Ads Area

advertise

ফারমিল্যাবস মিউয়ন জি মাইনাস টু (Muon g-2) অজানা পদার্থবিজ্ঞানের হাতছানি

0
লেখকঃ আনন্দ মুহিত


অনেক দিন বিরতির পড় আবার ব্রেকথ্রু সায়েন্স নিউজ নিয়ে লিখছি, BCB Science Breakthroughs: বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলো নিয়ে প্রকৃত সংবাদ তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।

আজকের বিষয় হলো (Fermilabs) ফারমিল্যাবস এর Muon g-2 experiment (মিউয়ন জি মাইনাস ২) নিয়ে। যারা অনলাইনে বিদেশী পত্র-পত্রিকা পড়েন তারা হয়তো গত সপ্তাহ ধরে দেখেছেন ফারমিল্যাবস এর পরীক্ষায় নতুন কণা পাওয়ার খবর, পুরোনো থিওরী ভুল প্রমাণিত হবার খবর, নতুন মৌলিক বল আবিষ্কারের সংবাদ। বাংলাদেশি নিউজ মিডিয়াতে খবরটি এখনো তেমন একটা আসেনি, তারা কিরকম হেডলাইন করে তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
 
এবার চলুন দেখি ফারমিল্যাবস এর গবেষণা ছিল কী নিয়ে, আর কী নিয়েই বা বিজ্ঞান মহলে এত উত্তেজনা। 
 
ঘটনার বিস্তারিত বলার আগে যাদের পার্টিকেল ফিজিক্স নিয়ে আইডিয়া নেই, তাদের জন্য একটু বেসিক। সেই কণাদ, ডেমক্রিটাস থেকে ডাল্টনের পর্যন্ত ধারণা ছিল এটম বা পরমাণুকে ভাঙা সম্ভব নয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের থেকে এটমকে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে   বিজ্ঞানীরা এমন মৌলিক কিছু কণা আবিষ্কার করলেন যাদের আসলেই আর ক্ষুদ্র কোনও কনায় বিভক্ত করা যায়না। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনের নাম সবাই হয়তো শুনেছেন, যাদের ভেঙে আরও ক্ষুদ্রতর কণা পাওয়া গেলো। তাত্ত্বিকভাবে দেখানো হল এরকম আরও কণা থাকা সম্ভব, যার অনেকগুলো পরবর্তীতে বিভিন্ন পরীক্ষায় পাওয়া যায়। তাই ৭০ এর দশকে এদের নিয়ে মৌলিক কণিকার আলাদা একটা মডেল গড়া হলো, যার নাম স্ট্যান্ডার্ড মডেল।
চিত্রঃ স্ট্যান্ডার্ড মডেল

এই মডেল অনুযায়ী পার্টিকেল দুই প্রকার, ফারমিয়ন আর বোসন। ফারমিয়নদের স্পিন ১/২ গুণিতক, আর বোসনরা পূর্ণ সংখ্যার গুণিতক। এই ফারমিয়ন আবার দুই প্রকার, কোয়ার্ক আর লেপ্টন। কোয়ার্ক দ্বারা গঠিত কনাদের হ্যাড্রন বলে যেমনঃ প্রোটন, নিউট্রন আর মেসন। বোসন গুলো সাধারণত ফোর্স বা মৌলিক বলের বাহক কণা। [Strong Neuclear - gluon, Weak Neuclear - w/z boson, electromagnetic- photon আর প্রস্তাবিত মহাকর্ষ বলের বাহক graviton] 
[ এই স্পিন কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে স্পিন বলতে যা বোঝেন তা নয়, এই স্পিনের ব্যাখ্যায় অনেকের মাথাটা স্পিন করে, তাই বিস্তারিত ব্যাখ্যায় গেলাম না , গ্রুপে সার্চ করলে এর ব্যাপারে বিস্তারিত পাবেন, খালি জেনে রাখুন এটা কনাদের একটা অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য, একেজনের স্পিন দেখে চেনা যায় কোনটা কোন কণা। ]

