ভুমিকা
গ্রিক সভ্যতার গৌরব সম্পূর্ণ ম্লান না হওয়ার পূর্বেই, ইউরোপের টাইবার নদীর তীর থেকে রোমান সভ্যতা গড়ে ওঠা শুরু করে। গ্রিক সভ্যতায় যখন চলছে স্বর্ণযুগ, তখনই শুরু হয় রোমান সভ্যতার যাত্রা। আর এই সভ্যতা টিকে থাকে প্রায় ১০০০ বছর। রোমান সভ্যতাই ছিলো প্রাচীন ইতিহাসের শেষ নগর সভ্যতা। এই সভ্যতার পতনের মাধ্যমেই প্রাচীন বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসের ইতি টানা হয়। অতঃপর, ইউরোপে সূচনা ঘটে অন্ধকার যুগের এবং শুরু হয় মধ্যযুগের যাত্রা।
আমরা প্রায় সবাই রোমান সংখ্যা'র নাম শুনেছি, ব্যবহারও করেছি, এমনকি এখনো করছি। এ হলো রোমানদের সংখ্যাব্যবস্থা। কিন্তু ক'জনই বা ভেবে দেখেছি সেকালের রোমান সভ্যতার কথা? বিশেষ করে তাদের বিজ্ঞান ও গণিতের কথা?
এ প্রবন্ধে আমরা সংক্ষেপে জানবো কেমন ছিলো রোমান আমলে বিজ্ঞান, বিশেষ করে তখনকার গণিত চর্চা নিয়ে, সংখ্যা নিয়ে এবং পরিশেষে জানবো সকলের পরিচিত রোমান সংখ্যা নিয়ে।
রোমানদের বিজ্ঞান
প্রাচীন সভ্যতার বিজ্ঞানের ইতিহাস পাঠ করতে গেলেই আমাদের চোখে স্বমহিমায় জ্বলে ওঠেন সেই জাতির নানান গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ও বিজ্ঞানী। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, রোমের ক্ষেত্রে ব্যপারটি ব্যতিক্রম। সেখানে নেই অ্যারিস্টটলের মতো দার্শনিক, হিপার্কাসের মতো জ্যোতির্বিদ কিংবা হিপোক্রেটিসের মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তার ওপর, রোমান আমলে যাঁরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের কেউই রোমান নন। তাঁরা ছিলেন গ্রিক।
তবে, এ কথা মূলত তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, ফলিত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নয়। বিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিক গুলোতে রোমানদের অবদান লক্ষণীয়। যেমন: গণিতে উদাসীন হলেও, রোমানরা যন্ত্রবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও ভেষজ ইত্যাদি বিষয়ে ঠিকই আগ্রহী ছিল।
বিজ্ঞানে অমনোযোগী থাকলেও রাষ্ট্র-পরিচালনা, আইন-প্রণয়ন, সাহিত্য, ইতিহাস-রচনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে রোমানরা বেশ মনোযোগী ছিলেন। এসব ক্ষেত্রে রোমানরা তাদের প্রতিভার অপূর্ব বিকাশ দেখিয়েছেন।
ইতিহাসে দেখা যায় শক্তিতে কোনো সুসভ্য দেশ পরাজিত হলেও কৃষ্টি-সভ্যতার ক্ষেত্রে বিজিত দেশই বিজয়ী দেশকে পরাজিত করেছে। ফলে বিজয়ী দেশ বিজিত দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে। আবার, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত জাতির কাছ থেকে অনুন্নত জাতিরা জ্ঞানার্জন করেছে। ফলে, গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি যেমন ছিলো ব্যাবিলনীয় ও মিশরীয় বিজ্ঞান, ঠিক তেমনি রোমানদেরও ভিত্তি ছিলো গ্রিক।
সাহিত্য, স্থাপত্য এসবের সাথে করে গ্রিকরা তাদের বিজ্ঞান ও দর্শনও রোমে নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু হায়! বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রোমানরা নতুন করে তো কিছু করতেই পারেনি, উল্টো পূর্বের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেও তারা ছিলেন উদাসীন। তবে, সেকালের ইতিহাস বিবেচনায় নানান সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কেনো বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রোমানদের এতো দৈন্য-দুর্দশা?
অনেক ইতিহাসবিদ বলে থাকেন, রোমান সম্রাটেরা যুদ্ধবিগ্রহ, সাম্রাজ্য বিস্তার ও শাসনে প্রবল মনোযোগী হওয়ায় বিজ্ঞানের দিকে অমনোযোগী হয়ে ওঠে। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য রোমানদের চারদিক খোলা ছিলো। ফলে নানান আক্রমণকারীর দল তাদের আক্রমণ করতে আসতো। আর তাই, রোমের স্থায়ী আদিবাসীদের সাথে ভিনদেশিদের সংঘর্ষ লেগে থাকতো বিধায় অভিজ্ঞতার ফলে রোমানরা ধীরে ধীরে যোদ্ধা জাতিতে পরিণত হয়েছিলো। কিন্তু, এসবের মধ্যেও তো আমরা দেখি তাদের অপূর্ব সাহিত্য চর্চা, ইতিহাস রচনা কিংবা আকর্ষণীয় শিল্পকলা! তাসত্ত্বেও বিজ্ঞান চর্চায় রোমানদের এতো করুণ দশা কেনো?
এর কারণ, জাতিগত ভাবে রোমানরা ছিলো বাস্তববাদী। সম্পূর্ণ ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন জাতি। ভাব ও কল্পনাপ্রবণতার অভাব তাদের ভেতর লক্ষণীয়। ফলে, বিজ্ঞান এবং দর্শন উভয় ক্ষেত্রেই তাদের এ দুর্দশা। এজন্যই রোমে বিজ্ঞান চর্চার মূল ছিলো ফলিত বিজ্ঞান এবং দর্শনের ক্ষেত্রে ছিলো স্টোইক ও এপিকিউরীয় দর্শন। আর, এই দুই দর্শনই একান্তভাবে বাস্তববাদী।
রোমান বিজ্ঞানে রোমান জাতির যে ক'জন অবদান রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন বড়ো প্লিনি (Pliny the Elder)। তিনি Naturalis Historia বা প্রকৃতির ইতিহাস নামে কয়েকটি বিশ্বকোষ রচনা করেছিলেন। এই বিশ্বকোষ প্রায় ৫০০ জন লেখকদের লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছিল। এতে উনার সময় পর্যন্ত আর্জিত সকল প্রকার বিদ্যার কথাই তিনি আলোচনা করেছিলেন। স্টোইক দার্শনিক সিনেকাও বিজ্ঞান বিষয়ক বই লিখেছেন। সেলসাস লিখেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক বই।
ছবি: বড়ো প্লিনি। স্বত্ব: উইকিমিডিয়া কমনস।
কিন্তু, আমরা যেহেতু রোমান আমলের কথা বলছি, তাই জাতিগত রোমান না হলেও, রোমান শাসনামলে যাঁরা বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে ইতালিতে বসবাস করা গ্রিক বিজ্ঞানীদের কথা বলা যেতে পারে। উনাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন — চিকিৎসাবিজ্ঞানী গ্যালেন, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সোরানাস প্রমুখ।
রোমানদের গণিত
আগেই বলেছি গণিতের ব্যাপারে রোমানরা ছিলো উদাসীন। উনারা ইউক্লিড, এ্যাপোলোনিয়াস, আর্কিমিডিস, পিথাগোরাস প্রমুখ গণিতবিদদের গাণিতিক রস গ্রহণে ব্যার্থ। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র রোমান গণিতবিদ বোয়েথিসাসের নাম উল্লেখ করা গেলেও, উপরিউক্ত গণিতবিদদের সাথে উনাকে তুলনায় নেয়া যায় না।
কিন্তু এসবের মাঝে-ও রোমান আমলে গণিত চর্চা থেমে থাকেনি৷ জাতিগত ভাবে রোমানরা তেমন কিছু না করলেও রোমান সাম্রাজ্যের অস্তগত আলেকজেন্দ্রিয়ায় বিজ্ঞান ও গণিত চর্চা অব্যাহত থাকে৷ তবে এ-সব মূলত গ্রিকদের চর্চা, রোমানদের নয়। উনাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক'জন হলেন: প্যাপাস, ডায়োফ্যান্টাস প্রমুখ।
তবে, আলোচনা সীমিত রাখার জন্য আমরা মূলত রোমানদের নিজস্ব গাণিতিক কিছু বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করবো।
• রোমান অ্যাবাকাস: গণনা করার জন্য রোমানদের মধ্যে বহনযোগ্য অ্যাবাকাসের ব্যবহার প্রচলিত ছিলো। নানান প্রকার অ্যাবাকাসের ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়। এ দিয়ে ভগ্নাংশের হিসেবেও করা যেতো। ধাতুর পাতের ওপর সমান্তরাল ভাবে খাঁজ কেটে তার ওপর সহজে উপর-নিচে ওঠা-নামা করানো যেতে পারে এমন বোতাম জাতীয় কিছু থাকতো।
এটি দিয়ে সাধারণ গণিতের কাজগুলো অর্থাৎ যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ সহজেই করা যেতো। কিন্তু, গণনাপদ্ধতি বেশ জটিল ছিলো। এই কাজে অভিজ্ঞ গণক লাগতো। তাই, সাধারণ জনগণ কিছু তালিকা মুখস্থ করে রাখতো যাতে ব্যবহারিক কাজে অসুবিধা না হয়।
ছবি: রোমান অ্যাবাকাসের। স্বত্ব: উইকিমিডিয়া কমনস।
• জ্যামিতি: জরিপের কাজে প্রাথমিক জ্যামিতির ব্যবহার তারা জানতো। তাদের জ্যামিতিতে মিশরীয় প্রভাব লক্ষণীয়। তবে, প্রাথমিক হলেও সাম্রাজ্যের জরিপ ও অন্যান্য কাজের জন্য পাটিগণিত ও ব্যবহারিক জ্যামিতিতে রোমানরা উন্নতি সাধন করেছিলো৷ এ-সব উন্নতির ফলে, গ্রিক থেকেও রোমানদের অংক-পাতন ও গণনাপদ্ধতি বেশ সহজ-সরল ছিলো।
• পরিমিতি ও জরিপে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি: রোমান ধ্বংসস্তূপে গ্রোমা নামক একটি যন্ত্র পাওয়া গেছে। জরিপের কাজে এর ব্যপক ব্যবহার ছিলো। সাধারণত, আয়তক্ষেত্রাকার নগর, গ্রাম কিংবা কৃষিক্ষেত্রের জন্য এটির ব্যবহার প্রচলিত ছিলো।
দূরত্ব নির্ণয়ে হোডোমিটার নামক এক যন্ত্রের ব্যবহার ছিলো। এর সাহায্যে নদীর প্রস্থ বা অন্য কোনো স্থানের দূরত্ব সহজে নির্ণয় করা যেতো।
ওজন-যন্ত্র, কপি, ক্রেণ প্রভৃতি যন্ত্রের সাথেও রোমানরা সুপরিচিত ছিলো। এসব যন্ত্র কিভাবে কাজ করতো তা জানার পাশাপাশি, এসব যন্ত্রের উন্নতিও রোমানদের হাতে হয়েছিল।
তবে, গণিত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথম দিকেই চলে আসে সংখ্যার কথা। এক্ষেত্রে রোমানদের সংখ্যা লিখন পদ্ধতি অর্থাৎ রোমান সংখ্যা রোমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব। এ নিয়ে আমরা একটু পরেই আলোচনা করবো।
