Ads Area

advertise

গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং

0

 তানভীর রানা রাব্বি

ESA/Hubble


গ্র্যাভিটি
 বা অভিকর্ষ নামটার ভেতরেই
কেমন একটা কুল কুল ভাব । নাম শুনলেই মনে হয় কতো উচ্চ পার্যায়ের জিনিস রে বাবা,  যদিও এর সাথে আমাদের সবার পরিচিতি অষ্টম শ্রেণী থেকেই । আর যারা বিজ্ঞান প্রেমী তাদের তো অাগে থেকেই । নিউটনের সেই আপেলের গল্প কেইবা না জানে । যাইহোক আজকে কথা বলব গ্র্যাভিটি নিয়ে নয় । কথা হবে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং বা অভিকর্ষীয় লেন্সিং নিয়ে । আমাদের মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর জন্ম দিয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান । যদিও ব্যাপরটা আমার কাছে পানসে লাগে  । জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চার ফলেই জন্ম নিয়েছে মহাবিশ্ব কী দিয়ে গঠিত, কীভাবে গঠিত হয়েছিল, এর সত্যিকার বয়স কত, এর ভবিষ্যৎ কী, কেনই বা মহাবিশ্ব দেখতে এরকম ইত্যাদি দার্শনিকসুলভ অনেক প্রশ্ন এবং তার অনেকগুলোর উত্তরও পাওয়া গেছে । হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এই ধরনের প্রশ্ন করে আসছে কিন্তু এর আগ্রগতি তেমন একটা হয় নি । তবে কেবলমাত্র গত শতকে আমাদের শক্তিশালী টেলিস্কোপ, কম্পিউটিং দক্ষতা ও নিরলস গবেষণা এই প্রশ্নগুলোর গ্রহণযোগ্য উত্তরের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে । মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বর্তমান উপলব্ধি নিচের পাই-চার্টটির মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে ।



এই চার্টটি সমগ্র মহাবিশ্বের সম্পূর্ণ ভর-শক্তিকে প্রকাশ করছে । আইনস্টাইনের ভর-শক্তি উপপাদ্য থেকে জানা যায়, ভর ও শক্তি উভয়ে আসলে একই । এই হিসেবে ভর মূলত কোনো বস্তুর অভ্যন্তরীণ শক্তিকেই প্রকাশ করে ।

E=mc²


যে সকল নিয়মিত ও স্বাভাবিক বস্তু দিয়ে এই মহাবিশ্ব আছে অর্থাৎ ছায়াপথ, গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, ধূলিকণা, শিলা, গ্যাস ইত্যাদি তাদেরকে ব্যারিওনিক পদার্থ বলে । এই ব্যারিওনিক পদার্থ সমগ্র মহাবিশ্বের মোট ভর-শক্তির মাত্র ৪ শতাংশকে প্রকাশ করেন। উপরের চার্টটির বাকি দুটো অংশ হলো ডার্ক ম্যাটার (Dark Matter) এবং ডার্ক এনার্জি (Dark Energy) । এখন পর্যন্ত জানা তথ্য মতে, সমগ্র মহাবিশ্ব এই তিনটি উপাদানে গঠিত । তবে একটা কথা বলতে পারি ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি নিয়ে ভবিশ্যতে লেখা হবে ।

জ্যোতির্বিদরা যখন লেন্সিং নিয়ে কথা বলেন তখন লেন্সিং বলতে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের প্রভাবকে বোঝান । সাধারণ লেন্স যেমন আলোকে বাঁকিয়ে প্রতিসরিত করে এবং একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে সেই আলোকে ফোকাস করে, গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংও অনেকটা তেমনভাবেই কাজ করে । খুব ভারী কোনো বস্তুর দ্বারা সৃষ্ট শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এর আশপাশ দিয়ে যাওয়া আলোকে বাঁকাতে পারে । তথাপি অন্য কোনো স্থানে ফোকাস করতে পারে এখানে । কিন্তু আসলে আলোকে আকর্ষণ করে বাঁকায় না কেননা আলোর তো কোনো ভরই নেই ।  ব্যাপারটা আপাতত একটু ব্যাখ্যা করা যাক । আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে, স্পেস/স্থান আর সময়কে একটা চাদর হিসের ধরা হয়ে যেটাকে স্থান-কাল চাদর (Space Time Continuum) বলা হয় । এই চাদরে যদি কোনো ভরের বস্তু স্থাপন করা হয় তাহলে সেই স্থান-কাল চাদরকে নিচের দিকে বাঁকিয়ে দেয় যার ফলে স্পেস/স্থান বেঁকে যায় । যেহেতু আলো সবল পথে চলে, তাই সে সরল পথেই যেতে চায় কিন্তু যেখানে স্পেস বেঁকে গেয়ে সেখানে আলোও অগত্যা বেঁকে যায় । এব্যাপারে বিস্তারিত পরে বলা হবে । আপাতত সহজে বোঝানের জন্য মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রকেই আলো বাঁকার কারণ হিসেবে বলছি । যাহোক,  বস্তুর ভর যত বেশি হবে এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র তত বেশি শক্তিশালী হবে এবং সেই ক্ষেত্র তত বেশি মাত্রায় আলোকে বাঁকাতে পারবে । অনেকটা অপটিক্যাল লেন্সের গঠনের মতো, এর ভেতরে যত ঘন উপাদান ব্যবহার করা হবে এটি তত বেশি আলোর প্রতিসরণ ঘটাতে পারবে ।

চিত্রঃ গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং। ছবিঃ NASA, ESA & L. Calçada


গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ছোট থেকে বড় সব মাত্রারই হয় । অতি বিশাল গ্যালাক্সি ক্লাস্টার থেকে শুরু করে গ্রহের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রও আলোকে লেন্সের মতো করে বাঁকাতে পারে । এমনকি আমাদের নিজেদের শরীরের ভরও আমাদের কাছ দিয়ে যাওয়া আলোকে বাঁকাতে পারে । এর মাত্রা খুবই সামান্য । অতি সামান্য বলে আমাদের কাছে তা দৃষ্টিগ্রাহ্য বা গ্রহনযোগ্য হয় না ।

এখন দেখা যাক গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের ফলে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া কীরূপ হতে পারে । কসমোলজিস্টরা মূলত বড় মাত্রায় সংঘটিত লেন্সিং নিয়ে বেশি আগ্রহী । গ্যালাক্সি কিংবা গ্যালাক্সি ক্লাস্টার দ্বারা সৃষ্ট লেন্সিং নিয়েই তাদের কাজকারবার ।

ডার্ক ম্যাটার দেখা না গেলেও (ডার্ক ম্যাটার নিয়ে পরে বিস্তারিত লেখা প্রকাশ করা হবে) তার অস্তিত্ব আছে এবং ভরও আছে । ডার্ক ম্যাটারের সম্মিলিত ভর সমগ্র মহাবিশ্বের মোট ভরের শতকরা ২১ ভাগ, যা পরিমাণের দিক থেকে অনেক বেশি, যেখানে সাধারণ বস্তুর পরিমাণ ৪% । এ থেকে সহজেই বুঝা যায় যে দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোকরশ্মি ডার্ক ম্যাটার দ্বারা সৃষ্ট মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মাঝ দিয়ে আসার সময় লেন্সের অনুরূপ বেঁকে যাবে ।


মহাবিশ্বে যেখানে সাধারণ বস্তু পাওয়া যায় সেখানেই ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি রয়েছে । যেমন, একটি বিশাল গ্যালাক্সি ক্লাস্টারে অনেক পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার থাকবে । এরা ক্লাস্টারের অভ্যন্তরে ও গ্যালাক্সিগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করবে । দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোকরশ্মি এই ক্লাস্টারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এর বিপুল পরিমাণ ভর দ্বারা প্রভাবিত হবে । ফলে সেই আলোর গতিপথ বিকৃত হবে যাকে আমরা বলছি লেন্সিং বা গ্র্যাভিটিশনাল লেন্সিং ।


ডার্ক ম্যাটারের ভর সাধারণ বস্তুর থেকে প্রায় ৬ গুন বেশি হবার কারণে আলোর লেন্সিং বেশ ভালোভাবেই হবে । এর ফলে লেন্সিংয়ের প্রতিক্রিয়া একইসাথে শক্তিশালী হবে এবং কিছু ক্ষেত্রে অদ্ভুতও হবে । যেমন অনেক ক্ষেত্রে লেন্সিংয়ের কারণে দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোকরশ্মি সংকুচিত বা প্রসারিত হয়ে মূল গ্যালাক্সির দৃশ্যমান চেহারাই পরিবর্তন করে দিতে পারে । এরকম একটি উদাহরণ নিচে দেয়া হলো । ছবিটি Abell 2218 গ্যালাক্সি ক্লাস্টার, এখানকার গ্যালাক্সিগুলো মূলত উপবৃত্তাকার বা সর্পিলাকার । কিন্তু শক্তিশালী লেন্সিংয়ের কারণে চেহারা এরকম হয়ে গিয়েছে।

চিত্রঃ Abell 2218 ক্লাস্টার। ছবিঃ NASA/ESA


এ ধরনের অদ্ভুত আকার বিকৃতির কারণ হলো গ্যালাক্সির বাম পাশ থেকে আগত আলোকরশ্মি এবং ডানপাশ থেকে আগত আলোকরশ্মি দুটি ভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে আসে । দুই পাশের দুই আলোকরশ্মি ভিন্ন ভিন্ন ডার্ক ম্যাটারের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের দ্বারা পৃথক পৃথকভাবে প্রভাবিত হয় । ফলে তাদের বেঁকে যাওয়ার প্রকৃতিও হয় ভিন্নরকম । তাই মূল গ্যালাক্সির প্রকৃত চেহারাই পরিবর্তন হয়ে ভিন্ন রূপ ধারণ করে । যেটা দেখতে অন্যরকম মনে হয়।

লেন্সিংয়ের আরো একটি আকর্ষণীয় ও কৌতূহলোদ্দীপক দিক হলো একই গ্যালাক্সির একাধিক প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হওয়া । এমনটা হবার কারণ, দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোকরশ্মি যা অপসৃত (diverge) হবার কথা ছিল তা লেন্সিংয়ের প্রভাবে অভিসারী (focus) হয়ে আমাদের কাছে ধরা পড়ে । পৃথিবীতে অবস্থানকারী কোনো পর্যবেক্ষকের কাছে তখন মনে হবে, দুটি একই রকমের সোজা আলোকরশ্মি মহাকাশের দুটি ভিন্ন অংশ থেকে আসছে । লেন্সিংয়ের এরকম প্রভাবে অনেক সময় মহাকাশে একই গ্যালাক্সির একাধিক বিম্ব দেখতে পাওয়া যায়।

লেন্সিং অনেক সময় বিবর্ধক হিসেবেও কাজ করতে পরতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে অতি দূর গ্যালাক্সির ক্ষীণ আলো লেন্সিংয়ের কারণে বিবর্ধিত হয়ে আমাদের টেলিস্কোপে ধরা পড়ে । লেন্সিং না থাকলে হয়তো সেই গ্যালাক্সিগুলোর অস্তিত্ব খুঁজেই পাওয়া যেতো না ।


দুর্বল লেন্সিং

weak lensing, source: wikimedia


লেন্সিং প্রভাব যদি খুব শক্তিশালী হয় যা খুব সহজেই কোনো এস্ট্রোনমিক্যাল ইমেজে শনাক্ত করা যায় তাহলে ঐ ধরনের প্রভাবকে বলা হয় দৃঢ় বা শক্তিশালী লেন্সিং । এই ধরনের লেন্সিংয়ের প্রভাব শনাক্ত ও পরিমাপ করা সহজ । কিন্তু এরকম বড় মাপের লেন্সিং ইফেক্ট তৈরি করতে সক্ষম বিশাল ভরের গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের সংখ্যা মহাকাশে খুব একটা বেশি পরিমাণে নেই । তাই মহাকশে একই গ্যালাক্সির ধনুকের মতো প্রসারিত ছবি অথবা একাধিক প্রতিচিত্রের মতো ঘটনা অহরহ দেখতে পাই না । অন্য কথায় বলতে গেলে মহাকশে শক্তিশালী লেন্সিং এর ঘটনা কিছুটা দুর্লভ ।

কিন্তু তারপরও যেকোনো গ্যালাক্সি এবং আমদের দৃষ্টিপথের মাঝে ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি রয়েছে । কম হোক বা বেশি হোক আছে । মাত্রা যতই সামান্য বা ক্ষীণ হোক না কেন, যত ধরনের গ্যালাক্সি দেখতে পাই তার সবগুলোই লেন্সিং দ্বারা প্রভাবিত । গাণিতিকভাবে বলতে গেলে প্রায় সব গ্যালাক্সির আকৃতিই লেন্সিংয়ের কারণে মোটামুটি শতকরা ১ ভাগ বিকৃত হয় । এই ধরনের ক্ষীণ লেন্সিং এর ঘটনাকে বলা হয় দুর্বল লেন্সিং।

দুর্বল লেন্সিংয়ের কারণে সৃষ্ট ক্ষুদ্র বিকৃতি খালি চোখের সাহায্যে ধরা যায় না । বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বিজ্ঞানীরা এই ধরনের লেন্সিং করেন । দুর্বল লেন্সিং ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি এবং এদের আচরণ ও ভূমিকা অনুধাবন করতে সাহায্য করছে ।


লেন্সিং কেন প্রয়োজনীয়

লেন্সিং জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মহাকশে ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি, পরিমাণ, বিন্যাস ও প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দেয় । আলোর বাঁক নেয়া নির্ভর করে এর যাত্রাপথে বিদ্যমান মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের তীব্রতার উপর। পরবর্তী চিত্রটি খেয়াল করুন । এটি বুলেট ক্লাস্টার (Bullet Cluster) নামে পরিচিত। এই ক্লাস্টারটিকে দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গ এবং এক্স-রে তরঙ্গ এই দুই মাধ্যমেই পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে । এটি থেকে আগত আলোর একটা বড় অংশ আসে উত্তপ্ত এক্স-রে বিকিরণকারী গ্যাস থেকে । ছবিতে দেখানো মাঝের ধোঁয়া সদৃশ অংশটুকু হলো দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গে দেখা অংশ । মূলত এই ছবিটি এক্স রে এবং দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গে দেখা অংশগুলার একটা ওভারলে বা কম্পোজিট চিত্র ।


চিত্রঃ বুলেট ক্লাস্টারের কম্পোজিট চিত্র। ছবিঃ NASA/STScI


ছবির মেঘের পরিধির কিছু অংশ ক্লাস্টারে ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতিকে নির্দেশ করছে । দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা ছবিতে লেন্সিং সিগন্যাল হিসেব করে এই অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছে । ছবির এক্স-রে বিকিরণকারী গ্যাস উৎস এবং পরিধির ডার্ক ম্যাটার অঞ্চলের পার্থক্য (offset) প্রকৃতপক্ষে দুটি গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের মধ্যকার সংঘটিত সংঘর্ষের পরবর্তী অবস্থাকে নির্দেশ করছে । এই সংঘর্ষের সময়, ব্যারিওনিক কণিকাগুলো (সাধারণ বস্তু) একে অপরের সাথে মহাকর্ষ ও স্থির তড়িৎ বল উভয় ক্ষেত্রের মধ্য দিয়েই মিথস্ক্রিয়া (কোয়ান্টাম থিওরিতে সংঘর্ষকে মিথস্ক্রিয়া বলা হয়) করেছে । একে অপরকে ধাক্কা দিচ্ছে এবং ধীর গতির করছে ।

কিন্তু ডার্ক ম্যাটারের কণিকাগুলো একে অপরের সাথে কেবল মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্য দিয়েই মিথস্ক্রিয়া করেছে । তাদের এই মিথষ্ক্রিয়ায় স্থির তড়িৎ বলের ক্ষেত্র কোনো প্রভাব বা ভূমিকা রাখেনি । তাই এই সংঘর্ষে এক্স-রে গ্যাস কণিকাগুলো ডার্ক ম্যাটারের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে এবং ছবিতে এই পার্থক্যের সৃষ্টি করেছে । দৃশ্যমান বস্তুর প্রায় পুরোটাই মোটামুটিভাবে ছবির কেন্দ্রে অবস্থান করছে । কিন্তু লেন্সিং ইফেক্ট থেকে আমরা বলতে পারি এই ক্লাস্টারের ভরের বেশিরভাগ অংশই আরো বড় অঞ্চল নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে।

এখন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা ডার্ক ম্যাটারের প্রভাবগুলোর সবগুলোই মহাকর্ষ সম্পর্কিত । তাই অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা ডার্ক ম্যাটার বা মহাকর্ষ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বা ধারণা এখনো সম্পূর্ণ নয় । হয়তোবা এমন হতে পারে যে ডার্ক ম্যাটার কোনো নতুন ধরনের বস্তু নয়, বরং মহাকর্ষ সম্পর্কে আমাদের বর্তমান ধারণায় কোনো ত্রুটি রয়েছে, যার কারণে আমরা ডার্ক ম্যাটারকে ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছি না ।

ফলাফলস্বরূপ ডার্ক ম্যাটারের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য মহাকর্ষ তত্ত্বের অনেকগুলো পরিবর্তিত সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে । বুলেট ক্লাস্টারের ছবিটি ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতির একটি শক্ত প্রমাণ । ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব থাকলে আলো এবং ভরের আচরণ যেমন হতো বলে বিজ্ঞানীরা আশা করেছেন, ছবির এই অফসেটটি ঠিক তাই প্রকাশ করে । ডার্ক ম্যাটারের এই অবস্থানের পক্ষে প্রমাণ থাকলেও বর্তমান মহাকর্ষ তত্ত্ব বা এর বিভিন্ন পরিবর্তিত বা পরিমার্জিত সংস্করণ দিয়েও এর উপস্থিতির ব্যাখ্যা দেয়া বেশ কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

লেন্সিং ডার্ক এনার্জির প্রকৃতি সম্পর্কেও অনেক ধারণা দেয় । ডার্ক এনার্জির উপস্থিতি গ্যালাক্সি এবং ক্লাস্টারের সৃষ্টি, গঠন এবং সম্প্রসারণে প্রভাব ফেলে । মহাকাশে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের সাহায্যে নির্ণয় করা তাদের দূরত্ব এবং বণ্টন পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা প্রায় নিখুঁতভাবে ডার্ক এনার্জির পরিমাণ নির্ণয় করেছেন ।


দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আসন্ন আলো আমাদের দিকে যাত্রা শুরু করেছে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে । এই আলো আমাদের সামনে উন্মোচন করেছে আদি মহাবিশ্বের স্বরূপ । কারণ যেহেতু আলো সেকেন্ড ৩ লক্ষ কিলোমিটার যায় তাই তাকে দুর হতে আসতে অনেক সময় লাগে । অনেক দুরের গ্যালাক্সি হতে আলো আসতে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পর্যন্ত লেগে যায় । কিন্তু যেহেতু গ্র্যাভিটি কাজ করে দ্রুত তাই বিভিন্ন দূরত্বে গ্যালাক্সির গঠন ও অবস্থানগত পার্থক্য থেকে মহাবিশ্বে ডার্ক এনার্জির পরিমাণের পরিবর্তন (হ্রাস-বৃদ্ধি বা অপরিবর্তনশীলতা) সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সম্ভব । গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং তাই ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জিসহ মহাবিশ্বের প্রকৃত রূপ উদ্ঘাটনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার ।


সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

আইনস্টাইন সর্বপ্রথম তার সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে সূর্যের মহাকর্ষ ক্ষেত্রের জন্য আলোর পথ বিচ্চুতির সম্ভাব্যতার কথা উল্লেখ করেন । পরবর্তীকালে ইংরেজ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন (১৮৮২ – ১৯৪৪) পরীক্ষার সাহায্যে এর সত্যতা নিরূপণ করেন (আগ্রহী পাঠকরা চাইলে বিস্তারিত জানা জন্য ২০০৮ সালে BBC নির্মিত Einstein and Eddington টেলিভিশন চলচ্চিত্রটি দেখতে পারেন)। কিন্তু আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রস্তাবনার আগেই আলোর পথ বিচ্চুতি নিয়ে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন, যেখানে প্রথম গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং সম্পর্কিত বিষয়াদির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।



দূরবর্তী আলোক উৎস থেকে আগত আলোকরশ্মি তার যাত্রাপথে কোনো ভারী বস্তুর মহাকর্ষ ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হলে তখন সেই আলোক রশ্মি দুটি ভিন্ন পথে পর্যবেক্ষকের নিকট পৌঁছাতে পারে । পরবর্তী চিত্রে যেমনটা দেখানো হয়েছে- দূরবর্তী উৎস S থেকে আগত আলো এর যাত্রা পথে M বস্তুর মহাকর্ষ ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দুটি ভিন্ন পথে পর্যবেক্ষক O এর নিকট পৌঁছায় । ফলে পর্যবেক্ষক O একই বস্তু S এর দুটি ভিন্ন ছবি দেখতে পায়।

গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সম্ভাবনার কথা আইনস্টাইন প্রথম তার নোটবুকে উল্লেখ করেন ১৯১২ সালে। সে সময় তিনি বার্লিনে জ্যোতির্বিদ আরভিন ফ্রেনড্লিক (Erwin Freundlich, ১৮৮৫ – ১৯৬৪) এর সাথে এই ধারণার পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে বেশ আলোচনা করেন । আইনস্টাইন তার নোটবুকে লেন্সিং নিয়ে কিছু প্রাথমিক ধারণা এবং ফর্মুলা প্রকাশ করেন । তার নোটবুকের লেখার একটি ছবি নিচে দেয়া হলো ।

চিত্রঃ আইনস্টাইনের নোটবুকে তার হাতের লেখা।


তবে আইনস্টাইন নিজেই এরকম লেন্সিং ক্রিয়া পর্যবেক্ষণের সম্ভাব্যতা নিয়ে বেশ সন্দিহান ছিলেন । কারণ লেন্সিং ইফেক্ট নির্ভর করে আলোক উৎস, মহাকর্ষ ক্ষেত্র তৈরিকারী বস্তুর ভরের তীব্রতা এবং এদের সাথে পর্যবেক্ষকের দূরত্বের উপর । তাই এরকম একটি ঘটনা অর্থাৎ একই বস্তুর দুটি প্রতিচ্ছবির দেখা পাবার সম্ভাবনা নিয়ে আশা করাটা ছিল বেশ কঠিন ।

পরবর্তীতে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং সংক্রান্ত বিভিন্ন তত্ত্বের উন্মোচন হতে থাকে বিজ্ঞানী মহলে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রকাশনাগুলোতে। আইনস্টাইন নিজেও ১৫-ই ডিসেম্বর ১৯১৫ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় (University of Zurich)-এর মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, তার বন্ধু হাইনরিখ জাঙগার (Heinrich Zangger, ১৮৭৪-১৯৫৭) এর নিকট এ বিষয়ের বিস্তারিত নিয়ে একটি চিঠি লিখেন। চিঠিটি পরবর্তীকালে অলিভার লজ (Oliver Lodge, ১৮৫১-১৯৪০) সম্পাদনা করে ‘নেচার' সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। এছাড়াও এডিংটন তার ১৯২০ সালে প্রকাশিত Space, Time and Gravitation গ্রন্থে এবং স্বনামধন্য জার্নাল Astronomische Nachrichten-এ গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করেন। যদিও সে সময় সব বিজ্ঞানীরাই প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিলেন যে ভূমিতে বসে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের প্রভাব প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ সম্ভব নয়।

পরবর্তীকালে ১৯৩৬ সালে আইনস্টাইনের আমেরিকার প্রিন্সটনে বসবাসকালীন সময়ে একজন চেক ইঞ্জিনিয়ার, রুডি ম্যান্ডল (Rudi W. Mandl) তার সাথে দেখা করেন এবং গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর উপর বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন । তিনি ধারণা করেন শক্তিশালী নক্ষত্রের আলোর দ্বারা সৃষ্ট লেন্সিং ক্রিয়া হয়তোবা পৃথিবীতে জৈববৈজ্ঞানিক বিবর্তন এবং জেনেটিক মিউটেশনের সূচনা করেছিল । কিন্তু ততদিনে আইনস্টাইন নিজেই তার লেন্সিং নিয়ে গবেষণা কাজকারবার বেমালুম ভুলে বসছিলেন এবং অন্যদের গবেষণা সম্পর্কেও তার কোনো ধারণা ছিল না । পরে ম্যান্ডেলের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে আইনস্টাইন আবারো ‘সায়েন্স' সাময়িকীতে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন । এই গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের অপটিক্যাল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু ফর্মুলা প্রকাশ করেন ।

চিত্রঃ সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত আইনস্টাইনের গবেষণা প্রবন্ধ।


পেপারটি প্রকাশের পর আরো অনেক জ্যোতির্বিদ এর উপর আরও বিস্তারিতভাবে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেন। ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ ফ্রিটজ জুইকি (Fritz Zwicky) প্রস্তাব করেন, নক্ষত্রের তুলনায় দূরবর্তী নেবুলা এবং গ্যালাক্সির লেন্সিং ইফেক্ট পর্যবেক্ষণ করা বেশি সহজ হবে । কারণ বড় গ্যালাক্সির আকার, ভর, দূরত্ব সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো আরো বেশি করে লেন্সিং ক্রিয়া ঘটাবে, যেটা কেবল নক্ষত্রের বেলায় ঘটার সম্ভাবনা অনেক ক্ষীণ।

গত শতকের ষাটের দশকে কোয়াসারের আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের নতুন করে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের পর্যবেক্ষণমূলক পরীক্ষায় আগ্রহী করে তুলে । ততদিনে লেন্সিং সংক্রান্ত গবেষণা এবং হিসাব নিকাশগুলো আরো অনেক জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে । কারণ তাত্ত্বিকভাবে বিন্দু উৎস থেকে নির্গত আলোকরশ্মি সুষম সর্পিলাকার লেন্স ভরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হলে এর গণনা অনেক সহজ হয় । কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আলোক উৎস এবং লেন্স ভর কোনোটাই সুষম নয় বরং আকারে বিশাল এবং আকৃতিতে অনিয়মিত । এবং একটি বস্তুর একাধিক বিছিন্ন আকৃতির প্রতিচিত্র সৃষ্টিও অসম্ভব নয় । আইনস্টাইনের মূল তত্ত্ব অনুসারে এসব ঘটনার ব্যাখ্যা এবং নিরীক্ষা বেশ কঠিন ব্যাপার । তাই এধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সাধারণ আপেক্ষিকতার আরো কিছু জটিল মডেল তৈরি করা হয়।