সুইজারল্যান্ডে সার্নের LHC: Large Hadron Collider এর কাজ নিশ্চয়ই এখন কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন, এরা হ্যড্রনদের মাঝে সংঘর্ষ বা কলিশন ঘটায়। হ্যড্রনদের মাঝে সংঘর্ষে উৎপন্ন হয় তাদের গঠনকারী কণা আর বোসন। এই সার্নের গবেষণায় পাওয়া যায় নতুন বোসন হিগস-বোসন। তাত্ত্বিকভাবে যার ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল আগেই। এই Standard Model থিওরি ব্যবহার করে পার্টিকেল ফিজিসিস্টরা একের পর এক নতুন পার্টিকেল আবিষ্কার করে যাচ্ছিলেন, পদার্থবিজ্ঞানের অনেক পুরনো কিছু সমস্যার সমাধানও বের হল এর হাত ধরে। তবুও বহুদিন ধরেই বোঝা যাচ্ছিল যে স্ট্যান্ডার্ড মডেল একটি পূর্ণাঙ্গ থিওরি নয়, এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ডার্ক ম্যাটার , ব্যারিয়নিক অ্যাসিমেট্রি , গ্র্যভিটির মতন টপিকগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড মডেল ব্যাখ্যা করতে পারে না। তাই স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে ছাড়িয়ে যে পদার্থবিজ্ঞান আছে তা বের করার বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা বহুদিনের।
চিত্রঃ মিউয়ন জি২ এর ম্যাকানিজম      

মিউয়নের ভ্রামক নিয়ে ভ্রম

ফারমিল্যাবের নতুন এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীরা এতটা উদগ্রীব এর কারণ, এই পরীক্ষায় তারা পরিমাপ করছেন মিউয়নের Magnetic Moment (চৌম্বক ভ্রামক) যার মাঝে লুকিয়ে আছে মহাবিশ্বের অনেক গোপন রহস্য।
প্রায় এক শতক আগে, পদার্থবিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন যে মৌলিক কণাগুলোর ম্যাগনেটিক মোমেন্ট বড় আকারের বস্তুর মতই হবে। চুম্বক ক্ষেত্রে রাখা হলে তা ঘুরবে, চুম্বক ক্ষেত্র সরিয়ে নিলে আগের অবস্থানে ফিরে আসবে। কিন্তু পরীক্ষায় দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র, ইলেকট্রন একটি চুম্বক ক্ষেত্রে যতটুকু ঘোরার কথা তার থেকে দ্বিগুণ ঘুরে। কণার এই “gyromagnetic ratio” বা “g-Factor” তাহলে হলো ২ । 
চিত্রঃ স্ট্যান্ডার্ড ডিভিয়েশন

তাত্ত্বিকভাবে ক্যাল্কুলেশন করেও দেখা যায় তাই।
এর বহু বছর পড়ে ১৯৪৭ সালে হেনরি ফোলি ইলেকট্রনের g-factor আরও সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করে দেখেন তা ২.০০২৩২। প্রায় সাথে সাথেই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী জুলিয়ান সুইঙ্গার এর ব্যাখ্যা দেন। তিনি দেখান এই অতিরিক্ত অংশটা আসছে ইলেকট্রনের ফোটন শোষণ আর বিকিরণের কারণে। ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থানে পরীক্ষা চালালেও এই অসঙ্গতি পাওয়া যায় যার কারণ কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এর কারণে শূন্যস্থানে ক্ষণিকের জন্য particle(কণা) আর antiparticle(প্রতিকনার) জন্ম হয় যাদের সাথে ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়া ঘটে। সহজ ভাষায় এই ভার্চুয়াল কণাগুলো ইলেকট্রন বা অন্যন্য কণাদের একটু দোলা দেয়, যার ফলে কণাগুলো থিওরেটিক্যাল ভ্যালুর থেকে হালকা একটু বেশিই ঘুরে। এই অতিরিক্ত মান বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় কোন কণা এই দুলুনি দিয়ে গেছে, তাই এই দশমিক মানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাল্কুলেশনে এর মাধ্যমে বের হয়ে আসে অনেক অজানা কণা।