সংখ্যার উদ্ভব ও বিকাশ
রোমের সংখ্যাব্যবস্থা নিয়ে বিশেষ ভাবে আলোচনা শুরুর পূর্বে, সংখ্যার জন্ম ও বিকাশ নিয়ে হালকা ধারণা থাকলে সুবিধা হবে। ফলে, এ প্রসঙ্গে ছোট করে আলোচনা করা যায়।
এ কথার সাথে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না যে, গণনার থেকেই বর্তমান গণিতের জন্ম। প্রাচীন প্রস্তর যুগের গুহাবাসী মানুষদের সময় হয়তো এক-দুই পর্যন্ত গণনা প্রচলিত ছিলো। কিন্তু সেসময়কার (এবং এরো কিছু পরের সময়কার) গণনা মূলত বস্তুর সাথে সম্পর্কিত গণনা, বিশুদ্ধ সংখ্যার ধারণা নয়। ব্যপারটা উদাহরণের মাধ্যমে দেখা যাক। এই যেমন আমরা কোনো কিছু ছাড়াই যখন শুধু এক (১) বলি বা উচ্চারণ করি তখন মনে মনে প্রথমে ১ এর চিহ্ন যেমন কল্পনা করি (মনে রাখতে হবে, তখনও সংখ্যার চিহ্ন বা সংখ্যার লিখন পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়নি), ঠিক সেভাবে ১ জিনিসটি অনুভব করি। এক্ষেত্রে কোনো বস্তু থাকা বা না থাকার প্রয়োজন নেই। এ হলো বস্তু-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ সংখ্যার ধারণা। কিন্তু, বস্তুযোগে ধারণার উদাহরণ হলো — একটি গাছ, এক হাঁড়ি রসগোল্লা, গরুর চারটি পা ইত্যাদি।
তো যা বলছিলাম, প্রথমে ছিলো বস্তুর সাথে সম্পর্কিত গণনা। এর অনেক পরে এলো বস্তু-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ সংখ্যার ধারণা। তবে, এক্ষেত্রে সংখ্যা নির্দেশ করে এমন শব্দের (যেমন: এক, দুই — এরা হলো শব্দ এবং ১,২ — এরা হলো সংখ্যা) সংখ্যা ছিল মাত্র অল্প ক'টি। ফলে, বড়ো বড়ো সংখ্যা নির্দেশ করতে প্রথমে যোগ, তারপর ক্রমে ক্রমে গুণ ও যোগের সাহায্য নেয়া হতো। এর জন্য অস্ট্রেলিয়ান গোত্র মারে রিভার উদাহরণ দেয়া যায়। যথা: এনিয়া (এক), পেচেভাল (দুই), পেচেভাল-এনিয়া (তিন), পেচেভাল-পেচেভাল (চার)।
লক্ষ করলেই দেখতে পারবেন এখানে, এনিয়া (১) ও পেচেভাল (২) এই দুই সংখ্যা নির্দেশক শব্দ ব্যবহার করে এদের চেয়ে বড়ো সংখ্যা তৈরি করেছে যোগ করে। এখানে পেচেভাল-এনিয়া (৩) মানে ২ ও ১ এর যোগফল ৩ এবং পেচেভাল-পেচেভাল (৪) মানে হলো ২ ও ২ এর যোগফল বা গুণফল ৪।
ছবি: ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা। স্বত্ব: The History Of Mathematics।
তারপর সময়ের সাথে যখন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে থাকে, তখন সংখ্যার ধারণা আরো স্পষ্ট হতে শুরু করে। নানান প্রকার গণনা পদ্ধতিও উদ্ভাবন হতে থাকে। যেমন: দশমিকের নিয়ম, কুড়ি, কড়া, গণ্ডা, ডজনের নিয়ম, বিশ-ভিত্তিক গণনা, ষাট-ভিত্তিক গণনা ইত্যাদি। আবার দৈর্ঘ, ওজন এ-সব ব্যবহারিক জিনিসের সাথে জড়িত যথা: দৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে — হাত, ফিট, সুতা ইত্যাদি এবং ওজনের ক্ষেত্রে — গ্রাম, সের, কাঠা ইত্যাদি পদ্ধতি।
তো, গণনার সুবিধার্থে কোনো একসময় উদ্ভাবন হলো সংখ্যা লিখে রাখার পদ্ধতি বা সংখ্যা লিখন পদ্ধতি। বর্ণমালা দিয়ে সংখ্যার নির্দেশ করা শুরু হলো। এক্ষেত্রে একেক জাতির লিখন ও গণনা পদ্ধতি ছিলো একেক রকম। আর এরকম একটি পদ্ধতি হলো রোমানদের ব্যবহৃত সংখ্যা লিখন পদ্ধতি, যাদের আমরা রোমান সংখ্যা বলে থাকি। এখন আমরা রোমান সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করবো।
রোমান সংখ্যাব্যবস্থা
রোমান সংখ্যার সাথে আমরা সবাই কম-বেশি ছোট শ্রেণির বইতে পরিচিত হয়েছি। এদের ব্যবহার করে লিখেছিও। বর্তমানে ব্যবহারিক জীবনে এনালগ ঘড়িতে আমরা এদের দেখা পাই। আবার, বইয়ের শুরুর দিকে কিছু পৃষ্ঠায়, এমনকি বহুনির্বাচনি প্রশ্নেও এর ব্যবহার আমরা দেখি। তাছাড়া, লেখার ক্ষেত্রে লেখাকে সুন্দর করতেও বর্তমানে এর ব্যবহার প্রচলিত। কিন্তু এসব ব্যবহার শুধুই আলংকারিক, গাণিতিক নয়। বর্তমানে এ সংখ্যা ব্যবহার করে অংক কষা হয় না। কিন্তু এই সংখ্যাব্যবস্থা গাণিতিক ও হিসাবনিকাশের ক্ষেত্রেও টিকে ছিলো সুদীর্ঘ সময় ধরে।
ছবি: মস্কো, রাশিয়ায় অবস্থিত রোমান সংখ্যাযুক্ত ঘড়ি। স্বত্ব: উইকিমিডিয়া কমনস।
গ্রিক থেকে অনেক কিছু নিলেও রোমানদের এই সংখ্যা গ্রিক থেকে আসেনি। রোমানদের সংখ্যা লিখন ও ব্যবহারিক জ্যামিতি সম্পর্কে প্রাচীন কালের যেই পরিচয় পাওয়া যায়, তা থেকে বোঝা যায় যে, রোমানরা এ-সব এট্রুস্কানদের থেকে শিখেছে। রোমান সংখ্যাব্যবস্থাও মূলত আসেছে এট্রুস্কানদের থেকে। রোমান সংখ্যার সূত্রপাত কিন্ত এট্রুস্কান আমল থেকেই। এর জন্য আবারো একটু ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে হবে, প্রাচীন ইতালির ইতিহাসের পাতা।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ইতালিতে মানুষের বসবাস ছিলো। নতুন পাথরের যুগে অন্যান্য স্থান থেকে এখানে মানুষ এসে বসবাস করতে শুরু করে। ব্রোঞ্জযুগেও ঘটে বিদেশিদের আগমন। আর এই ধাপেই ইন্দো-ইউরোপীয় জাতি এট্রুস্কানদের আগমন ঘরে। এরা ছিলো কৃষিজীবী। এরাই ইতালিকে গড়ে তুলেছিলো। উত্তর ইতালিতে ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এক ইন্দো-ইয়োরোপীয় জাতি বসতি স্থাপন করে। এনাদের ল্যাটিন বলা হতো৷ উনাদের ভাষাও ল্যাটিন। এই গোষ্ঠীর এক রাজার নাম ছিলো