক্যাপ্টেন রাফায়েল সিমেস বসে আছেন তার কেবিনে।ক্রু'রা আছে বাইরে।হঠাৎ তাদের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে বাইরে এলেন ঈষৎ বিরক্ত ক্যাপ্টেন।কিন্তু বাইরে এসে যা দেখলেন,তা দেখার জন্য তার চোখ প্রস্তুত ছিলো না মোটেও।তাদের পাশের নীল জল থেকে মুক্তোর মতো ঠিকরে বেড়োচ্ছে সাদা আলো!তার মনে হলো জাহাজটা যেনো ভেসে চলেছে সাদা তুষারে ঢাকা বিরাট মাঠের ওপর দিয়ে।ক্রু'রা যখন দেবতার অভিশাপের ক্রমাসন্ন পরিণতি,কিংবা হঠাৎ কোনো দানো'র ভয়ে জবুথবু হয়ে আছে,ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি তখন অনড়-অচঞ্চল—কয়জন নাবিক পায় এ অপার্থিব দৃশ্য দেখার সুযোগ?
"সুন্দরের তৃষ্ণা যার,
আমরা ধাই তার আশেই।
তার খোঁজেই বিরাম নাই,বিলাই তান-তরল শ্লোক,
চকোর চায় চন্দ্রমায়,আমরা চাই মুগ্ধচোখ।"
কোনো দেব-দেবীর ভয় নয়,সিমেসের কৌতুহলী অথচ মুগ্ধচোখে সেদিন ধরা দিয়েছিলো প্রাকৃতিক রংমশাল—প্রকৃতির বর্ণিল আলোকসজ্জা!
বায়োলুমিনেসেন্সের জগতে আপনাকে আলোকীয় শুভেচ্ছা!
"ও শ্যামাদাস, আয় তো দেখি,
বোস তো দেখি এখেনে,
সেই কথাটা বুঝিয়ে দেবো,
পাঁচ মিনিটে,দেখে নে।"
—সুকুমার রায় ।
ওপরে যে গভীর সমুদ্রের অ্যাংলার ফিশ আর দুধেল সাগরের কথা বললাম,তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের অতি পরিচিত একটা জিনিস—গরমের সন্ধ্যায় ঝোপঝাড়ে আমরা যে জোনাকির আলো দেখি,সেটা!এই যে তিনটি প্রেক্ষাপটের কথা বললাম,এদের তিনটিরই কেন্দ্রে আছে অভিন্ন এক প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ—বায়োলুমিনেসেন্স,বাংলায় বললে জৈবদ্যুতি।কাকে বলে বায়োলুমিনেসেন্স? সহজ কথায় বললে,জীবন্ত জীবদেহ থেকে বিভিন্ন বর্ণের আলো উৎপাদন এবং ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনাকে বলে বায়োলুমিনেসেন্স।যেসকল জীবের এই অদ্ভুত ক্ষমতা আছে,তাদেরকে বলা হয় বায়োলুমিনেসেন্ট।আমাদের চারপাশে এরকম উদাহরণ কেবল জোনাকিই,বাস্তবে কিন্তু এরকম আলো-তৈরি-করতে-পারা জীবের সংখ্যা নেহাত কম নয়!বহু কীটপতঙ্গ,ব্যাকটেরিয়া,ছত্রাক,শৈবাল,প্লাঙ্কটন এবং অসংখ্য সামুদ্রিক মাছ বায়োলুমিনেসেন্সের মাধ্যমে আলো তৈরির ক্ষমতা রাখে।আরো আছে নানা জাতের স্কুইড,ড্রাগনফিশ,অ্যাংলার ফিশ,অক্টোপাস,জেলিফিশ,ক্লিক বিটল,ডিনোফ্লাজেলাটিস।আশ্চর্যের কথা এদের বেশির ভাগের ঘরবসতিই সমুদ্রের বিভিন্ন স্তরে,সংখ্যা দিয়ে বললে সামুদ্রিক প্রাণীদের শতকরা ৭৫ শতাংশ এই অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী!
বায়োলুমিনেন্স কার্যত একধরণের জৈব-রাসায়নিক ঘটনা।জানিয়ে রাখি,প্রকৃতিতে 'লুমিনেন্স' শুধু এই একরকমের নয়,আবার বায়োলুমিনেন্স নিজেও কোনো মৌলিক ভাগ নয়,বরং এটি এক বিশেষ রকমের 'কেমিলুমিনেন্স'।কেমিলুমিনেন্স কী? 'কেমি' মানে আমরা জানি রাসায়নিক,আর 'লুমিনেন্স' মানে আলো তৈরি করা,তাহলে 'কেমিলুমিনেসেন্স' মানে দাঁড়ায় বিশেষ কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আলো তৈরির ক্ষমতা।বিভিন্ন জৈব অণুর কার্যকারিতায় জীবদেহে জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে যখন আলো উৎপন্ন হয়, তখন তাকে বলে 'বায়োলুমিনেসেন্স'।
তাহলে বায়োলুমিনেসেন্সের বাইরেও—লুমিনেন্সের কি রকমফের আছে আর? অবশ্যই আছে।অনেক রকম প্রক্রিয়ায় আলো তৈরি হতে পারে,ছড়িয়ে পড়তে পারে।উৎসের নাম,ধরন অনুসারে তখন তাদের নামকরণ করা হয়।তড়িৎ বা 'ইলেকট্রিসিটি' ব্যবহার করে যখন আলো নিঃসরিত হয়,তাকে বলে ইলেক্ট্রোলুমিনেন্স,তেজস্ক্রিয় পদার্থ কোনো উপযুক্ত দ্রাবকে দ্রবীভূত করলে সেখান থেকেও আলো নিঃসরণ হতে পারে,তাকে বলে লায়োলুমিনেন্স।প্রকৃতিতে আরেকভাবেও আলোর নিঃসরণ ঘটতে পারে,মজার ব্যাপার বায়োলুমিনেসেন্সের সাথে অনেক সময় আমরা একে গুলিয়ে ফেলি।এর নাম 'ফ্লুরোসেন্স' বা প্রতিপ্রভা।সমুদ্রের অনেক জীব বাইরে থেকে আলো শোষণ করে সেই আলো আবার ছড়িয়ে দিতে পারে,সেটাকে বলা হয় ফ্লুরোসেন্স।উল্টো দিকে বায়োলুমিনেসেন্সে জীব নিজেই জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আলো তৈরি করে ছড়িয়ে দেয়।তফাতটা বুঝলেন তো?
