মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত (আনন্দ)
দ্বিতীয় পর্ব: গরু তুমি আসো না – শব্দ, পরিভাষা নিয়ে জটিলতা
ক্লাস ৯-১০ এ মুনির চৌধুরীর বাংলা ব্যাকরণ বইটা আমরা সবাই পড়েছি (ইংরেজি মিডিয়ামের হলে পড়ে নিন, বাংলা গ্রামারের জন্য ভালো বই)। সেখানে শব্দের শ্রেণীবিভাগ চ্যাপটারে আমরা পরিচিত হই “রূঢ়ি শব্দ” এর সাথে। রূঢ়ি শব্দ হলো, “প্রত্যয় বা উপসর্গ যোগে মূল শব্দের অর্থের অনুগামী না হয়ে যখন শব্দের নতুন অর্থ প্রকাশ পায়”। উদাহরণ: গো + এষণা = গবেষণা। মূল শব্দের অর্থ গোরু খোঁজা। কিন্তু গভীরতম অর্থ ব্যাপক অধ্যায়ন ও পর্যালোচনা।
আমাদের বাংলার শিক্ষক এই টপিক পড়ানোর সময় মজা করে বলে ছিলেন,
“গো + এষণা = গোরু তুমি আসো না। সারাদিন ধরে খুঁজে মরি, তবু গরুর দেখা পাই না কেন?”
বিজ্ঞান আসলেই বলতে গেলে এই সারাদিন ধরে গোরু খোঁজা। দূরবীন দিয়ে খুঁজতে গিয়ে কখনও দেখতে পাই গরুর শিং, কখনও লেজ, কখনও মাথা। সম্পূর্ণ গরুটা দেখার জন্য ধৈর্য সহকারে বসে থাকা এবং ক্ষণে ক্ষণে দূরবীন আপগ্রেড করা। এই গোরুকে খুঁজতে খুঁজতে অনেকে পার করে দেয় জীবন, যৌবন। গোরুকে খুঁজে পাক না পাক, তাকে খোঁজার মধ্যে যে রয়েছে অদ্ভুত এক আনন্দ। এই গোরু খোঁজার আনন্দটা যারা উপলব্ধি করতে পারে, ধৈর্য ধরতে পারে, তারাই বিজ্ঞানী।
এরকম যুগে যুগে শব্দের অর্থ পাল্টায়, শব্দ বিশেষ অর্থ ধারন করে। ক্লাসিক বা সনাতন ব্যবহার, ব্যাখ্যাকে ফেলে রেখে আধুনিকায়ন হয়।
উপরের এত বড়ো ব্যাকরণ লেকচারের সাথে হেডলাইনের সম্পর্ক কী? বিজ্ঞানীদের মতন একটু ধৈর্য ধরুন। বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে তা জানার আগে আর একটু “ভাষা বিজ্ঞান” এর লেকচার দিব। পরিচিত হব নতুন একটা শব্দের সাথে যাকে বলে “jargon” (জারগন) ।
JARGON কী?
Jargon হলো কোনোও বিশেষ পেশায় ব্যবহৃত বিশেষ শব্দ এবং পরিভাষা সেট যা সাধারণত অন্য অর্থ বহন করে। যারা ঐ পেশার বাইরের এবং উক্ত পেশার Terminology গুলো বুঝবে না তাদেরকে বলা হয় “Layman” বা সাধারন মানুষ ।
যেমন, ইংরেজি “Bar” শব্দটি দেখুন। দৈনন্দিন ব্যবহারে Bar বলতে আমরা বুঝি মদের দোকান/লোহা বা কাঠের খুঁটি । কিন্তু কোর্টরুমে বার হলো আইনজীবী আর জজের বসার স্থান, আর বিজ্ঞানে বার হলো ১০০০০০ প্যাস্কেল চাপ। দৈনন্দিন ব্যবহারে Interest হলো কৌতূহল আর ব্যাংকে Interest হল সুদ।
আশা করি এবার বুঝতে পারছেন জারগন কী। সব রকম প্রফেশনেই কিছু না কিছু জারগন থাকে। সায়েন্সেও প্রচুর জারগন ব্যবহার করা হয়। তবে গোরু খোঁজায় বিজ্ঞানীরা যতটা পারদর্শী নামকরণ ও শব্দ ব্যবহারে ততটা পারদর্শী নন। সাধারন মানুষকে জটিল বৈজ্ঞানিক ঘটনা, গবেষণা ও তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে অনেক উদ্ভট পরিভাষা ধরিয়ে দিতে হয়, যা জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ায়। যেমন সবচেয়ে জনপ্রিয় বিভ্রান্তিগুলো হচ্ছে Law, Theory আর Hypothesis নিয়ে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আর লিখব না গ্রুপে এ বিষয়ে অনেক পোস্ট রয়েছে। (যদি রেস্পন্স পাই তবে সেটা নিয়েও লিখব)
নাইম ভাইয়ের পোস্টের লিংক দিয়ে দিলাম- [https://www.facebook.com/.../permalink/3493355000748144/]