রোমিউলাস। রাজা রোমিউলাস যখন নগর গড়ে তোলেন, তখন সেই নগরের দেয়া হয় রোম। কিন্তু, রোমে নগররাষ্ট্র গড়ে ওঠার আগেই এট্রুস্কানরা এখানে আধিপত্য বিস্তার করেছিলো। ফলে, এদের থেকে রোমানরা সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে নানান নতুন ধারণা লাভ করে। পরবর্তীতে রোমানরা সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে শুরু করে এবং সেই সুবাদে এট্রুস্কানদের পরাজিত করে। এট্রুস্কানদের ব্যবহৃত সংখ্যাপদ্ধতিটিই পরবর্তীতে বিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়ে রোমান সংখ্যাপদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে ।
রোমান সংখ্যাব্যবস্থায় ১, ৫, ১০, ৫০, ১০০, ৫০০, ১০০০ এই সাতটি ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যার জন্য সাতটি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ যথাক্রমে I, V, X, L, C, D, M ব্যবহার করা হয়। বলা বাহুল্য, এ সংখ্যাব্যবস্থায় শূন্য (০) নেই। তবে, শূন্যের সমার্থক হিসেবে nulla শব্দটি ব্যবহার করতো। কিন্তু, এর কোনো গাণিতিক ব্যবহার ছিলো না।
আচ্ছা, আমরা প্রায় সবাই তো টালি চিহ্নের ব্যবহার জানি৷ সেখানে ৪ বোঝাতে ব্যবহার করি IIII এবং ৫ বোঝাতে সরাসরি IIII লিখে কোনাকুনি (/) - এই চিহ্ন দিয়ে কেটে দেই, আবার ১০ বোঝাতে একই কাজ দু'বার করি। রোমান সংখ্যাব্যবস্থায় প্রথম প্রথম চার পর্যন্ত লেখা হতো একের প্রতিক ব্যবহার করে। অর্থাৎ ৪ বোঝাতে চার বার একের প্রতিক, তথা IIII লেখা হতো। কিন্তু ৫ বোঝাতে লেখা হতো V, আর ১০ বোঝাতে X। অনেকটি টালির মতোই ৫ম বারে সংখ্যার প্রতিকটি পাল্টে ৫ এর জন্য V ও ১০ এর জন্য X হয়ে যেতো৷ তবে, বর্তমান টালির মতো গোড়ার দিকে রোমানদের ব্যবস্থা হুবুহু এক ছিলো না। বর্তমানে টালিতে আমরা IIII লিখে (/) - এই চিহ্ন দিয়ে কেটে দিলে সরাসরি ৫ বুঝি। কিন্তু, প্রথম প্রথম রোমানে V দ্বারা সরাসরি ৫ বোঝানো হতো না। উনারা ৫ লিখতেন IIIIV — এভাবে।
কিন্তু, এভাবে বড়ো বড়ো সংখ্যা লেখা ছিলো বেশ ক্লান্তিকর। আর তাই ক্লান্তি কমাতে ও স্থান বাঁচাতে, বড়ো সংখ্যার প্রতিকের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রতিকটি লিখে তার আগে ছোট সংখ্যার প্রতিক ব্যবহার করে ঘাটতি আছে বুঝিয়ে সহজেই হিসেবে করা যেতো। যেমন: ৫ এর প্রতিক V। তাই সরাসরি V লিখলেই ৫ বোঝানো হতো, IIIIV এইভাবে ১,২,৩,৪,৫ লেখার প্রয়োজন নেই। তারপর, এই ৫ এর আগে ১ এর প্রতিক ব্যবহার করে ১ ঘাটতি আছে অর্থাৎ ৪ বোঝানো হতো। অর্থাৎ ৪ বোঝাতে লেখা হতো IV, কষ্ট করে IIII লেখার প্রয়োজন হতো না।