মিউয়ন হল লেপ্টন পরিবারের ভারী সদস্য। ইলেকট্রনের পেটমোটা কাজিন। এরা ভারী হবার কারণে বেশিক্ষণ টেকেও না, ক্ষয় হয়ে ইলেকট্রন এবং নিউট্রিনোতে পরিণত হয়।

 ভারী হবার কারণে সে অন্যন্য ভারী কণার সাথে মিথস্ক্রিয়া করবে সেটা স্বাভাবিক। তাই ডার্ক ম্যটার, ডার্ক এনার্জি যেখানে মহাবিশ্বের ৯৫% ভর পুঞ্জিভূত, সুপারসিমেট্রির মতন নতুন ফিজিক্সের জন্য অনেক রহস্যের জাল ভেদ করা সম্ভব হতে পারে এই মিউয়নের g-factor পরিমাপ এবং তার অতিরিক্ত অংশের হিসাব।
                           

বিজ্ঞানের বড় ভুলঃ প্লাসে মাইনাসে গণ্ডগোল 

মিউয়নের ম্যগ্নেটিক মোমেন্ট নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছিল সেই ১৯৫০ সাল থেকেই। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়, সার্নের মত বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিল। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে আরও সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর যন্ত্র দিয়ে গবেষণা করা হচ্ছিল। ১৯৯০ সালে ব্রুকহেভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি একটি ম্যাগনেটিক রিং দিয়ে মিউয়নের উপর গবেষণা শুরু করে। এক্সপেরিমেন্টে একটি ৫০ ফুট প্রশস্ত বৃত্তাকার ম্যাগনেটিক টিউবের মধ্যে দিয়ে মিউয়ন নিক্ষেপ করা হয়। নিক্ষেপকৃত মিউয়ন গুলো সেই রিং আকারের ম্যাগনেটিক টিউবের ভিতর দিয়ে ঘুরতে থাকে। ২০০১ সালে তারা প্রথম সাফল্য পান। এক্সপেরিমেন্টে তারা জি-ফ্যাক্টর এর মান পান 2.0023318404। সেই সময়ও এই খবর নিয়ে মিডিয়াতে তোলপাড় লেগে গিয়েছিল। ব্রুকহেভেনের এই এক্সপেরিমেন্টের পাওয়া মান প্রত্যাশিত দশমিক মানের থেকে তিন গুন বেশি তফাৎ পাওয়া গেল। যাকে বলে তিন সিগমা পার্থক্য।
 
যারা এখনো ছোট ক্লাসে পড়, বা যারা বিজ্ঞানের বাইরে তাদের জন্যঃ এই সিগমা σ,  কে বলে স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন। σ এর বর্গকে বলা হয় ভ্যারিয়েন্স৷ যে কোনও এক্সপেরিমেন্টে প্রচুর ডাটা কালেকশন করা হয়। এই ডাটা গুলোর মধ্যে হালকা পার্থক্য থাকবেই, বাইরের কোনও প্রভাবকের প্রভাবে, বা অন্তর্নিহিত কোনও ঘটনার কারণে মানের হালকা কম বেশি হতে পারে। স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন করে বিজ্ঞানীরা তাদের ডাটা সেটের ত্রুটির পরিমাণটা নির্ণয় করেন। নীচে যে উদাহরণ গ্রাফটি দেখছেন তাকে বেল কার্ভ বলে। পরিসংখ্যানে ডাটা স্যাম্পল ডিস্ট্রিবিউশন বা ডাটা বিন্যাস তাদের গড় বরাবর হয় । ডাটার গড় প্রত্যাশিত মানের কাছাকাছি হয় তাই গ্রাফে তাকে ০ ধরা হয়। ০ থেকে যত সরে যাবে মানে ডিভিয়েট হবে তার ভুলের সম্ভাবনা তত বেশী। 

যদি এক্সপেরিমেন্ট বার বার রিপিট করেও দেখা যায় সিগমা পার্থক্য প্রত্যাশিত তাত্ত্বিক মানের কাছেই, তাহলে ধরে নেওয়া হয় এক্সপেরিমেন্টেও কোনো সমস্যা নেই, থিওরিও ঠিক আছে। এই মান সাধারণত সিগমা-১ রাখা হয়। 
কিন্তু বিজ্ঞানীরা এত সহজেও কোনও থিওরিকে পার পেতে দেন না, তারা ভুল পেলে উল্টো খুশিই হন। কারণ ভুল থেকে বের হয়ে আসতে পারে দারুন কিছু। যদি এক্সপেরিমেন্ট বার বার রিপিট করে দেখা যায় সিগমা পার্থক্য একটা নির্দিষ্ট গুণিতক বেশি আসছে, তবে সহজেই বলে দেওয়া যায় নির্দিষ্ট কিছু একটা এক্সপেরিমেন্টে প্রভাব ফেলছে, অথবা থিওরিতে কোথাও ভুল হচ্ছে। সাধারণত এটা ধরা হয় যখন বার বার রিপিটেও সিগমা ৫ এর বেশি পার্থক্য পাওয়া যায়।  প্রথম বর্ষে একবার পারদের পৃষ্ঠটান বের করার এক্সপেরিমেন্টে আমি আর আর আমার ল্যাব পার্টনার হিসাবে গোঁজামিল দিয়ে সিগমা ৫ ডিফারেন্স এনেছিলাম , কোনও হেডলাইন হয়নাই, টিচারের ঝাড়ি খাইছি শুধু। 
 
ব্রুকহেভেনের এই আবিষ্কারের এক বছরের মাথায় আরেক গ্রুপ বিজ্ঞানীরা ব্রুকহেভেনের মস্ত বড় ভুল ধরে বসলেন, কম্পিউটারে ইনপুট করার সময় দশ হাজারের বেশি একটি ডাটা সেটের ফর্মুলাতে ভুল করে প্লাসের যায়গায় মাইনাসে চাপ পড়ে গিয়েছিল। যার সংশোধন করে নতুন ক্যাল্কুলেশনে এরর ডিফারেন্স নেমে এল সিগমা-২ তে। যা আসলে তেমন কিছুইনা। তাই ব্রুকহেভেনের এক্সপেরিমেন্ট মূল উদ্দেশ্যে পৌঁছাতে আরও কয়েক বছর পিছিয়ে গেল। পরের পাঁচ বছর তারা হাজার হাজার বার এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে সিগমা-৫ পার্থক্য আনতে পারেননি, তবে এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে মিউয়নের জি-ফ্যাক্টর অন্য সব জানা ফ্লাকচুয়েশনকে হিসাবে আনলেও তার থেকে আসলেই বেশী আসছে। তাই মিউয়ন নিয়ে আরও সূক্ষ্মতর গবেষণার প্রয়োজন হয়।
ভেবে একটু হাঁফ ছাড়ুন প্লাস মাইনাস নিয়ে গণ্ডগোল শুধু আমার আপনার না, নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানীরাও করেন। 
 

ফারমিল্যাবে যাত্রা

ব্রুকহেভেন টিমের কাছে শক্তিশালী ম্যাগনেটিক রিং থাকলেও ভালো মিউয়ন সোর্স ছিলনা। ওদিকে ইলিনয়তে ফারমিল্যাব মিউয়ন নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণার জন্য শক্তিশালী মিউয়ন বীম তৈরি করে। ২০১৩ সালে তাই নতুন ম্যাগনেটিক রিং বানানোর ঝামেলায় না গিয়ে ব্রুকহেভেনের ৭০০ টনের ম্যাগনেটিক রিংটি জাহাজে চড়ে মিসিসিপি নদী হয়ে ফারমিল্যাব পৌঁছায়। গত আট বছর ধরে ফারমিল্যাবে এই এক্সপেরিমেন্ট চলছে, তাদের এই গবেষণা ব্রুকহেভেনের থেকে ৪ গুন বেশী সূক্ষ্মতর ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। 
 

ফারমিল্যাবের এই ডাটা আন্তর্জাতিকভাবে প্রায় ১৩২জন পদার্থবিদের একটি দল ক্যাল্কুলেশন করেন। সকল র‍্যান্ডম নয়েজ, প্রভাবক, অসঙ্গতি আর পদার্থবিজ্ঞানের অন্যন্য ঘটনার হিসেব নিয়ে দেখা যায় যে সূক্ষ্মতর সিগমা- ৪.২ মানের, আশা করা যাচ্ছে শীঘ্রই পাওয়া যাবে সেই সিগমা-৫। এর মানে মিউয়নের দুলুনি বলছে আমাদের চোখের সামনে আসলেই অজানা একটা কিছু আছে, পারটিকেল বা ফোর্স যা মিউয়নকে এই দোলা দিয়ে যাচ্ছে।
 

তবে ফারমিল্যাবের বিজ্ঞানীরা যখন উল্লাসে মগ্ন তখনই আসল নতুন খবর, আরেকদল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, জার্মানিতে অবস্থিত তাদের সুপার কম্পিউটার জুয়েলস দিয়ে ক্যাল্কুলেশন করে দেখালেন যে মিউনের জি-ফ্যাক্টর এর এই অতিরিক্ত মান স্ট্যান্ডার্ড মডেলে দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়, এর বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ইউরোপিয়ান এই পদার্থবিজ্ঞানের গবেষকদলের নাম BMW(Budapest, Marseille and Wuppertal)।
তাদের রিসার্চ পেপারটিও সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে নেচার জার্নালে। 

হ্যাড্রন নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই

২০১৬ সালে থিওরি ইনিশিয়েটিভ গঠিত হয়। বিশ্বজুড়ে নামীদামী পদার্থবিদ, গণিতজ্ঞদের এই সংগঠনের প্রচেষ্টা হলো সবাই মিলে পদার্থবিজ্ঞানের থিওরিগুলোকে আরও নিখুঁত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। থিওরি ইনিশিয়েটিভের পদার্থবিজ্ঞানীরা স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুযায়ী সকল প্রভাবকের হিসেব ধরে দেখান যে মিউয়নের জি-ফ্যাক্টর 2.0023318362। ব্রুকহেভেনের রেজাল্টের সাথে যার ৩.৭ সিগমা পার্থক্য রয়েছে ।
 
মৌলিক কণা নিয়ে কাজ করতে গেলে আরেকটা বিষয় হিসাবে আসবেই, তা হল অনিশ্চয়তা। অনিশ্চয়তা নীতির কারণে কোয়ান্টাম ঘটনাগুলি পরিমাপ করতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। মিউয়নের ম্যাগনেটিক মোমেন্ট নিয়ে যে অনিশ্চয়তা দেখা যায় তা প্রায় পুরোপুরিই হ্যাড্রন কণিকাদের জন্য। হ্যাড্রনগুলো কোয়ার্কের তৈরি। কোয়ার্ক গুলো অনুভব করে Strong Neuclear Force (সবল নিউক্লীয় বল), মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বল, যা পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কণাগুলোকে ধরে রাখে। এই বল এতই শক্তিশালী যে কোয়ার্কগুলো যেন একটা ফেভিকল আঠার সমুদ্রে সাঁতার কাটছে, এবং এই আঠার সমুদ্র যেন অসীম সংখ্যক অন্যন্য কণা দ্বারা ঠাঁসা। তাই পরীক্ষার সময় হ্যাড্রনের হিসাবটা নিখুঁতভাবে এখনো করা সম্ভব হয়নি।   

আর কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের ফলে মিউয়নের সাথে হ্যাড্রনদের প্রায়ই মিথস্ক্রিয়া ঘটে। একটি মিউয়ন হয়ত র‍্যান্ডম ফোটন বিকিরন করল, যা ক্ষণিকের জন্য একটি হ্যাড্রন-অ্যাান্টি হ্যাড্রন জোড়া সৃষ্টি করে, যারা সংঘর্ষে একে অপরকে নির্মূল করে আবার ফোটন উৎপন্ন করে। মিউয়ন আবার সেই ফোটন শোষণ করে। এই প্রক্রিয়ার নাম হ্যাড্রনিক ভ্যাকিউয়াম পলারাইজেশন। এই প্রক্রিয়া মিউয়নের জি-ফ্যাক্টর কে একটু হালকা বৃদ্ধি করে, যা দশমিকের সাত ঘরের পরে যোগ হয়। এর হিসাব অনেক জটিল, বিভিন্ন রকমের হ্যাড্রন জোড়ার জন্য আলাদা আলাদা হিসাব করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে অনেক জটিল আর শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার এর দ্বারা এইসব ক্যাল্কুলেশন অনেক দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করা যাচ্ছে। এখন আর ভুল করে প্লাসের যায়গায় মাইনাস ইনপুট দেবার ভয় নেই।
 
BMW এর রিসার্চ টিম জুলিখ, বুদাপেস্ট আর উপারটাল এ অবস্থিত অনেকগুলো সুপার কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে এই ক্যাল্কুলেশন করেন। মিলিয়ন মিলিয়ন ডাটা ক্রাঞ্চিং এর পরে তারা দেখতে পান সবরকম কোয়ান্টাম ঘটনা গণনায় নিয়ে, বিশেষ করে হ্যাড্রনিক ভ্যাকিউয়াম পলারাইজেশন এর হিসাব করে মিউয়নের জি-ফ্যাক্টরের মান পাওয়া যায় 2.00233183908। যা ব্রুকহেভেনের পূর্বের পাওয়া মানের সাথেই সম্মতি প্রকাশ করে।
চিত্রঃ জুলিখের সুপারকম্পিউটার 

ফারমিল্যাবের ফলাফল

থিওরি ইনিশিয়েটিভ অবশ্য এখনো বিএমডব্লিউ এর এই ফলাফল গ্রহণ করেনি। বিএমডব্লিউ এর ক্যালকুলেশন কিন্তু পুরোপুরি থিওরেটিক্যাল, আগের এক্সপেরিমেন্টগুলোর ডাটার উপর নির্ভরশীল। আর ফারমিল্যাবের ডাটা সূক্ষ্ম এক্সপেরিমেন্টে সংগৃহীত , আর মনে রাখবেন তাদের মিউয়ন বীম বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী। থিওরি ইনিশিয়েটিভ আরও কিছু ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এরকম ডাটা ক্রাঞ্চিং এর ফলাফল দেখার অপেক্ষায় আছেন। কারণ বিজ্ঞানে কোনও একজনের কথায় চলেনা, থিওরেটিকাল ক্যাল্কুলেশন আর এক্সপেরিমেন্ট যদি অন্য কেউ রিপিট না করতে পারে তাহলে তাতে গড়বড় আছে স্বাভাবিক।  

বিএমডব্লিউ ঠিক হলে, গত বিশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা আসলেই ভুল পথে এগিয়েছেন, সেক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের রহস্যগুলোর জট ছাড়াতে স্ট্যান্ডার্ড মডেল ছাড়িয়ে যে সকল প্রস্তাবিত হাইপথিসিস ছিল তাদের হয়তো নতুন করে সাজাতে হবে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে সাথে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। আর ফারমিল্যাবের এক্সপেরিমেন্ট ডাটা সঠিক হলে খুলে যাবে অজানা এক নতুন দুয়ার। এখন পর্যন্ত ধারানা করা হচ্ছে এই অতিরিক্ত দশমিক স্থানের ডাটার ভেতর লুকিয়ে আছে একটি বোসন, যার অর্থ হচ্ছে এখানে কাজ করছে অদৃশ্য কোনও বল ! 

ফারমিল্যাব ২০২২ সাল পর্যন্ত তাদের এই সাম্প্রতিক পাওয়া ফলাফল নিয়ে আরও গভীর গবেষণা চালাতে যাচ্ছে, সাথে যুক্ত হচ্ছে সার্ন এবং অন্যন্য প্রতিষ্ঠান। এর পরবর্তী কি ঘটে তা জানতে আসলে আমাদের আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে প্রযুক্তি যেভাবে এগোচ্ছে, আমরা দেখতে পারছি আরও সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর আবিষ্কার। মহাবিশ্বের রহস্যে ঢাকা পর্দার নীচ থেকে ধীরে ধীরে উঁকি দিচ্ছে উত্তর। 

আনন্দ মুহিত,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad

Below Post Ad

advertise