Ads Area

advertise

হেডলাইনের সায়েন্স :: সায়েন্টিফিক জার্নালিজম, আসল সায়েন্স কীভাবে কাজ করে ও “বিজ্ঞান কী বলে”

0

মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত (আনন্দ)



 

প্রথম পর্ব : হেডলাইন কী বলে Vs. বিজ্ঞান কী বলে

         
স্টেশন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। মোবাইলে পত্রিকা পড়ছি, সেখানে হেডলাইন, 

“প্রতিদিন ডিম খেলেই মিলবে ৯ রোগ থেকে মুক্তি!”

         এক ডিম বিক্রেতা ঘুরছেন প্ল্যাটফর্মে।

: “এই ডিম ডিম, ডিম খাবেন ডিম, গরমা গরম ডিম”! রেলের এক সিকিউরিটি গার্ড আরামসে বিড়ি ফুঁকছিলেন এক কোণে।  ডিমওয়ালা তার কাছে গেলেন।

: ডিম খাবেন মামা? হাসের ডিম আছে ভালো।

: আরে ধুরো প্রতিদিন এমন ডিম খাওয়াও, মারবা নাকি আমারে? পত্রিকায় দেখো নাই ডিম খাওয়া সিগারেট খাওয়ার চেয়ে খারাপ? আর তোমরা নকল ডিম খাওয়াও, টেস্ট জানি কেমন কেমন লাগে।

ডিমওয়ালার মুখে সরল হাসি।

: স্যার আমিও টিভিতে দেখছি সবচেয়ে ভালো সকালে ডিম কাঁচা খাইবেন।

: ধুরো যতসব আজগুবি কথা তোমার। আচ্ছা দাও একটা, খিদাও লাগছে ভালো।


উপরের ডিম বিষয়ক জ্ঞান বিনিময়ের টপিকগুলো আমি প্রায় জায়গাতেই দেখি। একবার হেডলাইন বলছে প্রতিদিন ডিম খাওয়ার জন্য আবার বলছে, 

“ডিম খেওনা, সিগারেটের মতন ক্ষতিকর!”
  
       
এরকম কনফিউসিং খবর প্রতিদিন আপনারাও হয়ত ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে, স্বনামধন্য পত্রিকার খবরে বা টিভি চ্যানেলের সংবাদে দেখে থাকবেন। “আপনি কি জানেন” হেডলাইন দিয়ে অথবা রঙচঙা ফন্টে সুন্দর ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে কোনোও রেফারেন্স ছাড়াই এগুলো ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এই হেডলাইনগুলো কি সত্যি?
কেনই বা তারা এমন হেডলাইন প্রকাশ করে? 
সত্যি-মিথ্যা যাচাই করব কীভাবে?
দুই গবেষণা দুইরকম কথা বলছে, কারটা বিশ্বাস করব? 
আমি সাধারন মানুষ, বিজ্ঞান বুঝিনা, আমি কীভাবে বুঝব?

এসব উত্তর দেওয়ার চেষ্টায় বড়োসড়ো একটা আর্টিকেল লিখছি, একটা ডিম খেয়ে নেন, এনার্জি পাবেন।

         
এবার ফিরে আসি সময় নিউজের সংবাদটির বিষয়ে। খবরটা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর। হেডলাইন, “অতিরিক্ত ডিম খাওয়া ধূমপানের চেয়েও ক্ষতিকর!”  খবরটির ইম্প্যাক্ট নিশ্চয়ই ভালো, যেহেতু তা এখান মানুষের সাজেশনে আসছে, ওয়ালে ওয়ালে শেয়ার হচ্ছে। খবরটিতে দাবী করা হয়েছে, “journal of atherosclerosis research” নামে একটি সায়েন্টিফিক জার্নালে লেখাটি প্রকাশিত (সায়েন্টিফিক জার্নাল, পিয়ার রিভিউ নিয়ে অন্য পর্বে)।

         
 Atherosclerosis (অ্যাস্থেরোক্লেরোসিস) হলো artery (ধমনী) এর দেয়ালে ফ্যাট, কোলেস্টেরল, প্লাক জমা। এটা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে নানারকম গবেষণা হচ্ছে। এসব গবেষণার জন্যই আজ আমরা জানি ফ্যাটি ফুড হার্টের জন্য খারাপ, ওয়ার্ক আউট করলে ফ্যাট কমে, ধুমপান আর্টারির জন্য, হার্টের জন্য খারাপ ইত্যাদি। এখন দেখি আমাদের চটকদার হেডলাইন এর গবেষণায় আসল ফলাফল কী এসেছে এবং সায়েন্টিফিক কমিউনিটি কী বলছে, কী করছে। জেনে নেই বিজ্ঞান কী বলে।


১। সময়ের নিউজটি ২০১৯ এর ডিসেম্বরের হলেও অতিরিক্ত ডিম খাওয়া এবং Atherosclerosis এর মাঝে সম্পর্ক নিয়ে সর্বপ্রথম নিউজের উৎস পাই ব্রিটিশ জনপ্রিয় নিউজ পেপার “the daily mail” এর ২০১২ সালের আগস্ট মাসে।  

[সুত্রঃ https://www.dailymail.co.uk/health/article-2188265/Eating-egg-yolks-bad-smoking-speeding-coronary-artery-disease.html?ito=feeds-newsxmlDaily Mail জনপ্রিয় হলেও তাদের বিরুদ্ধে Sensationalism (রঙচঙ মাখিয়ে সংবাদ প্রকাশ) এর অভিযোগ রয়েছে।]

         বিভিন্ন গবেষণার রেজাল্টকে ভিন্ন রূপ দিয়ে নিজেদের সার্থের জন্য তারা অনেক ভুয়া হেডলাইন ছড়িয়েছে যাদের মধ্যে গাঁজা খেলেই স্কিজোফ্রেনিয়া হয়, মোবাইল ফোন ব্যবহারে ব্রেইন ক্যান্সার হয় ইত্যাদি অন্যতম। সম্প্রতি Wikipedia ২০১৭ সাল থেকে Daily Mail -কে source হিসেবে বাদ দিয়েছে , অর্থাৎ উইকিপিডিয়াতে ডেইলি মেইলকে বিশ্বাসযোগ্য রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। 

         প্রতিদিন ডিমের খাওয়া যে সিগারেট খাওয়ার চেয়ে খারাপ এই হেডলাইনটি অতিদ্রুত Vegan Community এর মাঝে জনপ্রিয় হয়ে পরে এবং তা এখনো শেয়ার হয়ে যাচ্ছে।

২। এবার আসি মূল রিসার্চের কথায়। রিসার্চ পেপারটি প্রকাশ করেছে Atherosclerosis-journal, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা প্রকাশের একটি সায়েন্টিফিক জার্নাল।

         গবেষণাটি করেছেন University of Western Ontario's Schulich School of Medicine & Dentistry, London, Canada (হ্যাঁ ভাই এটা কানাডার লন্ডন শহর) এর ডঃ ডেভিড স্পেন্স (J. David Spence)। স্পেন্স তার গবেষণায় হাইপথিসিস দাঁড় করিয়েছেন যে,

 “ডিম নয় , ডিমের কুসুম আসলে আমাদের আর্টারির জন্য সিগারেটের থেকেও বেশি ক্ষতিকর”। 

তাঁর গবেষণায় তিনি তাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১২৩১ জন পেশেন্টের উপর জরিপ চালান এবং তাদের সবার প্লাক বিল্ডআপ দেখতে একটি আলট্রাসাউন্ড করেন।  ডিম নিয়ে গবেষণার আর্টিকেলটির লিংক,

         ডঃ স্পেন্স মোটেও খারাপ গবেষক নন। তার গুগল স্কলার পেজ দেখলেই বুঝবেন অ্যাস্থেরোক্লেরোসিস নিয়ে তাঁর কতগুলো রিসার্চ পেপার রয়েছে এবং তাদের সাইটেশন কত।

যদিও একজন গবেষকের সবগুলো পেপার যে সমান স্বীকৃতি পাবে তাও নয়। স্পেন্সের ডিমের কুসুম নিয়ে গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হয় ২০১২ সালে। গত ৮ বছরে সাইটেশন হয়েছে ৫৭ বার। যেখানে খোদ স্পেন্সের সর্বোচ্চ সাইটেড পেপার ২০১৬ সালে প্রকাশিত এবং মাত্র ৪ বছরে সাইটেশন হয়েছে ৬৭৯৭ বার।

         পৃথিবীর প্রত্যেকটি রিসার্চ পেপারই সায়েন্টিফিক কমিউনিটির দ্বারা কঠোরভাবে স্ক্রুটিনাইজ হয় । এর ভুল-ভ্রান্তি ধরে, সমালোচনা করে পেপার পুরো এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া হয়। রিসার্চে কোনোও ত্রুটি, ঘাটতি, অবহেলা থাকলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়, বাতিল হয়ে যায়। স্পেন্সের স্ট্রোক এবং ডিমের কুসুম নিয়ে রিসার্চটিকেও কঠোর সমালোচনায় পড়তে হয়েছে।

৩। এবার দেখি স্পেন্সের রিসার্চটির কী কী সমালোচনা রয়েছে। একটি রিসার্চ পেপার পাবলিশ হওয়ার পরে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান সেই পেপারের উপর নিজস্ব রিভিউ (review) করে, এরা হল পিয়ার (peer)। আমি কোনোও গবেষণাপত্র প্রকাশ করলে তা যত বেশি মানুষ/প্রতিষ্ঠান দ্বারা পিয়ার রিভিউ হবে, আমার পেপার তত বৈধতা পাবে। স্পেন্সের এ গবেষণাটি ডেইলি মেইলের সংবাদে প্রকাশের পর ব্রিটেনের জনগণের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে পরে এবং জনমনে ডিম নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এই পেপারের সমালোচনা করে আর্টিকেল প্রকাশ করে খোদ ব্রিটেনের NHS (National Health Service) বা United Kingdom এর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (আহা আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যদি এমন হত!)। 
NHS এর রিভিউ এর লিংক:


এবার দেখি NHS কী কী বলছে -
ক। গবেষণা পত্রে ডঃ স্পেন্স কানাডার একটি মেডিকাল কলেজ হাসপাতালের মাত্র ১২৩১ জন অংশগ্রহণকারী উ
ওপর জরিপ চালিয়েছেন। এই ১২৩১ জনের গড় বয়স ৬২ এর ওপরে। এরা সবাই বিভিন্ন কারণে হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন। তো এক্ষেত্রে বলা যায় পপুলেশন সাইজ খুবই ছোটো এবং সিলেক্টিভ। এই গবেষণার পপুলেশনের সাথে আমরা পৃথিবীর মোট পপুলেশনের সাথে তুলনামূলক বিচার করতে পারব না।

খ। এই গবেষণায় কোনোও ট্রায়াল ছিল না। গবেষকরা অংশগ্রহণকারীদের কোনোও ডিম খাওয়ান নাই। তারা প্রথমে তাদের ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস মেপেছেন, আল্ট্রা-সাউন্ড দিয়ে প্লাক বিল্ড-আপ দেখেছেন। এরপর জরিপ করেছেন যেখানে প্রশ্ন ছিল যে, আপনি কত বছর ধরে সিগারেট খান? সকালে নাস্তায় ডিম খেয়েছেন কি না? ইত্যাদি । জরীপে মানুষ নিজের মনমতো তথ্য দেয়, মানুষের স্মৃতি বিভ্রাট ঘটে তাই শুধু জরিপ দিয়ে কো-রিলেশন টানা যায় না। একই সাথে স্পেন্স তাঁর জরীপে অন্যান্য ফ্যাক্টর যেমন, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর অ্যালকোহল কন্সাম্পশন, এক্সারসাইজ করেন কিনা, অন্য ফ্যাটি ফুড গ্রহণ, রান্নার তেল কি খান এসব বিষয় আমলে আনেন নি।

গ। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের কেউই কোনোও হার্টের রোগে ভুগছিলেন না। তাদের অন্যান্য আর্টারি চেক করা হলেও হার্ট আর্টারিগুলো চেক করা হয়নি ।