এইরকম আরও কিছু পপুলার কনফিউশন হল:
১। ইলেকট্রন স্পিন (Electron Spin):
না ভাই, ইলেকট্রন আসলে কোনোও গোলাকার বস্তু নয় যে সে লাট্টুর মতো ঘুড়বে । ইলেকট্রন স্পিন নামটা দেওয়া হয়েছিল কারণ ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ আছে। অ্যাম্পিয়ার দেখিয়ে গেছিলেন যে, চলমান চার্জ ম্যাগনেটিক ফিল্ড উৎপন্ন করে। পৃথিবী নিজ অক্ষে ঘুরছে, তার কৌণিক ভরবেগের কারণে সে বিশাল ম্যাগনেটিক ফিল্ড উৎপন্ন করছে। ইলেকট্রন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ম্যাগনেটিক ফিল্ড উৎপন্ন করে, তাই বিজ্ঞানীরা প্রথম দিকে ভেবেছিলেন যে, ইলেকট্রন ছোট্ট একটা গ্রহের মতো, সে নিজ অক্ষে ঘুরছে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, এই কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণ করতে হলে ইলেকট্রনকে আলোর চেয়ে বেশি বেগে ঘুরতে হবে। তাই কৌণিক ভরবেগ থাকলেও ইলেকট্রন আসলে ঘুরছে না। কিন্তু ইলেক্ট্রনের এই বৈশিষ্ট্যর নাম সেই যে 'স্পিন' দেওয়া হয়েছিল তা আর পরিবর্তন করা হয়নি। যা যুগে যুগে আমাদের মতো সাধারন মানুষ এবং ছাত্র ছাত্রীদের বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
[পৃথিবী নিউট্রাল, কিন্তু তার ম্যাগনেটিক ফিল্ড কীভাবে আসে তা অন্য কখনও আলোচনা করব। আপাতত: https://web.ua.es/.../magnet/earths_magnetic_field2.html....]
[ ইলেকট্রন স্পিন কেন স্পিন নয়, তা নিয়ে নাইম ভাইয়ের “চা,কফি আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স” বইটিতে বিস্তারিত আছে।
এ সম্পর্কিত আর্টিকেলের লিংক:
২। ভারী ধাতু (Heavy Metals):
পর্যায় সারণীতে যে ভারী ধাতু গ্রুপের কথা আমরা পড়েছি তারা কি বাস্তবেও ভারী? নাহ, এটা সনাতন নামকরণ। আগে ধাতু বলতে বোঝাতো যা অজনে ভারী, আলোতে চকচক করে, বাড়ি দিলে ঠনঠন শব্দ করে। কিন্তু এখন আমরা ধাতু অধাতুর আসল প্রকৃতি জানি। হীরা হচ্ছে অধাতু কার্বনের ক্রিস্টাল যা যে কোনও ধাতুর চেয়েও শক্ত। আবার লিথিয়াম একটা ধাতু কন্তু তার পারমাণবিক ভর হচ্ছে 6.941 u অন্য দিকে সবচেয়ে ভারী অধাতু আয়ডিনের ভর 126.9 u। তাই বঅঝাই যাচ্ছে এই নামকরণগুলো বিভ্রান্তিকর।
৩। কালার চার্জ (color charge), চার্ম, স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক (Charm,Strange Quarks):
ইলেকট্রন স্পিনের মতই ভুল নামকরণ। এটা কোয়ার্কগুলোর বৈশিষ্ট্য, কোয়ার্কের কোনও রঙ নেই। তারা আসলে Charm বা জাদুবলে মনমুগ্ধ করে না, তারা Strange বা অদ্ভুত নয় ।
৪। ফোটনের ভরবেগ (momentum of photon):
এখানেও বিভ্রান্তি আছে ফোটনের বেগ আছে কিন্তু আসলে ভর নেই। ফোটন একটা ভরহীন কণা।
[নাইম ভাইয়ের পোস্ট: https://www.facebook.com/photo/?fbid=10220776324706141...]
এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ টানা যাবে, যা দিয়ে একটা সম্পূর্ণ বই লিখে ফেলা সম্ভব (কখনও চান্স পেলে লিখে ফেলব)। এই বিভ্রান্তিগুলো অপব্যবহার করে ফায়দা লুটেছেন প্রচুর রাজনীতিবিদ, সংবাদপত্র, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান । তা নিয়ে থাকবে আগামী পর্বে –
হ্যাপি রিডিং
আনন্দ মুহিত
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান