লেখকঃ মোহাম্মদ নাইমুর রহমান
(গ্রুপের অনেক ভৌতিক বা আপাত দৃষ্টিতে "অলৌকিক" ঘটনার ব্যাখ্যা প্রায়ই illusion কিংবা hallucination এর কথা দেখা যায়। অনেকেই হয়তো বুঝি, অনেকে বুঝি না আবার কেউ কেউ ভাসা ভাসা বুঝি। এই লেখায় মূলত আমি এই ব্যাপারগুলো যথাসম্ভব সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছি)
🐍 Illusion: সংজ্ঞা অনুসারে ইলিউশন হচ্ছে কোনো উদ্দীপনা (stimuli) এর ভিন্ন বা আংশিক বিকৃত ভাবে অনুধাবন (perception) । যেমন, স্বল্প আলোয় কোনো সাদা কাপড় কে অশরীরী কিছু মনে হওয়া, দড়ি কে সাপ মনে হওয়া, গাছ পালা কিংবা পাহাড় পর্বতকে মানুষ কিংবা অন্য কোন প্রাণীর আকৃতি মনে হওয়া, কোনো স্থির চিত্রকে চলমান মনে হওয়া ইত্যাদি। অপটিক্যাল ইলিউশন সবচে কমন, কমবেশি সবাই এর সাথে পরিচিত এবং এর ভুরি ভুরি উদাহরন ইন্টারনেট এ রয়েছে। সাধারণ অবস্থাতেই ইলিউশন হতে পারে বলে মানসিক রোগ নির্নয় ইলিউশন এর ভূমিকা খুবই কম।
💀Hallucination: ইলিউশন এ বাহ্যিক কোনো উদ্দীপনার উপস্থিতি থাকে, কিন্তু হ্যালুসিনেশন এ কোনো প্রকার বাহ্যিক উদ্দীপনা (stimuli) ছাড়াই কোনো কিছু অনুধাবন বা অনুভব (perception) করা। যেমন, দড়ি বা সাপ সদৃশ কোনো বস্তু ছাড়াই সাপ দেখতে পাওয়া, কোনো মানুষের উপস্থিতি ছাড়াই কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া, কোনো রকম উৎস ছাড়াই কোনো গন্ধ পাওয়া ইত্যাদি। প্রধান ৫ টি ইন্দ্রিয়ের (দৃষ্টি, শ্রবণ, স্বাদ, গন্ধ ও স্পর্শ) সবগুলোতেই হ্যালুসিনেশন হওয়া সম্ভব। সাধারণ অবস্থায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশন হলেও এটি মূলত কোনো নিউরোলজিক্যাল কিংবা সাইকোলজিক্যাল রোগকেই ইঙ্গিত করে। যেমন,
১) visual hallucination হয় সাধারণত ব্রেইন ড্যামেজ, এপিলেপসি বা মৃগী রোগ, recreactional hallucinogenic drug abuse, কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, সিজোফ্রেনিয়া, dissociative ডিসঅর্ডার এ
২) auditory বা শ্রবণ জনিত হ্যালুসিনেশন এর প্রধান কারণ ২টি, সিজোফ্রেনিয়া ও major ডিপ্রেশন।
৩) স্বাদ (gustatory) ও গন্ধের (olfactory) হ্যালুসিনেশন বিরল; সিজোফ্রেনিয়া, temporal lobe epilepsy ও severe depressive ডিসঅর্ডার এ হতে পারে।
৪) স্পর্শ বা tactile হ্যালুসিনেশন দেখা যায় সিজোফ্রেনিয়া, কয়েক ধরনের ডিমেনশিয়া, অ্যালকোহল (বিশেষ করে withdraw করলে) সেবনে। এছাড়া cocaine সেবনকারীদের বিশেষ এক ধরনের হ্যালুসিনেশন হয় যাকে formication বা cocaine bug বলা হয়। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ার নিচে পোকা মাকড় হেঁটে বেড়ানোর অনুভূতি হয়।
এছাড়া সাধারণ যেকোনো মানুষের ঘুমিয়ে পড়ার মুহূর্তে কিংবা ঘুম থেকে জাগ্রত হবার সময়টুকুতে হ্যালুসিনেশন হতে পারে, এদেরকে যথাক্রমে hypnagogic ও hypnopompic হ্যালুসিনেশন বলে। এ ধরনের হ্যালুসিনেশন সাধারনত visual কিংবা অডিটরি ধরনের হয়।
কিন্তু আমরা যে কল্পনায় কোনো কিছু দেখতে পাই, সেটাও তো বাইরের কোনো উদ্দীপনা ছাড়াই। ওদিকে হ্যালুসিনেশন মানেও তো বাইরের উদ্দীপনা ছাড়া কোনো কিছু দেখতে পাওয়া। তাহলে পার্থক্য কি এ দুটোর? কোনো বস্তুর ছবি কল্পনায় দেখা কিংবা কোনো শব্দ বা সুর কল্পনায় শুনতে পাওয়া কে বলে mental imagery, হ্যালুসিনেশন এর সাথে এর পার্থক্য মূলত ২টি,
i) mental imagery সম্পূর্ণ আমাদের ইচ্ছাধীন, ইচ্ছে করলেই আমরা সেটা বন্ধ করতে পারি, কিন্তু হ্যালুসিনেশন আমাদের ইচ্ছাধীন নয়।
ii) কল্পনার ক্ষেত্রে আমরা বুঝতে পারি যে এটার অস্তিত্ব শুধু আমাদের মস্তিষ্কেই, বাস্তবে না। অপরদিকে হ্যালুসিনেশন সম্পূর্ণ বাস্তব বলে মনে হবে। আপনি আপনার প্রিয়/অপ্রিয় কোনো মানুষের কোনো নির্দিষ্ট উক্তি হুবহু কল্পনায় শুনতে পারবেন চাইলেই, কিন্তু কখনো এটা মনে হবে না যে সত্যিকারেই আপনি সেই উক্তিটি "শুনছেন", অন্যদিকে হ্যালুসিনেশন এর ক্ষেত্রে মনে হবে প্রকৃত পক্ষেই কেউ কথা বলছে।
আচ্ছা, যদি এ দুটো জিনিসের মাঝামাঝি কিছু হয়। যেমন, যদি কেউ বাহ্যিক উদ্দীপনা ছাড়াই কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছে কিন্তু সেই সাথে এটাও বুঝতে পারছে যে এটা বাস্তব না, অবাস্তব; কিংবা কেউ হয়তো বুঝতে পারছে যে কোনো শব্দের উৎপত্তি আসলে তার মস্তিষ্কেই, কিন্তু তা সত্বেও সে তা আটকাতে পারছে না, তখন সেটাকে আমরা কি বলবো? এ ধরনের ঘটনাকে বলে pseudohallucination।
💭 Delusion: ইলিউশন ও হ্যালুসিনেশন হচ্ছে পারসেপশন এর সমস্যা, আর delusion হচ্ছে thinking process এর সমস্যা। সংজ্ঞা অনুযায়ী delusion হলো কোনো ভ্রান্ত বিশ্বাস (false belief) যার ৩টি বৈশিষ্ট্য থাকবে,
i) বিশ্বাসটির পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণাদি থাকবে না
ii) বিশ্বাসের বিপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও delusional ব্যক্তি তার বিশ্বাসে অটল থাকবে
iii) সেই নির্দিষ্ট বিশ্বাস, delusional ব্যক্তির শিক্ষা, সংস্কৃতি কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত নয়।
যেমন উদাহরণ হিসেবে persecutory delusion এর কথা বলা যায়। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করে কেউ বা কারা তার অগোচরে তার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র করছে, কোনো রকম জোরালো প্রমাণ ছাড়াই। যদি তাকে যুক্তি, প্রমাণ সহ বোঝানো হয় যে সন্দেহাতীত ভাবেই তার ধারণা ভুল, তবুও সে তার ধারণায় অটল থাকবে। কিন্তু যদি এমন হয় যে, সে যে সমাজ কিংবা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, তারা সবাই একই ধরনের বিশ্বাস ধারণ করে? তবে এক্ষেত্রে আমরা সংজ্ঞা অনুযায়ী সেই ভ্রান্ত বিশ্বাস কে delusion বলতে পারবো না, এর সাইকিয়াট্রিক ভ্যালু নেই।
Delusion অনেক অনেক ধরনের হতে পারে এবং এর কন্টেন্ট অনুযায়ী একেক ধরনের মানসিক রোগ কে নির্দেশ করে। সব বিস্তারিত একটা লেখায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তবে সিজোফ্রেনিয়া, severe depression ও delusional disorder, delusion এর প্রধান কারণ।
সবশেষে একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাক, মনে করি এক ব্যক্তি তার স্ত্রী কে সন্দেহ করে, তেমন কোনো কারণ ছাড়াই, সে তার সন্দেহের পক্ষে যেসকল যুক্তি দেখাচ্ছে তা সবই হাস্যকর এবং কোন প্রমাণ না পেলেও তার বিশ্বাস অটুট ছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে দেখা গেল সত্যিই তার স্ত্রী পরকিয়া করছে। এখন প্রশ্ন হলো তার বিশ্বাসকে কি আমরা delusion বলতে পারবো??
উৎসঃ Shorter oxford textbook of psychiatry
মোহাম্মদ নাইমুর রহমান,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।