ফিরে আসি বায়োলুমিনেসেন্সে।বিষয়টা কিভাবে কাজ করে—তা না জানলে কি আর বিজ্ঞানমনস্ক হৃদয় তৃপ্ত হয়? আগেই বলেছি,জীবদেহের অভ্যন্তরে রাসায়নিক বিক্রিয়াই বায়োলুমিনেসেন্সের কারণ।স্বভাবতই এ বিক্রিয়ায় আলোর বিচ্ছুরণ ঘটবে।সাধারণভাবে একটি বিশেষ প্রোটিন (বা কিছু প্রজাতিতে কোনো আয়ন) কোনো আলো উৎপাদনকারী উপাদানকে ভাঙ্গে,তখন উপজাত হিসেবে আলো নির্গত হয়। সাধারণত যে উপাদানটি আলো তৈরী করে সেটিকে বলা হয় লুসিফারিন(আলো উৎপাদনের বৈশিষ্ট্যধারী যৌগ)আর যে উপাদান বা এনজাইম এখানে ক্রিয়া করে,তার নাম লুসিফারেজ।বায়োলুমিনেসেন্টদের দেহে এ প্রক্রিয়াটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে থাকে।
লুসিফারিন থেকে আলো নিঃসরণের সাধারণ মেকানিজমটা মোটামুটি এরকম—প্রথমে লুসিফারিন এনজাইমের ক্রিয়ায় 'লুসিফেরিল অ্যাডেনাইলেট' নামে একটা মধ্যবর্তী যৌগ তৈরি করে।কোষের ATP এ বিক্রিয়ায় সক্রিয়ণ শক্তির(বিক্রিয়া প্রাথমিকভাবে শুরু হতে যে শক্তি দরকার হয়) যোগান দেয়।উৎপন্ন 'লুসিফেরিল অ্যাডেনাইলেট' অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে অস্থিতিশীল অক্সিলুসিফারিন তৈরি করে।অক্সিলুসিফারিন কিটো-ইনল টটোমার সাম্যাবস্থা সৃষ্টি করে।এখানে বলা দরকার,টটোমার হচ্ছে বিশেষ প্রকারের সমাণু,বা বলা যেতে পারে কোনো রাসায়নিক যৌগের যমজ ভাই,যাদের দেখতে হুবহু পরস্পরের মতো,কিন্তু তাদের বৈশিষ্ট্য ভিন্নরকম।টটোমার সাম্যাবস্থা বা টটোমারাইজেশন বলতে বোঝানো হয় এমন একটা অবস্থা,যেখানে যৌগগুলো এক ভাইয়ের রূপ থেকে আরেক ভাইয়ের রূপ ধারণ করতে পারে।তো, সেই উত্তেজিত অক্সিলুসিফারিন স্থিতিশীল অবস্থায় আসার জন্যে শক্তি বিকিরণ করে,বিকিরিত শক্তিকেই আমরা আলো হিসেবে দেখি।
বায়োলুমিনেসেন্সের রসায়ন! ছবি : উইকিপিডিয়া
আমাদের ঘরোয়া বিদ্যুত বাতি তার শক্তির মাত্র দশ ভাগ আলোক শক্তিতে পরিণত করতে পারে,বাকি প্রায় নব্বই ভাগই তাপে পরিণত হয়।মজার ব্যাপার হচ্ছে লুসিফারিন তাপ প্রতিরোধী হওয়ায় আলোকে ঠান্ডা রাখে ফলে বায়োলুমিনেসেন্ট জীবের আলোয় তাপ নির্গত হয় না এবং তারা তাদের সমস্ত শক্তির শতভাগই আলোক শক্তিতে পরিণত করতে পারে।
আলো-তো পেলাম,কিন্তু তার রঙ কি হবে? বর্ণালীমিতি থেকে আমরা জানি,রঙ আসলে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ ছাড়া কিছুই না।আলোর বর্ণ কী রকম হবে,তা ব্যাখ্যা করার আসলে একক কোনো মতবাদ নেই,তার বদলে অনেকগুলো পরিপূরক মতবাদ আছে।তবে লুসিফারিনের গাঠনিক বৈশিষ্ট্যই যে অনেকাংশে আলোর বর্ণ নির্ধারণ করে—সে বিষয়ে দ্বিমত নেই খুব বেশি।একটি মতবাদে বলা হয়,আলোর প্রকৃতি নির্ভর করে উৎপাদ যৌগটি কিটো যৌগ থেকে স্থিতিশীল অবস্থায় আসছে,নাকি ইনল যৌগ থেকে স্থিতিশীল অবস্থায় আসছে।কিটো যৌগ উত্তেজিত অবস্থায় লাল আলো দেয়,আর ইনল যৌগ থেকে আসে হলুদাভ সবুজ আলো।কিছু মতবাদে বলা হয় চারপাশের পরিবেশের উপাদানও আলোর বর্ণকে প্রভাবিত করে থাকে।বলা হয়,পরিবেশের কিছু আনুষাঙ্গিক দ্রব্যের সাথে অক্সিলুসিফারিনের বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়া তার টটোমারাইজেশনে প্রভাব ফেলে আলোর প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়।
একটা কথা বলে রাখা ভালো,লুসিফারিন-লুসিফারেজ বিক্রিয়াই কিন্তু আলো নিঃসরণের একমাত্র পদ্ধতি নয়।লুসিফারেজের বদলে কোনো কোনো সামুদ্রিক প্রাণী 'একোয়ারিন' নামক ফটোপ্রোটিন ব্যবহার করে। একোয়ারিন,অপর একটি প্রোটিন, ক্যালসিয়াম আয়ন এবং অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় তৈরি হয় সিলেন্ট্রামাইড নামের যৌগ।এই সিলেন্ট্রামাইড থেকে নিঃসৃত হয় নীল রঙের আলো।