ঘ। গবেষণায় স্পেন্স অংশগ্রহণকারীদের আরও যে যে বিষয় আমলে নিয়েছেন তা হল তাদের লিঙ্গ, ব্লাড কলেস্টোরল, ডায়াবেটিস, BMI , ধূমপান।
        

 স্পেন্সের মূল জার্নাল ডাউনলোড করতে ৩৯ ডলার লাগে, তাই মূল জার্নাল আমি পড়িনি, NHS এর আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ ফ্রি। স্পেন্সের এই গবেষণায় সিগারেট আর ডিমের কুসুমের মধ্যে অদ্ভুত এক কোরিলেশন দাঁড় করিয়েছেন যে, 

“বছরে প্রতিদিন সিগারেট খেলে আর্টারিতে যে প্লাক বিল্ডাপ হয়, বছরে ২০০ ডিমের কুসুম খেলে তার ২/৩ ভাগ প্লাক বিল্ডাপ হয়”।
 এছাড়াও তার গবেষণায় উলটো আরেকটি কোরিলেশন ওঠে এসেছে যে, ডিম আসলেই একটা ভালো প্রোটিন সোর্স।
        
 


এতক্ষণ যে বিশাল গল্প ফাঁদলাম এই লেখাটি লিখতে আমার সময় লেগেছে বটে, কিন্তু স্পেন্সের গবেষণা নিয়ে ডিটেইল গুগলে খুঁজতে এবং পড়তে আমার সময় লেগেছে বড়োজোর ১৫-২০ মিনিট। বিজ্ঞানের ব্যাপারে আমাদের সবারই জানার আগ্রহ রয়েছে, জানার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে জটিল বিজ্ঞান জানানোর কাজ যাদের, তারা কাজে দেন ফাঁকি। জটিল বিজ্ঞানকে চটকদার হেডলাইনে রূপান্তর করা হয়, যাতে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সহজে। আমরাও পড়ে যাই সেই সুন্দর ফন্টে বড়ো করে লিখা হেডলাইনের ফাঁদে। তবে একটু সচেতন হলেই কিন্তু আমরা আসল খবরটা বের করে আনতে পারি। 

এখন ইন্টারনেটের যুগ। একটা সময় ছিল মানুষের খবর পাওয়ার সোর্স ছিল একটাই, সংবাদপত্র। এখন যত সহজে আমি স্পেন্সের রিসার্চ পেপার আর রিভিউ বের করে ফেলেছি, তখন তা সম্ভব ছিল না। আমাকে উক্ত দুই প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়ে তাদের জবাবের আশায় বসে থাকতে হত মাসের পর মাস। কোনো বিশেষজ্ঞ নয়, প্রতিষ্ঠান নয়, এরকম একজন সাধারন ব্যক্তির কাছে ওরা চিঠির জবাব দিত কিনা তাও কথা। তবে দুই ক্লিকেই এখন আপনারা পেয়ে যাচ্ছেন গোটা বিশ্বের তথ্য ভান্ডার।
        

 এই আর্টিকেলটির লেখার উদ্দেশ্য আমরা যে, কীভাবে হেডলাইন এর চটকদার বিজ্ঞান যাচাই-বাছাই করবো তার বেসিক ধারণা প্রদান। তোমরা নিজেরাও এই যাচাই বাছাই প্রসেসে অংশ নাও, আমার আর্টিকেলটাকে বিশ্বাস করে নিওনা , রিভিউ কর । তোমরা পিয়ার হয়ে যাও ।
        
 
বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে, মেথলডোলোজি, জার্নাল, পিয়ার এসব নিয়ে জানার আগ্রহ অনেকরই আছে । এটা নিয়েই বিস্তারিত একটা সিরিজ লিখব যার প্রথম পর্ব এটা। এরপর আসছে

বিঃদ্রঃ নকল ডিম নিয়ে জানতে এবং জুয়েল আইচের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে Jahirul Islam ভাইয়ের https://www.facebook.com/groups/bcb.science/permalink/3405193396230972/ লেখাটি পড়ুন।

মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত (আনন্দ)
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad

Below Post Ad

advertise