সর্বপ্রথম গ্র্যাভিটেশনাল লেন্স খুঁজে বের করেন Dennis WalshRobert F. Carswell এবং Ray J. Weymann ১৯৭৯ সালে । রেডিও তরঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে তারা Quasar Q0957+561 এর দুটি ভিন্ন প্রতিচিত্র খুঁজে বের করেন যা লেন্সিংয়ের একটি উৎকৃষ্ট সাক্ষ্য বহন করে। পাশের চিত্রে এর একটি মিথ্যা রঙের চিত্র (false color image) দেয়া হলো ।

চিত্রঃ Quasar Q0957+561


পাশে কোয়াসার QSO 2237+0305 এর একটি ছবি দেয়া হলো । এই লেন্সিং সিস্টেমটি আইনস্টাইন ক্রস (Einstein Cross) নামে পরিচিত । আবিষ্কার হয় ১৯৮৫ সালে।


চিত্রঃ আইনস্টাইন ক্রস।


এরকম আরো একটি উদাহরণ হলো MG1131+0456, যা আইনস্টাইন রিং (Einstein Ring) নামে পরিচিত। আবিষ্কার হয় ১৯৮৮ সালে।


চিত্রঃ আইনস্টাইন রিং।


২০০৫ সাল পর্যন্ত অ্যারিজোনা স্পেস অবজারভেটোরি ৬৪ টি নিশ্চিত লেন্সিং সিস্টেম আবিষ্কার করেছে যেগুলার প্রতিটারই একাধিক প্রতিচিত্র রয়েছে । পাশাপাশি আরো ১৮ টি সম্ভাব্য লেন্সিং সিস্টেম এর খোঁজ পেয়েছে ।

বর্তমানকালের জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা গবেষণায় লেন্সিং একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ । ১৯৮৩ সালে ফ্রান্সের Liège-এ প্রথম গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং নিয়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবছরই অনুরূপ বৈজ্ঞানিক সম্মেলন হচ্ছে । লেন্সিং এখন আর কোনো তত্ত্বীয় বিষয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই বরং এটি ব্যবহৃত হচ্ছে মহাবিশ্বতত্ত্ব এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের বাস্তব ও প্রায়োগিক গবেষণায়। এটি এখন মহাকাশ পর্যবেক্ষণ, কৃষ্ণবস্তু, বিগব্যাং মডেল ইত্যাদি গবেষণার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।

নিজের কথাঃ লেখাটা আসলে মাঝের দিকে লাইনচূত্য হয়ে গেছে বলে মনে হবে । কিন্তু চেষ্টা করেছি টপিকে থাকের জন্য । কিস্তু ডার্ক ম্যাটার নিয়ে না বললে বাকিটা বোঝাতে কষ্ট হয়ে যেত । যাহোক এর পার ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি নিয়ে লেখার পারিকল্পনা আছে ওখানে এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে ।

[লেখাটির সংশোধিত সংষ্কারণ হয়তো সামনের কোনো জিরো টু ইনফিনিটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত গতে পারে]


তথ্যসূত্র:

১.https://en.wikipedia.org/wiki/Gravitational_lens 

২. http://www.livescience.com/11064-space-time-distortions-uncover-hidden-galaxies.html

৩. http://w.astro.berkeley.edu/~jcohn/lens.html

৪. http://csep10.phys.utk.edu/astr162/lect/galaxies/lensing.html

৫. http://www.livescience.com/23341-farthest-galaxy-discovery-gravitational-lens.html

৬. http://www.scientificamerican.com/podcast/episode/cosmic-gravitational-lensing-reveal-10-11-05/

৭. http://relativity.livingreviews.org/Articles/lrr-1998-12/download/lrr-1998-12BW.pdf

৮. http://relativity.livingreviews.org/Articles/lrr-1998-12/download/lrr-1998-12BW.pdf

৯. https://www.youtube.com/watch?v=VeAVmp9MLH4

১০. https://www.youtube.com/watch?v=4Z71RtwoOas

১১. অপূর্ব এই মহাবিশ্ব, এ এম হারুন অর রশীদ ও ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, প্রথমা প্রকাশন।

তানভীর রানা রাব্বি,

ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad

Below Post Ad

advertise