কিছু প্রাণী অবশ্য আলো তৈরি ছাড়াও আলো নিঃসরণ করার ক্ষমতা রাখে।কীভাবে? সিমবায়োসিস বা মিথোজীবীতার মাধ্যমে! সেই প্রাণীগুলো হয়তো বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাককে পরজীবী হিসেবে থাকতে দেয়,বা খাদ্যের যোগান দেয়—বিনিময়ে তারা ব্যবহার করে তাদের আলো'কে।
(৩)
সহজ কথা কইতে আমায় কহো যে,
সহজ কথা যায় না বলা সহজে
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই পর্বের মূল আলোচনায় যাবার আগে বিবর্তনের কথা বলা জরুরি।কেননা,"বিবর্তনের আলোকে না দেখলে জীববিজ্ঞানের সকলকিছুই অর্থহীন দাঁড়ায়!" (থিওডর ডবঝানস্কি)
আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে ডারউইনীয় বিবর্তনের মধ্যে। ডারউইনীয় বিবর্তনের মূলনীতিকে এভাবে লেখা যায়,অনুকূল বা অভিযোজনমূলক প্রকরণ সমন্বিত জীবেরা উপযুক্ত পরিবেশে নির্বাচিত হয় এবং বংশবিস্তার করে অনুকূল প্রকরণ পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চার করে।এখান থেকে স্পষ্ট যে,ডারউইনীয় বিবর্তনে প্রকরণ(variety), নির্বাচন(selection) এবং বংশবিস্তার(reproduction)—এই তিনটি শর্তই পূরণ হওয়া চাই, তা না হলে ডারউইনীয় বিবর্তন ঘটতে পারবে না (অ-ডারউইনীয় বিবর্তন হতে পারে,তবে সেটা এখানে আলোচ্য নয়)।প্রকরণ কী? প্রকরণ হচ্ছে পপুলেশনের জীবগুলোর বৈশিষ্ট্যের স্বাতন্ত্র্য,সেটা হতে পারে আকারে,হতে পারে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতায় কিংবা প্রতিকুলতা সহনীয়তায়।অনুকূল প্রকরণ তাকেই বলা হবে,যা অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামে জীবটিকে সহায়তা দেবে।একটি ব্যাকটেরিয়ার উচ্চ অ্যান্টিবায়োটিক সহনীয়তা অনুকূল প্রকরণের উদাহরত হতে পারে, যা তাকে উপযুক্ত পরিবেশের সক্ষম বা ফিট বলে নির্বাচিত করবে।এরকম অনুকূল প্রকরণযুক্ত জীবেরা অত্যধিক হারে বংশবিস্তার করতে পারে—যুগ যুগান্তর ধরে প্রকৃতি তাদের নির্বাচিত করে এবং তার প্রজাতি জীবনপ্রবাহ এবং জনমিতির মানদণ্ডে টিকে থাকে।এখান থেকে একটি বিষয় বোধহয় স্পষ্ট করতে পেরেছি যে, কোনো পপুলেশনে বিরাজমান জীবেরা কোনো বিশেষ এবং অনুকূল প্রকরণের কারণেই টিকে থাকতে পারছে, এর অন্যথা হলে তারা অবলুপ্ত হয়ে যেতো।
বায়োলুমিনেসেন্স নামক যে বিশেষ জীববৈজ্ঞানিক ঘটনার কথা দু'পর্ব পেরিয়ে আজ তৃতীয় পর্বে আলোচনা করছি,তার জন্যেও বিবর্তনের এই ফিল্টার প্রাসঙ্গিক।আমাদের কাছে বায়োলুমিনেসেন্স সৌন্দর্য সৃষ্টির বিষয় বলে পরিগণিত হতে পারে,কিন্তু বায়োলুমিনেসেন্ট জীবদের জন্য তা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, কেননা বিবর্তনের ধারায় এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই এরা আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে।তাই এটা সহজেই অনুমেয় যে,বায়োলুমিনেসেন্স সংশ্লিষ্ট জীবদেরকে বেঁচে থাকতে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে।দেখা গেছে এই আলো জীবগুলো শিকার খোঁজা, শিকারির হাত থেকে বাঁচার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ,ক্যামোফ্লাজ সৃষ্টি,একই প্রজাতির অন্য প্রাণীর সাথে যোগাযোগ,সঙ্গীকে আকৃষ্ট করা, বহিরাগতকে সর্তক করা সহ আরো কিছু কাজে ব্যবহার করে। চলুন, কিছু কেস স্টাডি করা যাক!
জোনাকি দিয়েই শুরু করি।স্থলভাগের বায়োলুমিনেসেন্ট জীবদের মধ্য জোনাকিই আমাদের সবচে পরিচিত।জোনাকির আলো দেওয়া সেক্সুয়াল সিলেকশন বা যৌনতার নির্বাচনের(এর অন্য উদাহরণ হচ্ছে পুরুষ ময়ূরের পেখম তোলা কিংবা কোকিলের কুহু কুহু ডাক!)অন্তর্গত, যা বিবর্তনের আরেকটি চালিকশক্তি।সকল প্রজাতি আবার আলো দিতে পারে না, বিশেষ কিছু প্রজাতির এ ক্ষমতা আছে।জোনাকি তার আলো ব্যবহার করে নিজের প্রজাতিগত পরিচয় জানান দেয় এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করে মিলনের আমন্ত্রণ জানায়। এদের দেহের নিচের দিকের যে অংশে হলদে আলো উৎপন্ন হয়,সেই অংশটি বেশ পাতলা এবং স্বচ্ছ।প্রজনন ঋতুতে বনজঙ্গল জোনাকিতে ছেয়ে যায়,তখন এরা নৃত্যের ভঙ্গিতে টিম টিম করে জ্বলতে থাকে।একেক প্রজাতির আবার নাচের ধরণ আলাদা।Photinus pyralis প্রজাতিতে পুরুষ জোনাকি ওপর-নিচ বরাবর উড়ে আলো জ্বালতে থাকে,আর স্ত্রী জোনাকি পাতা বা অন্য কোথাও বসে থাকে।উজ্জ্বল বা তীব্র আলো একজন ভালো যৌনসঙ্গীর পরিচয় দেয়।পুরুষটির আলো দেবার মোটামুটি দুই সেকেন্ড পরে স্ত্রী জোনাকি ফিরতি আলো জ্বালিয়ে আগ্রহসূচক বার্তা দেয়। পুরুষটি তখন আরেকটু কাছে আসে। এভাবে একসময় তারা মিলিত হয়।জোনাকির আলো জ্বালানো এখানেই শেষ নয় কিন্তু,আরো অবাক করা বিষয় হলো,স্ত্রী জোনাকিরা কখোনো কখোনো মিমিক্রি(mimicry) করে আলোক-সৌন্দর্যের ফাঁদ পাতে।আলোর আকর্ষণে বিভ্রান্ত হয়ে অন্য প্রজাতির জোনাকি যখন মিলনের জন্য কাছে আসে,তখন স্ত্রী'টি তাকে ভক্ষণ করে!
জোনাকির ক্ষেত্রে সাধারণত একরকম আলোই দেখা যায়।ক্লিক বিটল গুবরে পোকার আলোর রঙ আবার নির্ভর করে তার মেজাজ-মর্জির ওপর।প্রজনন মৌসুমে সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার জন্য এদের তলপেট থেকে কমলা রংয়ের আলো নিঃসরণ হয়।আর যখন সে শিকারের আভাস পায়,তখন নিঃসরণ করতে থাকে সবুজ আলো।বিটলের মতো শিকারের স্বার্থে বায়োলুমিনেসেন্স এর ব্যবহার দেখা যায় Arachnocampa luminosa নামের পতঙ্গ প্রজাতির।নিউজিল্যান্ডের গহীন জঙ্গলের গুহায় দেখা মেলে এদের।এদের লার্ভা মাকড়সার জালের মতো করে বিস্তৃত হয়।এই জাল থেকে নির্গত উজ্জ্বল আলো বাইরের পোকামাকড়কে আকর্ষণ করে।চকচকে আলো দেখে বোকা বনে গিয়ে যারা জালে আটকা পড়ে তাদের দিয়ে ওই পতঙ্গ আহার সেরে নেয়।অনেক পতঙ্গের লার্ভা আবার বায়োলুমিনেসেন্স ব্যবহার করে পাখি,ব্যাঙ কিংবা অন্য শিকারী প্রাণীদেরকে দূরে রাখে,যেমন ডায়মন্ড ওয়ার্ম, রেইলরোড ওয়ার্ম এবং গ্লো ওয়ার্ম!রেইল রোড ওয়ার্ম আবার বেশ সৌখিন,এদের মাথার দিকটা জ্বলে লাল রঙে, আর দেহের নিচের দিকটা সবুজ রঙে।
Glow worm এর আলো! ছবি: biologydictionary.net
বায়োলুমিনেসেন্ট ছত্রাকের কথা বলা হয়নি এখোনো,ওরা আবার রাগ করতে পারে! ছত্রাকের প্রায় আশিটির'ও বেশি বায়োলুমিনেসেন্ট প্রজাতি আবিষ্কৃতে হয়েছে এ পর্যন্ত।মূলত ট্রপিকাল বনজঙ্গলেই এদের দেখা যায়।পরিচিত ছত্রাক প্রজাতির মধ্যে বিটার অয়েস্টার(Bitter oyster) এর কথা উল্লেখযোগ্য।প্রজাতিটির মূল নাম Panellus stipticus,তবে উজ্জ্বল ঝিনুক বা গুগলির মতো দেখতে বলে তাদের ঐরকম নামকরণ।অস্ট্রেলিয়া,এশিয়া,আমেরিকার ট্রপিকাল জঙ্গলে বার্চ,ওক কিংবা বিচ গাছে মূলত এদের দেখা মেলে।সূর্য ডুবলে এক অপার্থিব আলোয় ঝলমলিয়ে দেয় এই বিশেষ প্রজাতির ফাঙ্গাসটি।কিছু বায়োলুমিনেসেন্ট ছত্রাক,যেমন Omphalotus olearius, Omphalotus nidiformis—এদের পাওয়া যায় ভেজা অথবা পচা কাঠের গুঁড়ি বা টুকরাতে।এরা সবুজ বা নীলচে সবুজ আলো বিচ্ছুরণ করূ সাধারণত।ছত্রাকদের বায়োলুমিনেসেন্সকে আবার একটি বিশেষ নামে ডাকা হয়—ফক্সফায়ার।ফক্সফায়ার মূলত স্পোর ছড়ানোর জন্যে কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করে।আবার এই উজ্জ্বল আলো ভক্ষকদেরকেও দূরে রাখে।ফক্সফায়ারের আলো কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে এমন আলোরও যোগান দিতে পারে,যা বই পড়ার জন্য যথেষ্ঠ।এমনকি ব্যারোমিটার এবং কম্পাসের নিডলকে আলোকিত করতেও একসময় ফক্সফায়ার এর ব্যবহার ছিল!