সে কোথায় ৫ বোঝাতে IIIIV লেখা লাগতো, ১০ বোঝাতে IIIIVIIIIX লেখা লাগতো, এখন শুধু V লেখা হলেই ৫ বোঝা যায়! শুধু X লেখা হলেই ১০ বোঝা যায়। ১৫ লিখতে IIIIVIIIIXIIIIV লেখা লাগে না XV (১০+৫ =১৫) লিখলেই চলে, ২০ এর জন্য IIIIVIIIIXIIIIVIIIIX লেখা লাগে না XX (১০+১০ = ২০) লিখলেই হয়ে যায়।
কোথায় সে আগে একের প্রতিক চারবার ব্যবহার করে অর্থাৎ ১+১+১+১ বা IIII এভাবে ৪ লেখা হতো এখন সেখানে ৫-১ বা IV লিখে সহজেই কাজ হয়ে যায়! একই ভাবে ৯ বোঝাতে IX লেখা হয়। এ হলো নতুন রোমান সংখ্যাপদ্ধতি।
এই নিয়মে, "ছোট মানের সংখ্যা নির্দেশ করে এমন বর্ণ বড়ো মানের আগে আসলে, বড়োটি থেকে ছোটোটি বিয়োগ করতে হয়"। — এই কথাটি মনে থাকা চাই। কারণ, এর ফলেই আপনাকে ৩ লিখতে হয় III এভাবে। কিন্তু ৪ লিখতে হয় IV এভাবে, IIII - এভাবে নয়। ৩-কে কেনো IIV লেখা যায় না? কারণ, নিয়মে বলা হয়েছে ছোট মানের বর্ণটি বড়ো মানের বর্ণের আগে আসতে হবে তাই, ৫ বা V যেহেতু বড়ো এবং ৪ এর পরেই ৫, তাই ৫ বা V এর আগে I বসিয়ে ১ কম আছে বা IV (৪) বোঝানো যাবে। কিন্তু ৩ এর ক্ষেত্রে, বড়ো মান ৫ বা V প্রতিকটি দুই ঘর পরে বা ছোট মানের সংখ্যাটি বড়ো মানের দুই ঘর আগে। আর তাই ৩ এর জন্য আমরা IIV লিখতে পারি না। আমাদের তখন III লিখতে হয়। একই কারণে, ৯ এর জন্য IX লেখা গেলেও ৮ এর জন্য VIII লেখা লাগে, IIX লেখা যায় না।
এই নিয়মের ফলেই, ৫০ এর আগে ১০ বসিয়ে (XL) ৪০, ১০০ এর আগে ১০ বসিয়ে (XC) ৯০, ৫০০ এর আগে ১০০ বসিয়ে (CD) ৪০০ এবং ১০০০ এর আগে ১০০ বসিয়ে (CM) ৯০০ লেখা হয়।
এখন একটি বিষয়ে তাকানো যাক। তা হলো — ৪৯ এবং ৯৯ কিভাবে লিখবেন? এক্ষেত্রে কিন্তু ৫০ এর আগে ১ বসিয়ে অর্থাৎ IL এবং ১০০ এর আগে ১ বসিয়ে অর্থাৎ IC লেখার নিয়ম নেই। এক্ষেত্রে ৪৯ কে XLIX (XL মানে ৪০ এবং IX মানে ৯। তাহলে XLIX মানে ৪০+৯ = ৪৯) আবার ৯৯ কে XCIX (XC মানে ৯০ এবং IX মানে ৯। তাহলে XCIX মানে ৯০+৯ = ৯৯) — এভাবে লিখতে হবে।
এবার চলুন, এই আধুনিক বা বর্তমান পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা দুটি বড়ো সংখ্যা লেখার চেষ্টা করি।
ধরা যাক, প্রথমে আমরা ২৩৪৫ সংখ্যাটি রোমানে লিখবো। তো, যদি আমরা এই সংখ্যাটিকে ভেঙে ফেলি তাহলে সবচেয়ে বড়ো ঘর হয় হাজারের। এখানে আছে ২০০০ বা দুই হাজার। তারপর আছে শতকের ঘর। সেখানে আছে ৩০০ তারপর আছে দশকের ঘর। সেখানে আছে ৪০। পরিশেষে আছে এককের ঘর। সেখানে আছে ৫। তাহলে, ২৩৪৫ কে ভেঙে আমরা লিখতে পারি ২০০০+৩০০+৪০+৫ = ২৩৪৫। এখন এদের রোমানে নিয়ে যাই। রোমানে ১০০০ লিখতে হয় একটি M দিয়ে। তাহলে আমরা ২০০০ এর জন্য লিখবো দুটি M বা MM। রোমানে ১০০ লিখতে হয় একটি C দিয়ে। তাই আমরা ৩০০ এর জন্য লিখবো তিনটি C বা CCC। রোমানে ১০ লেখা হয় X দিয়ে। কিন্তু ৪০ এর জন্য আমরা XXXX লেখবো না। কারণটা উপরেই বলেছি। ৪০ এর ১০ পরেই আছে ৫০। আর ৫০ এর জন্য সরাসরি রোমান সংখ্যা-প্রতিক L আছে এবং এটি ৪০ থেকে বড়ো। আবার, ১০-কে সরাসরি লেখা হয় X। আর তাই আমরা সহুজেই ৪০ এর জন্য লেখবো XL (এখানে X হলো ১০ আর L হলো ৫০। তাহলে XL হলো ৫০-১০ = ৪০) এবং পরিশেষে ৫ এর জন্য লিখবো V। তাহলে ২৩৪৫ সংখ্যাটি রোমানে লিখলে হবে MMCCCXLV।
এবার যদি আমরা ১৪৪৯ কে রোমানে লিখতে চাই তাহলে কিভাবে লিখবো? সোজা! ১৪৪৯ কে ভেঙে লেখা যায় ১০০০+৪০০+৪০+৯ = ১৪৪৯। এখন ১০০০ এর জন্য একটি M। ৪০০ এর জন্য CD (কারণ ৪০০ এর পরে ৫০০ যা D দিয়ে প্রকাশ করা হয় এবং ১০০ এর জন্য C ব্যবহার করা হয়। এখানে CD হলো ৫০০-১০০ = ৪০০)। ৪০ এর জন্য XL এবং ৯ এর জন্য IX। তাহলে, ১৪৪৯ সংখ্যাটি রোমানে লিখলে হয় MCDXLIX।
রোমানদের অন্যতম একটি বিশেষত্ব হলো বড়ো সংখ্যা প্রকাশের জন্য কোনো সংখ্যার উপরে ছোট করে সরলরেখা টেনে কিংবা দু'পাশে দাগ দিয়ে তা প্রকাশ করা। সরলরেখা টানলে সেই সংখ্যার ১০০০ গুণ বোঝানো হতো। আর দু'পাশে রেখা টানলে সেই সংখ্যার এক লক্ষ গুণ বোঝাতো। যেমন: |X| দিয়ে বোঝাতো ১০ এর এক লক্ষ গুণ বা ১০×১০০০০০ = ১০০০০০০।
ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনে রোমানদের ভগ্নাংশের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিলো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১২ ভাগের বেশি কোনো জিনিস ভাগ করা লাগতো না। আর তাই, সহজে হিসেবের জন্য ১২ কে হর ধরেই এ ভগ্নাংশ তৈরি করা হয়। এই ভগ্নাংশের ক্ষেত্রে দুটো চিহ্নের ব্যবহার ছিলো। একটি হলো ডট (.) অন্যটি রোমান S। প্রতিটি ডট দিয়ে ১২ ভাগের ১ ভাগ বোঝানো হতো। আর S দিয়ে অর্ধেক বা ১২ ভাগের ৬ ভাগ। অর্থাৎ ভগ্নাংশের হিসাব-নিকাশটি নিম্নরূপ —
. = ১/১২
: = ২/১২
:. = ৩/১২
:: = ৪/১২
::. = ৫/১২
S = ৬/১২
S. = ৭/১২
S: = ৮/১২
S:. = ৯/১২
S:: = ১০/১২
S::. = ১১/১২
সহায়ক গ্রন্থ
১. এ কে এম শাহনাওয়াজ, রোম, প্রথমা প্রকাশন (২০১২)
২. শ্রীসমরেন্দ্রনাথ সেন, বিজ্ঞানের ইতিহাস, দিব্যপ্রকাশ (২০১০)
৩. কাজী মোতাহার হোসেন, গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস, পড়ুয়া (২০১৫)
৪. অভীক রায়, সংখ্যার সাতকাহন, ছায়াবীথি (২০১৪)
হৃদয় হক,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।