ফক্সফায়ার! ছবি: en.wikipedia.org
প্রথম পর্বে মিল্কি সি'র কথা বলেছিলাম।আন্দাজ করতে পারছেন এটাও বায়োলুমিনেসেন্সেরই কেরামতি।প্রাথমিকভাবে জানা গেছিলো এই আলো সৃষ্টির জন্য দায়ী ডিনোফ্লাজেলাটিস ছত্রাক।পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা গেলো কিছু বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়াও(Vibrio harveyi) এর জন্য দায়ী।যখন জলে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি হয়,তখনি এদের থেকে আলো নির্গত হতে থাকে। একটি একক ব্যাকটেরিয়া থেকে নির্গত আলো দেখা যায় না,কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যক(প্রায় মিলিয়ন পর্যায়ে) ব্যাকটেরিয়া একসাথে হলে রীতিমতো ফায়ারওয়ার্ক হয়ে যেতে পারে—এবং তা এতোটাই উজ্জ্বল যে স্যাটেলাইট থেকেও চিহ্নিত করা যায় এদের!আরো একটি খবর দিয়ে রাখি,কেবল সোমালিয়ার উপকূলেই নয়,মুম্বাইয়ের জহুর সমুদ্র সৈকত,মালদ্বীপের ভাদু সৈকতসহ আরো কয়েকটি জায়গাতেও এদের দেখা মেলে,নিজের দেহের আলো দিয়ে পুরো এলাকাটাকে ঝলমলে করে তোলে এরা—আর টুরিস্টরা চেয়ে থাকেন অবাক দৃষ্টিতে!
এ তো গেলো কেবল স্থল আর সমুদ্র- উপরিতলের আলোচনা।বায়োলুমিনেসেন্সের প্রকৃত জগতে নামতে হলে আপনাকে পরতে হবে মেরিন পোশাক, পিঠে সিলিন্ডার নিয়ে ডুব দিতে হবে অতল সমুদ্রে!গভীর সমুদ্রে বায়োলুমিনেসেন্সের প্রাচুর্য এতো বেশি এবং এতোই বেশি , যে এই পর্বে অন্যান্য বায়োলুমিনেসেন্টদের সাথে সামুদ্রিক প্রাণীদের আলোচনা করার সাহস দেখাচ্ছি না । আগামী পর্বে আমরা ডুবুরীর পোশাক পরে ঝাঁপ দেবো সমুদ্রের গভীরে,দেখবো কিভাবে এক অবাক,এবং অবশ্যই আলোকিত—রহস্যপুরী অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।
ধরাধামে তব সম কেহ নাহি পারে
বিস্ময়-আনন্দ রসে আলোড়িত মন,
অখিল ব্রহ্মাণ্ড আছে তোমার ভাণ্ডারে
নিসর্গের তুমি এক বিচিত্র দর্পণ।
—বিহারীলাল চক্রবর্তী (সমুদ্র দর্শন)
পশ্চিম আকাশ রক্তিম আভায় লাল করে অস্ত যায় দিনের সূর্য।নামে শান্ত সমাহিত অন্ধকার।নতুন দিনের অপেক্ষায় আস্তে আস্তে থেমে যেতে থাকে প্রকৃতির বিচিত্র কোলাহল।থামে না শুধু মহাসমুদ্রের কল্লোল—তীরে অবিরাম আছড়ে পরে উঁচু ঢেউয়ের সারি—অন্ধকারের বুকেই ঝিকিমিকি জ্বলে ওঠে সুবিশাল সাগর।আবার,সমুদ্রের তলার আলো আঁধারিতে,কখোনো কখোনো যেখানে সূর্যের আলোয় পৌঁছায় না, চড়ে বেড়ায় এমন সব অদ্ভুত প্রাণী,যাদের গা থেকে বেড়োয় উজ্জ্বল আলোর ছটা।সে আলো তারা ইচ্ছে মতো জ্বালে,ইচ্ছেমতো নেভায়।সাহিত্যের সুললিত ভাষা ত্যাগ করে, বিজ্ঞানের কঠিন টার্মিনোলজিতে আমরা তাদের বলি বায়োলুমিনেসেন্ট।আজকের আলোচনা সমুদ্রের সেইসব বায়োলুমিনেসেন্টদের নিয়েই,সমতলের নগর-দেশ থেকে বহু দূরে যারা গড়ে তুলেছে আশ্চর্য রহস্যপুরী!
দ্বিতীয় পর্বে বলেছিলাম,বায়োলুমিনেসেন্ট জীবদের অধিকাংশই সামুদ্রিক এবং সমুদ্রের প্রায় তিন চতুর্থাংশ জীবই বায়োলুমিনেসেন্ট।এদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মাছ,অমেরুদণ্ডী অক্টোপাস,স্কুইড,ছত্রাক,ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।সমুদ্রের সকল গভীরতাতেই এদের দেখা মেলে।অধিকাংশ সামুদ্রিক বায়োলুমিনেসেন্ট জীব নীল-সবুজ রং দিয়ে থাকে,আবার সমুদ্রের জীবদের অধিকাংশই এই দুটি রঙে সংবেদনশীল।এখানে বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য,স্থলজদের মতোই সামুদ্রিক জীবদের জন্যও একথা প্রযোজ্য যে, অথৈ সমুদ্রের পরিবেশে অভিযোজন এবং টিকে থাকার স্বার্থেই এদের মধ্যে বায়োলুমিনেসেন্সের প্রকরণ বিবর্তিত হয়েছে।আরেকবার মনে করিয়ে দিই,বায়োলুমিনেন্স একটা জীবকে কি কি সুবিধা দিতে পারে,যেমনটা তৃতীয় পর্বেও বলেছি,এই আলো জীবগুলো শিকার খোঁজা, শিকারির হাত থেকে বাঁচার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ,একই প্রজাতির অন্য প্রাণীর সাথে যোগাযোগ,সঙ্গীকে আকৃষ্ট করা, বহিরাগতকে সর্তক করা সহ আরো কিছু কাজে ব্যবহার করে থাকে।তো,এবার আমরা অক্সিজেন নিয়ে জলে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত!
শুরু করা যাক একটু শূদ্র শ্রেণীর প্রাণ দিয়ে।সমুদ্রের উপরিতলে এবং গভীরে বহু বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়া,ছত্রাক,অ্যালগি'র বাস।যেমন ডিনোফ্লাজেলাটিস,ভিব্রিও ফিশারি(Vibrio fischeri),ভিব্রিও হার্ভেই(Vibrio harveyi)।চেনা চেনা লাগছে? হ্যাঁ,মিল্কি সি'র সময়েও এদের নাম করেছিলাম।এরা একসাথে মিলে সমুদ্রে ফাইটোপ্লাংকটন তৈরি করে,আর একজোট হয়ে থাকে।যখন কোনো মাছ,অথবা কোনো চিংড়ি এদের ডিস্টার্ব করে,এরা নীলচে আলো জ্বালতে থাকে।আপনি হয়তো ভাববেন,ওহ,আচ্ছা—চিংড়িটাকে ভয় দেখাচ্ছে,এই তো ব্যাপার? না।এটাই পুরো ব্যাপার না।প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে।মাইনাসে মাইনাসে যে প্লাস হয়,এটা শেখাতে গিয়ে আমার ম্যাথের শিক্ষক আমাকে একটা প্রবাদ শিখিয়েছিলেন,আপনারাও শুনে থাকবেন হয়তো,The enemy of enemy is my friend।অর্থাৎ,শত্রুর শত্রু হলো বন্ধু।আন্দাজ করতে পারছেন কি? জীব বলতে কষ্ট হয়—এমন কিছু জীব জোট বেঁধে আলো জ্বালবে শুধু কি ভয় দেখাতে? না।মজার ব্যাপার হচ্ছে,যখন কোনো মাছ প্লাংকটন সেবন করতে আসে,তখন আলো জ্বালিয়ে প্লাংকটন আরো বড় মাছের দৃষ্টি আকর্ষণ করে—যাতে করে বড় মাছটা প্লাংকটনকে বিপদমুক্ত করে।কে জানতো সমুদ্রের তলেও এরকম চোর ধরা আলোক-ঘণ্টার ব্যবস্থা আছে? আরো মজার কথা হচ্ছে, কোনো কোনো হাঙর বা তিমি(Sperm Whale) এই বিষয়টাকে অবজার্ভ করে।প্লাংকটন তাদের খাদ্য নয়,কিন্তু তারা প্লাংকটন খুঁজে খুঁজে বেড়ায়।প্লাংকটন নিজের খাদককে দেখে আলো জ্বালায়,আর গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে তিমিও চালায় ভূঁড়িভোজ!
বায়োলুমিনেসেন্ট জেলি ফিশ! ছবি: chemistryworld.com
এ তো গেলো একটা কাজ।এছাড়া বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক ব্যাকটেরিয়া আলো বিকিরণ করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা, নিজের সহযোগী বা শত্রুদের চেনার জন্যে।একে বলে “কোরাম সেন্সিং”।Sea-firefly'রা সচরাচর হালকা আলো নিঃসরণ, কিন্তু শত্রু বা অন্য প্রাণীর উপস্থিতিতে তীব্র নীল আলোর ছটায় চারদিক আলোকিত করে তোলে।জলের উপরিতলের কাছকাছিই এদের পাওয়া যায়।জানা যায়,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি সেনাবাহিনী গেরিলা আক্রমণে আলোর জন্যে Sea-firefly ব্যবহার করতো।এছাড়া আছে ক্লাস্টারউইংক শামুক।এদের কিছু স্পর্শ করলে বা কোনো বিপদে পড়লে এরা খোলসে ঢুকে পড়ে। আর এই খোলস থেকে এরা টিপ টিপ করে আলো জ্বালতে থাকে।শামুকের এই আলোর উৎস হলো এর গায়ে বাস করা বায়োলুমিনিসেন্ট ব্যাকটেরিয়া।
বায়োলুমিনেসেন্ট চিংড়ি! ছবি: medium.com
সমুদ্রের প্রাণীদের আলোচনা করতে গেলে স্কুইডের কথা আসবেই।এদের বহু প্রজাতির আলো তৈরির ক্ষমতা রয়েছে,এবং তা তারা ব্যবহার করে থাকে বিভিন্ন ভাবে।স্কুইডের দেহে আলো তৈরির মূল উৎস হলো কিছু বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়া।এই ব্যাকটেরিয়া ও স্কুইড হলো মিথোজীবী(Simbiont), অর্থাৎ এরা একে অপরকে সাহায্যের মাধ্যমে একত্রে বেঁচে থাকে।স্কুইড এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে খাদ্যের জোগান দেয়।আর প্রতিদানে ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেদের বায়োলুমিনিসেন্স ক্ষমতা দিয়ে স্কুইডদের শত্রু থেকে রক্ষা করে।দ্বিতীয় পর্বের শেষে মিউচুয়ালিজমের কথা বলেছিলাম,মনে পড়ছে কি?
মূলত এই আলো ব্যবহৃত হয় শিকার থেকে বাঁচার জন্য।যেসব স্কুইড অগভীর সমুদ্রে থাকে, তারা শিকারী দেখলে একধরণের ঘন কালি ছুঁড়ে দিয়ে পালায়।কিন্তু গভীর জলের স্কুইডরা (যেমন ভ্যাম্পায়ার স্কুইড)তা পারে না।এর বদলে তারা শত্রুর দিকে বায়োলুমিনেসেন্ট তরল ছুঁড়ে দেয়,ফলে শত্রু কিছুক্ষনের জন্য দিশেহারা হয়ে পরে, এবং স্কুইড পালায়।একই কাজ করে কিছু চিংড়ি(Acanthephyra purpurea) এবং কিছু জেলিফিশ(Comb Jelly)।চিংড়িরা আবার মেঘের মতো জ্বলজ্বলে ধোঁয়া তৈরি করে শিকারকে ভড়কে দেয়।কখোনো কখোনো এই উজ্জ্বল ধোঁয়া আবার শিকারীকেই শিকার বানিয়ে দেয়!কারণটা বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই?
কিছু স্কুইড(যেমন Octopoteuthis deletron) তার শুঁড়ের অংশবিশেষ হতে বিজলির মতো আলো জ্বালিয়ে,আবার তৎক্ষণাৎ নিভিয়ে সম্ভাব্য শত্রুকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়। কখোনো এরা তাদের একেকটা বায়োলুমিনেসেন্ট শুঁড় খসিয়েও ফেলে,যাতে শিকার ঐ বিচ্ছিন্ন অংশটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে,আর স্কুইডটা পালাতে পারে।টিকটিকির লেজের মতো এদের শুঁড়ও আবার নতুন করে তৈরি হয়।শুধু স্কুইডই নয়,অনেক অক্টোপাস,সি কিউকাম্বার(সমুদ্র শসা' লেখার চেয়ে ইংরেজিটাই বেশি জাঁদরেল মনে হলো!),তারা মাছ(যেমন Brittle stars)ও এই পদ্ধতি অবলম্বন করে।রিফ স্কুইড(Reef Squid) প্রজাতির পুরুষ সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন রঙের আলো নিঃসরণ করতে পারে।যখন স্ত্রী স্কুইডরা ডিম দেয়,তখন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ঘরের বাইরে আলো জ্বালিয়ে পাহাড়া দিতে থাকে,"No Entrance"!
ফায়ারফ্লাই স্কুইড! ছবি : seasky.org
সমুদ্রের বায়োলুমিনেসেন্ট জীবদের একটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্যামোফ্লাজ(Camouflage) তৈরি করা।ক্যামোফ্লাজ কি জিনিস? বলা যেতে পারে শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে ছদ্মবেশ নেওয়া।হাঙরের মতো কিছু শিকারী প্রাণী নিচ থেকে শিকার করে। তারা লক্ষ রাখে ওপরের দিকে,সূর্যের যে আলো আসছে—জলে তার কোনো ছায়া পরছে কি না।যদি পরে, তাহলে নির্ঘাত সেখানে একটা শিকার রয়েছে।এই পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিতেই গভীর সমুদ্রের অনেক প্রাণী ছদ্মবেশ ধারণের জন্য বায়োলুমিনেসেন্সের সাহায্য নেয়।এর মধ্যে রয়েছে ববটেইল স্কুইড,হ্যাচেটফিশ,জেলি ফিশ, চিংড়ি (Crustaceans) এবং মাছের কিছু কিছু প্রজাতি।এসব প্রাণীর দেহ থেকে নির্গত আলোর ঔজ্জল্য এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়,যে চট করে প্রেক্ষাপটের সাথে তাদের রং মিলিয়ে যায়।এ কারণে শিকারি প্রাণীগুলো সহজে এদের ধরতে পারে না।
শিকারির হাত থেকে বাঁচার জন্য সামুদ্রিক জীবদের আরো একরকম পদ্ধতি নিতে দেখা যায়।ভাবুন তো, অন্ধকার ঘরে হঠাৎ করে যদি আপনার চোখে টর্চের আলো ফেলা হয়,তাহলে কি আপনার চোখ ধাঁধিয়ে যাবে না? চমকে উঠবেন না আপনি? তেমনি শিকার করতে আসা প্রাণীরাও বায়োলুমিনিসেন্ট প্রাণীর আলোর ঝলকে হকচকিয়ে যায়।এই পদ্ধতির প্রয়োগ শিকার ধরতেও অনেক বায়োলুমিনেসেন্ট প্রাণী ব্যবহার করে থাকে।ফ্ল্যাশলাইট ফিশের চোখের কাছে বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়ার থলি থাকে,এই আলো দিয়ে তারা ছোটো মাছকে অকস্মাৎ চমকে দেয়,ছোটো মাছটা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাবার হয়ে যায় ফ্ল্যাশলাইটের পেটে!গভীর সমুদ্রের কিছু ড্রাগনফিশ(যেমন loosejaw dragonfish) বায়োলুমিনেসেন্স ব্যবহার করে পথ চলার সার্চলাইট হিসেবে।আগেই বলেছি,অধিকাংশ সামুদ্রিক জীব নীল এবং সবুজের মধ্যে আলো তৈরির ক্ষমতা রাখে,এবং ঐ রঙ গুলোতেই তারা সংবেদনশীল।কিন্তু, এই ড্রাগনফিশ লাল আলো নিঃসরণ করে।সামুদ্রিক পরিবেশে বিশেষ সুবিধা দিতেই তার এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিবর্তিত হয়েছে।কারণটাও বেশ মজার!তার শিকার বেশিরভাগ মাছ এই আলো দেখতে পায় না—ফলত শিকারী খুব সহজেই শিকারকে গ্রাস করে ফেলে!
অ্যাংলারফিশ! ছবি: Pinterest.com
সিরিজটা শুরু করেছিলাম আমার স্বপ্নে অ্যাংলার ফিশের হানা দেওয়ার কথা দিয়ে।তার কথা বলি এবার।সমুদ্রের প্রায় ২,০০০ মিটার গভীরে এই মাছগুলো বিচরণ করে থাকে।দেহের তুলনায় এদের চোয়াল বেশ বড়।তবে এই মাছের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ হচ্ছে এর মাথার সামনের দিকের অ্যান্টেনার মতো প্রবৃদ্ধি।একে বলে ফিলামেন্ট(filament)।ফিলামেন্টের মাথায় বলের মতো অংশ থাকে,যার নাম এস্কা(esca)।এর মধ্যে থাকে বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়া।ব্যাকটেরিয়ার আলো মাছের টোপ হিসেবে কাজ করে।সমুদ্রে চলতে সাহায্য করা ছাড়াও ঐ আলো ছোটো ছোটো মাছেদের আকর্ষণ করে,আর যখন মাছগুলো তাদের ভুল বুঝতে পারে,ততক্ষণে তারা অ্যাংলারফিশের শক্ত চোয়ালের মধ্যে চলে এসেছে।
স্টারলাইট অ্যাভাটার! ছবি:greenhousepower.com
সামুদ্রিক বায়োলুমিনেসেন্ট প্রাণীদের এই যে আলোচনা,তা মোটেই শেষ হবার নয়।এরকম আরো বহু জীব রয়েছে,যার বর্ণনা এখানে দিই নি আমি।সব জীবের বায়োলুমিনেসেন্সের কারণ,তাদের উদ্দেশ্য এখোনো অনাবিষ্কৃত রয়েছে।বিজ্ঞানীরা বসে নেই মোটেই।বায়োলুমিনেসেন্সের রহস্যভেদ করে কিভাবে মানবকল্যাণে একে ব্যবহার করা যায়,তার চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।ইতোমধ্যে কয়েকটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেওছেন তারা।ব্যাকটেরিয়ার কোরাম সেন্সিং—এর কথা বলেছি।পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা করার জন্য Vibrio fischeri ব্যাকটেরিয়ার কোরাম সেন্সিং-কে কাজে লাগানো হয়। যখন পানিতে কোনো বিষাক্ততা থাকে তখন এদের আলোর তীব্রতা অনেক কমে যায়।চিকিৎসায়,জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং—এও এর প্রয়োগক্ষেত্র বাড়ছে।উইসকন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বায়োলুমিনিসেন্ট E.coli ব্যাকটেরিয়া জিনোমে পরিবর্তন করে বাল্ব হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন।আমেরিকার রিসার্চ ফার্ম বায়োগ্লো'র গবেষকরা বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়ার জিন ব্যবহার করে জেনেটিকালি মডিফায়েড তামাক গাছ তৈরি করেছেন—স্টারলাইট অ্যাভাটার।এরা তাদের জীবনকালের সম্পূর্ণ সময়ই আলো দেয়।সেইদিনও হয়তো বেশি দূরে নয়,যখন উদ্ভিদগুলো আলো জ্বালিয়ে তাদের জল-পুষ্টির প্রাপ্যতা,অভাব কিংবা ফল দেওয়ার সময় নির্দেশ করবে—রাস্তার পাশে পৃথক বাতির দরকার হবে না,বায়োলুমিনেসেন্ট উদ্ভিদ পরিবেশ রক্ষা করবে—বিদ্যুত খরচও কমাতে পারে হয়তো।এজন্যে আমরা বরাবরের মতোই সেসব আলোকিত মানুষদের দিকে চেয়ে আছি,যদিও তারা বিবর্তনে বায়োলুমিনেসেন্ট নন,কিন্তু যুগ যুগ ধরে তাদের আলো আমাদের কল্যাণের পথ দেখিয়েছে। 🙂
কৃতজ্ঞতা:
১) সাগরের রহস্যপুরী,আব্দুল্লাহ আল মুতী
২) The weird,wonderful world of Biolouminescence,TED-ed: https://youtu.be/lKeDBpkrDUA
৩) 13 glowing animals in the deep sea,What Lurks Below: https://youtu.be/aIQfTRrD0TE
৪) Biolouminescence,Smithsonian: https://ocean.si.edu/ocean-life/fish/bioluminescence
৫) Biolouminescence,Britannica Encyclopedia: https://www.britannica.com/science/bioluminescence
৬) Biolouminescence explained, Nat Geo: https://www.nationalgeographic.org/encyclopedia/bioluminescence/
৭) Bioluminescent trees could light up your streets,iflscience.org: https://www.iflscience.com/plants-and-animals/bioluminscent-trees-could-light-our-streets/#xHSR4UHV249qfGtS.01
৮) 13 glowing animals in the deep sea,What Lurks Below: https://youtu.be/aIQfTRrD0TE
৯) Biolouminescence,Smithsonian: https://ocean.si.edu/ocean-life/fish/bioluminescence
১০) Biolouminescence,Britannica Encyclopedia: https://www.britannica.com/science/bioluminescence
১১) Biolouminescence explained, Nat Geo: https://www.nationalgeographic.org/encyclopedia/bioluminescence/
অনির্বান মৈত্র আবীর
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান