আশরাফুল ইসলাম মাহি
১.
পরমাণুর জগতের সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপার বলে যদি কিছু থাকে, সেটা হলো তেজস্ক্রিয়তা।
কিন্তু কেন এই তেজস্ক্রিয়তা?
'পারমাণবিক সংখ্যা 50 নয়, 60 নয়, 90 নয়, এমনকি 81ও নয় (!), কেন এই 82 থেকেই তেজস্ক্রিয় পরমাণুর লাইন শুরু হলো?
কী দোষ আমার প্রিয় মৌল ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়ামদের?
কী দোষ লেড মশাইয়ের?
কেন প্রতি মুহূর্তে তাদের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে আলফা! বিটা!! গামা!!!
হয়েছে, অনেক হয়েছে। ভুলভাল গিলে ফেললে এমনই হয়।
'অ্যাঁ! আমার আবেগ সব ভুল? হে নিষ্ঠুর বিজ্ঞান!!'
হ্যাঁ, নিশ্চিত ভুল। বিজ্ঞান আবেগে চলে না। চললে তো আর পর্যায় সারণিই আসত না।
'কত কষ্ট করে আমার মেন্ডেলিফ 63 টা মৌলকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছিলেন, আমি কেন তাঁর সারণি – এত পরিশ্রমের ফসলে পোকা ছেড়ে দিয়ে আরেকজনের পর্যায় সারণি নেবো?'
– বিজ্ঞান এমন কথা বলে না। স্বৈরাচারীর মতো করে সব মুকাবিলা করে, করবে, করছে।
যাক, অনেক ফালতু কথা বললাম।
আসলে তেজস্ক্রিয় হওয়ার জন্য 82 বা এমন কোনো লিমিট নেই যে সেটা ক্রস করলে কেবল তারাই তেজস্ক্রিয় হবে।
তাই বলে যেকেউ তেজস্ক্রিয় হতে পারবে, এমন কোনো কথাও নেই।
তাহলে কারা হবে এই দুর্ভাগা?
আসছি। একটু ধৈর্য্য ধরুন।
২.
কেউ তেজস্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে, বুঝবেন কীভাবে?
পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে তো অনেক কিছুই বের হয়, হিলিয়াম নিউক্লিয়াস, ইলেক্ট্রন বা পজিট্রন, নিউট্রিনো বা এন্টি নিউট্রিনো, শক্তিশালী ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ – সবগুলোকেই কি তেজস্ক্রিয় রশ্মি বলা হয়?
উত্তর হচ্ছে, না।
কেন না?
…
সম্ভাব্য সবচেয়ে সহজ উত্তর হচ্ছে, কে কতটা সমস্যা করছে।
হিলিয়াম নিউক্লিয়াস অনেক শক্তি নিয়ে দৌড়ে বের হয়। আশেপাশের পরমাণুগুলোর সাথে ধাক্কাধাক্কি করে সহজেই শক্তি হারিয়ে ফেলে। তারপর এই বেটা আশেপাশের পরিবেশ থেকে দুটো ইলেক্ট্রন নিয়েই হিলিয়াম হয়ে যায়।
এদিকে নিউক্লিয়াস থেকে ইলেক্ট্রন প্রচন্ড শক্তি নিয়ে বের হয়েই সামনের সবাইকে ধাক্কা দিয়ে শক্তি ক্ষয়ে ফেলে।
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ, এটার আবার ভর নেই, চার্জও নেই, তাই বেশি ঝামেলা করে না, আলোর বেগে যায় (এ হলো আলো)। যাওয়ার পথের সবগুলো পরমাণুকে একদম বিশৃঙ্খল করে ফেলে!
কিন্তু, নিউট্রিনো – এ ভদ্রলোক। কারও সাথেই ঝামেলা করে না। খুব কম করে। যেজন্য আজও এই নিউট্রিনো নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুব ঝামেলায় থাকেন। কারণ কতটুকু শক্তি এই নিউট্রিনো নিয়ে পালাবে, সেটা বলা মুশকিল। আর সেই সাথে একে ধরা অনেক কষ্ট।
এইরকম শক্তি নিয়ে পালালে শক্তির হিসেব মেলানো হয়ে যায় ঝামেলার। এজন্য এই নিউট্রিনোকে অনেকে ভুতুড়ে কণাও বলে আরকি! আর নিউট্রিনো কোনো তেজস্ক্রিয় কণা না।
বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়াস থেকে বের হওয়া তিনটা কণাকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হিসেবে দেখেন।
একে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস, দুইয়ে ইলেক্ট্রন বা এর প্রতিকণা পজিট্রন, তিনে হলো শক্তিশালী ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ (ফোটন কণা)।
৩.
আলফা কণা, সে তো হিলিয়াম নিউক্লিয়াস।
লেখা হয় এভাবে, α অথবা, ⁴₂He²⁺ ।
তো এখন যদি আমি বলি, হিলিয়াম থেকে দুটো ইলেক্ট্রন কেড়ে নিবো, হয়ে গেল আলফা কণা।
তাই কি?
আবার নিউক্লিয়াস থেকে এই আলফা কণা কত শক্তি নিয়ে বের হবে, সেটাও জানা নেই। কণা পদার্থবিদ্যার জগতে কণাগুলো এত্ত শক্তিও নিতে পারে যে বেগ আলোর কাছাকাছি হয়, আবার এত কম শক্তিও নিতে পারবে যেন বেগ নেই বললেই চলে হয়।
তাহলে কতটুকু শক্তি নিলে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসকে আমরা আলফা কণা বলতে পারব?
আসলে আলফা কণার সংজ্ঞা ওভাবে ঠিক করা হয়নি, একেকজন একেকভাবে বলেন।
তাহলে সবচেয়ে ভালো কোনটা হবে?
যেহেতু আমরা তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে ভাবছি, তাই নিউক্লিয়াস থেকে বের হওয়া যেকোনো শক্তির হিলিয়াম নিউক্লিয়াসকে আলফা কণা বলব।
আর নিউক্লয়াস থেকে আলফা কণা বের হয় গড়ে 5 MeV শক্তি নিয়ে।
বোঝাই যাচ্ছে, আলফা কণা আসলে, ⁴₂He²⁺। মানে দুটো ইলেক্ট্রন নেই। চার্জ হলো +2। আর ভর সংখ্যা 4।
আলফা কণার চার্জ আর ভর তেজস্ক্রিয় কণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আর আকৃতিও বড়ো। তাই সহজেই আশেপাশের পরমাণুর সাথে ঝামেলা করতে পারে। এতে ক্ষতিটা যে আলফারই হয়, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এই সংঘর্ষের জন্যই আলফা কণা অন্য সবার চেয়ে কম ভেদন ক্ষমতার অধিকারী।
একটা কাগজ বা আমাদের ত্বকেই আটকে যায় এই আলফা কণা। তাই আলফা রশ্মি আমাদের জন্য কোনো ক্ষতি বয়ে আনে না। ওর অত সাহসই নেই, বাজে রকমের ভীতু বলা যায়!
'কিন্তু পরমাণু থেকে কেন আলফা কণা বের হয়? কীভাবে?'
অপেক্ষা করুন। আসিতেছি।
৪.
বিটা কণা নিয়ে একটু বলতে চাই। বিটা কণা হলো আর কিছুই না, একটু উচ্চশক্তির ইলেক্ট্রন আরকি! না, ইলেক্ট্রনের প্রতিকণা পজিট্রনকেও বিটা কণা বলা হয়। শর্ত একটাই, নিউক্লিয়াস থেকে বেরোতে হবে। নাহলে কাউকেই বিটা কণা বলা যাবে না! বিটাকে লেখা হয়, β ।
বিটা কণায় ইলেক্ট্রন নাকি পজিট্রন আছে, সেটা কীভাবে বোঝা যায়?
ইলেক্ট্রনের নির্গমন হলে লেখে, β⁻
পজিট্রন নির্গমন হলে হয়, β⁺
ইলেক্ট্রনের চার্জ আছে, ভর আছে, স্পিন আছে। বিটাতেও এগুলোর হেরফের হয় না। শুধু শক্তি একটু বেশি হয়। বেশি গতিশক্তির জন্য আর ভর আলফা থেকে কম হওয়ায় আলফার চেয়ে বেশি ভেদন ক্ষমতা আছে বিটা কণার।
আমাদের শরীরের চামড়া ভেদ করে চামড়ার নিচের চর্বির আবরণও ভেদ করে মাংস অবদি যেতে পারে বিটা। তবে মজার ব্যাপার হলো, শক্তি বেশি হলে আরও অনেকদুর যেতেও পারে!
৫.
গামারশ্মি নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। আমাদের সবার পরিচিত আলো মানে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভই হলো গামারশ্মি। গামারশ্মি আসলে অনেক বেশি কম্পাংকের ইএম ওয়েভ। যেকারণে শক্তিও অনেক বেশি।
আলোর চার্জ, ভর কিচ্ছু নেই। তাই গামারশ্মি অনেক বেশি জিনিস ভেদ করে যেতে পারে সহজেই।
কিন্তু কণাগুলোর স্বভাব হলো আলো পেলেই খেয়ে ফেলা। খেয়ে দেয়ে নিজের গতিশক্তি বাড়িয়ে দৌড় লাগানো ছাড়া কণাগুলোর কাজ আর কি! তাই একসময় গামা সাহেবেরও শক্তি শেষ হয়ে যায়।
গামা আমাদের শরীরের যাচ্ছেতাই ক্ষতি করে ফেলতে পারে। আমাদের কোষের নিউক্লিয়াসে যে ডিএনএ কোড বলে দিচ্ছে যে কোষকে কতটুকু বিভাজিত হতে হবে, সেই ডিএনএ কোড করাপ্ট করে ফেলে এই গামা। ফলস্বরুপ অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন – সেই থেকে হয় ক্যান্সার!
'সবই বুঝলাম কিন্তু এই আলফা, বিটা বা গামা কেন বের হয়? নিউক্লিয়াসে কী এমন হয় যে এরা বেরিয়ে আসে?'
.......
৬.
সব তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকেই যে পর্যায়ক্রমে আলফা, তারপর বিটা, তারপর গামা বের হবে, এমন কোনোও কথা নেই।
নিউক্লিয়াস শুধুই আলফা নির্গমন করতে পারে।
আবার বিটা বিকিরণ করলে গামা বিকিরণ করতেই হবে।
আবার, আলফা - বিটা - গামা পর্যায়ক্রমে বিকিরণ করাও সম্ভব।
নিউক্লিয়াস শুধু আলফা দিলেও সেটা তেজস্ক্রিয়, বিটা-গামা দিলেও আবার তিনটা দিলেও তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস হবে।
'সবই বুঝলাম, কিন্তু কেন আলফা বের হবে, বিটা-গামা বের হবে, কেনই বা তিনটিই বের হবে – সেটা তো বলা হলো না।'
……
৭.
ইউরেনিয়াম বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সদস্য ইউরেনিয়াম-238-mj। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি আজ সকালে থোরিয়াম-234 বংশের সদস্যে পরিণত হয়েছেন এবং একটি আলফা কণা ছেড়ে দিয়েছেন। এনিয়ে খুবই চিন্তিত পুরো ইউরেনিয়াম গোষ্ঠী।
এদের একজন ইউরেনিয়ামের দেওয়া তথ্যমতে, জনাব আর্গনিয়ান নামের একজন রসায়নবিদ কিছুদিন আগে তাদেরকে বলেছিলেন, 'ইউরেনিয়াম গোষ্ঠীর অর্ধায়ু 4.5 বিলিয়ন বছর। '
এতে তারা নিশ্চিত হয়েছিল যে 4.5 বিলিয়ন বয়স হলেই একজন ইউরেনিয়ামের জীবনকাল শেষ হয়। কিন্তু জনাব 238-mj সাহেবের বয়স এত নয়। উনার বয়স মাত্র দুই বিলিয়ন বছর। তাহলে তাঁর মৃত্যু এত দ্রুত কেন হলো? তার এই অদ্ভুত মৃত্যুতে পুরো ইউরেনিয়াম বংশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
— এটম নিউজ (02/02/2021)
৮.
অর্ধায়ু — এই টার্ম আসলে সম্ভাবনা নির্দেশ করে। একটি বাক্সে 32 টি ইউরেনিয়াম-238 রাখা হলো। আপনি যদি 4.5 বিলিয়ন বছর পর এই বাক্সটার মুখ খুলে দেখেন, তাহলে ইউরেনিয়াম পাবেন 16 টি।
কেন?
কারণ অর্ধায়ু মানে হলো এক প্যাকেট পরমাণুর মধ্যে থেকে হাফ প্যাকেট পরমাণু বিকিরণ করে ধ্বংস হয়ে যেতে কত সময় লাগবে। তার মানে 'এক অর্ধায়ু' সময় পর আমরা আগের ইউরেনিয়াম পাবো 16 টি। তো এবার 'দুই অর্ধায়ু' পর পাবো 16 থেকে অর্ধেক গেলে 8 টা। তারপর তিন অর্ধায়ুতে 4 টি, চার অর্ধায়ুতে 2 টি আর শেষে পাঁচ অর্ধায়ুতে পাবো 1 টি।
এখন এরপর কি হবে? ছয় অর্ধায়ুকাল পরে কয়টা থাকবে? ½ টি ইউরেনিয়াম ?
না। ইউরেনিয়াম অর্ধেক হয় না। পরমাণুকে দুইভাগ করে ফেলা যায় না। পরমাণু কোনো সলিড জিনিস না। তাহলে যেটা হবে যে এই 1 টা ইউরেনিয়াম দেখা যাবে যে হয়ত কয়েক অর্ধায়ুকাল বাঁচতে পারতে পারে অথবা এক অর্ধায়ুকালের আগেই শেষ!
কেন, এটা তো ঠিক হলো না, এ কেন হয় এত বেশি না হয় এত কম সুবিধা পাবে?
অর্ধায়ু বা হাফ লাইফ আসলে এরকম বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য দ্বায়ী না। কারণ অর্ধায়ুর সংজ্ঞাই ওভাবে ঠিক করা হয়েছে।
আমাদের আগের উদাহরণে 32 টা থেকে 16 টা হতে লেগেছে এক অর্ধায়ুকাল। তার মানে এই নয় যে ঠিক ঠিক 4.5 বিলিয়ন বছর পূর্ণ হওয়ার এক সেকেন্ড আগেও বাক্সে 32 টাই থাকবে এবং 4.5 বিলিয়ন পূর্ণ হওয়ার এক সেকেন্ড পরেই 16 টা হয়ে যাবে।
আসলে এই 4.5 বিলিয়ন বছর সময়কাল ধরেই কমতে থাকবে এবং হয়ত দেখা যাবে যে 4.5 বিলিয়ন বছর পর অবশিষ্ট আছে 16 টি। আসলে আমাদের এই ক্ষমতা নেই যে একদম ঠিকঠাক ভাবে বলে দিতে পারব যে এই সময়ে ওই ইউরেনিয়াম চেঞ্জ হয়ে থোরিয়াম হয়ে যাবে। এটা বলার বা হিসেব করার সাধ্য নেই, যেকারণে অর্ধায়ু বা হাফ লাইফ টার্ম আমাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে।
তারমানে, ২৩৮-mj সাহেবের মৃত্যু নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই, ইউরেনিয়াম গোষ্ঠী ভুল বুঝেছিল।
৯.
এখন এই তেজস্ক্রিয়তায় মৌল চেঞ্জ হওয়ার হার নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করা যায়?
খুব সহজ।
এজন্য দুইটা বাক্স কল্পনা করুন। একটার নাম দিলাম A আরেকটা B।
A তে রাখা হলো 64 টি ইউরেনিয়াম, আর B তে রাখা হলো 1024 টি ইউরেনিয়াম।
এবার A এর জন্য দেখি।
4.5 বিলিয়ন অর্ধায়ু।
এই বাক্সে বর্তমান মোট ইউরেনিয়াম হলো 100%।
আমরা যদি এক অর্ধায়ুকাল পর দেখি, তাহলে ইউরেনিয়াম থাকল, 50% বা 32 টি।
একইভাবে B তে এক অর্ধায়ুকাল পরে থাকবে 50% বা 512 টি।
দেখুন, A বাক্সে কিন্তু 4.5 বিলিয়ন বছরে ইউরেনিয়াম কমেছে মাত্র 32 টি। যেখানে B তে কমেছে 512 টি। B তে তুলনামূলক অনেকবেশি কমেছে।
এবার দেখুন, A বাক্সে ইউরেনিয়ামও B থেকে কমই ছিল। তার মানে বোঝা যাচ্ছে যে একসাথে যত কম ইউরেনিয়াম রাখা যাবে, তত কম ক্ষয় হবে। এটা শুধু ইউরেনিয়াম নয়, সব তেজস্ক্রিয় মৌলের জন্যই প্রযোজ্য।
সবশেষে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে,
'কেন পরমাণু তেজস্ক্রিয় বিকিরণ করে যে অর্ধায়ু থাকে? কেন? '
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের আগে ঢুঁ মারতে হবে পার্টিকেল ফিজিক্সের দুনিয়ায়…..।
১০.
পার্টিকেল ফিজিক্সে পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে কোয়ার্ক।
হ্যাঁ, নিউট্রন-প্রোটন সব কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি।
কোয়ার্ক আবার বিশেষ এক ধরণের কণা। এই কোয়ার্কদের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন বিদ্যমান।
নিউক্লিয়ার স্ট্রং ফোর্স এক্সচেঞ্জ হয় পাশাপাশি কোয়ার্কদের মধ্যে। কতটুকু পাশাপাশি?
স্ট্রং ফোর্সের কাজের সীমা হলো 10⁻¹⁵ m। মানে একটা কোয়ার্কের যদি ওর উপরে নিচে ডানে বামে এই 10⁻¹⁵ m দুরত্বের মাঝে যদি অন্যকোনো কোয়ার্ক থাকে, তাহলে একটা আরেকটার সাথে গ্লুয়ন এক্সচেঞ্জ করবে। গ্লুয়ন হলো স্ট্রং ফোর্সের বাহক কণা। এটা বোজন কণা। আলো বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সের বাহক যেমন ফোটন কণা, এই স্ট্রং ফোর্সের বাহক গ্লুয়ন, আর W বা Z বোজন কণা হলো উইক ফোর্সের বাহক।
এই ইউক ফোর্সটাও একধরণের মৌলিক বল। এই বলের রেঞ্জ হলো 10⁻¹⁸ m।
মজার ব্যাপার হলো, এই স্ট্রং ফোর্স আসলে শুধুমাত্র কোয়ার্কদের মধ্যেই কাজ করে। ইলেক্ট্রনের জন্য না, কারণ ইলেক্ট্রন কোয়ার্কের তৈরি বা কোয়ার্ক না। আর আরও মজার ব্যাপার হলো এই স্ট্রং ফোর্স শুধুই আকর্ষণ ধর্মী। 10⁻¹⁵ m রেঞ্জের মধ্যের সব কোয়ার্ককে আকর্ষণ করে ধরে রাখে। এমনকি এই স্ট্রং ফোর্সকে মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালি বল বলে ধরা হয়!
কিন্তু উইক ফোর্সটা আবার শুধুই বিকর্ষণধর্মী। কোয়ার্করা যদি খুব কাছাকাছি (10⁻¹⁸ m) আসে, তাহলে এই ফোর্স কোয়ার্কদের একে অপরের কাছ থেকে দূরে ফেলে দিতে চায়।
কিন্তু স্ট্রং ফোর্সের মতো অতটা শক্তিশালী বল না হওয়ায় এই ফোর্স মোটামুটি কিচ্ছু করতে পারে না।
আর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সের কথা কি আর বলি! এটা আকর্ষণ-বিকর্ষণ সব করে। আর সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো এই ফোর্স দূরত্ব যত কম পায়, তত বেশি বলে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে। সমধর্মী চার্জ একে অপরকে বিকর্ষণ করে এই বলের জন্যই।
কিন্তু সমস্যাটা হলো, নিউক্লিয়াসে এত্ত এত্ত প্রোটন, যার চার্জ সবার একই, তারা কেন এই ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসে আটকে থাকে? এদের তো বের হয়ে যাওয়ার কথা!
হ্যাঁ, সেটাই। কিন্তু এসবের তীব্র বিরোধীতা করে ইউনিভার্সের সবচেয়ে শক্তিশালী বল স্ট্রং ফোর্স! কার সাধ্য এর মুকাবিলা করা?
১১.
নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ মাপার জন্য আমাদের কাছে মোটামুটিরকমের একটা সূত্র আছে।
R = (1.25 x ³√A) fm,
এখানে, 1 fm = 10⁻¹⁵ m
তো, A হলো ভরসংখ্যা।
আরেকটা জিনিস এই সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে ব্যাসার্ধ মোটামুটি 10⁻¹⁵ এর আশে পাশে হবে। তারমানে কিন্তু এই যে স্ট্রং ফোর্সের রেঞ্জের মধ্যে অন্তত প্রোটন নিউট্রন পরবে। যার জন্য এই প্রোটন আর নিউট্রনের মাঝে যে তিনটা করে কোয়ার্ক আছে, তাদের মধ্যে নিউট্রন থেকে প্রোটন বা প্রোটন থেকে নিউট্রনে গ্লুয়ন এক্সচেঞ্জ হবে।1 এভাবে স্ট্রং ফোর্সের মাধ্যমে এরা যুক্ত থাকবে।
এবার একটা পরমাণু নিই। ধরি, কার্বন-12। কার্বন-12 তো তেজস্ক্রিয় না, এর কারণ হিসেবে অনেকে বলেন যে প্রোটন-নিউট্রনের অনুপাত 1:1 এর জন্য এটা স্ট্যাবল। কিন্তু এটা আসলে আংশিকভাবে সঠিক। কেন? সেটাই বলতে যাচ্ছি।
এবার আমাদের প্রথম দরকার, এই কার্বন-12 এর নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ বের করা।
সূত্র থেকে পাওয়া গেল, 2.86 fm। তার মানে কি?
এর মানে হলো, একটা নিউট্রন আছে, তার পাশে একটা প্রোটন ধরি, এভাবে মোট ছয় জোড়া আছে। মজার ব্যাপার হলো, এই এত কম ব্যাসার্ধ হওয়ায় একটা প্রোটন, বা একটা নিউট্রনের ভিতরের কোয়ার্কগুলো মোটামুটি দুই বা তিনটা বা চার পাঁচটা প্রোটন বা নিউট্রনের সাথে গ্লুয়ন এক্সচেঞ্জ করতে পারছে।
আমরা যদি এই নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধকে 12 দিয়ে ভাগ করি, তাহলে পাব যে প্রতিটা নিউট্রন বা প্রোটন কতটুকু ব্যাসার্ধের জায়গা দখল করেছে, তার একটা মোটামুটিরকমের অনুমান করতে পারব।
এর থেকে কী বোঝা গেল? সবাই সবাইকে ধরে রেখেছে, আর কিছু?
হ্যাঁ, অবশ্য প্রোটন প্রোটন একদিকে নিজেদের মধ্যে বিকর্ষণও করছে প্রচন্ড বল দিয়ে, কিন্তু এর ভিতরের কোয়ার্কগুলোর গ্লুয়ন এক্সচেঞ্জের এরিয়ায় পড়ার জন্য এই প্রোটন দুটির মাঝে আকর্ষণও হচ্ছে। মোটামুটিভাবে এই নিউক্লিয়নগুলো যেহেতু প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে গ্লুয়ন এক্সচেঞ্জ করে স্ট্রং ফোর্সে আবদ্ধ, তাই এই নিউক্লিয়াস অনেক স্ট্যাবল হয়।
আচ্ছা, তাহলে কার্বন-14 তো আরও বেশি নিউট্রন রাখে, তাহলে তো আরও বেশি গ্লুয়ন এক্সচেঞ্জ মানে আরও বেশি বেশি স্ট্রং ফোর্সে নিউক্লিয়াস আবদ্ধ থাকার কথা। তাহলে কেন এ বিটা রশ্মি বিকিরণ করে? কেন তেজস্ক্রিয়?
১২.
আমরা সবাই দুটো কথা বেশ ভালো করে জানি,
'বেশি বেশি কোনো কিছুই ভালো না।'
আর,
'ছোটো ছোটো জিনিসই বড়ো কিছুর সূচনা করে।'
এই কথাগুলো এখানেও সত্যি!
মজা করছি না, এটাই সত্যি!
এই পরমাণুতে দুটো নিউট্রন বেশি। মানে প্রোটন ঠিক ছয়টাই আছে বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সে বিকর্ষণ সমান। কিন্তু বাড়তি নিউট্রনের জন্য গ্লুয়ন এক্সচেঞ্জ মানে আকর্ষণ বল বেড়ে গেছে অনেক।
আসলে কার্বন-14 তে এত বেশি স্ট্রং ফোর্সের বন্ধন যে নিউক্লিয়াসের একদম মাঝখানের দিকের কোয়ার্কগুলো এত কাছাকাছি আসে যে তারা 10⁻¹⁸ m রেঞ্জের মধ্যে পরে যায়! এতে কি হয়?
হয় হলো গিয়ে উইক ফোর্স কাজ শুরু করে দেয়। এই উইক ফোর্স কোয়ার্কদের বিকর্ষণ করে দূরে ফেলে দিতে চায়। আর এই কোয়ার্কদের পোষকদেহ প্রোটন জনাব নিজেই তো সবসময় ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সে বিকর্ষণ করেই চলছে করেই চলছে। আর প্রোটনগুলো এত বেশি কাছে আসার দরুন এই ফোর্সও বিশাল পরিমাণে বেড়ে যায়! শেষ পর্যন্ত যা হয়, তা হলো, এই প্রোটনদের অত্যাধিক বিকর্ষণ আর উইক ফোর্সের চাপে স্ট্রং ফোর্স একটু ঢিলা ঢালা হয়। এতে করে ওই জায়গাটার কোয়ার্কগুলো বাইরের দিকে চাপ দিতে থাকে।
শেষে এই অস্থিতিশীল অবস্থা এড়াতে একটা নিউট্রন প্রোটনে পরিণত হয়।
এতে বাড়তি একটা নিউট্রনের গ্লয়ন এক্সচেঞ্জ কমে যায় আর কোয়ার্কগুলো 10⁻¹⁸ m রেঞ্জের বাইরে চলে আসে। যদিও শেষের প্রোটনের জন্য বিকর্ষণ বল একটু বাড়ে, তবুও এই উইক ফোর্সের বিশাল বিকর্ষণ থেকে বেঁচে যায়। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো উইক ফোর্স ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সের চেয়ে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী বিকর্ষণ করতে পারে। সব মিলিয়ে যা হয়,
₀¹ n → ₊₁¹p + β⁻ + Energy
এরপর,
¹⁴C → ¹⁴N + β⁻
এখানে আরেকটা ব্যাপার হলো, এই ¹⁴N তে নিউট্রন প্রোটনের অনুপাত 1:1। এই অনুপাতটা 1 থেকে 20 এর মতো পারমাণবিক সংখ্যার মৌলগুলোর জন্য বেশ ভালো। কেন ভালো সেটা একটু পরেই আসছে।
১৩.
ছোটো থেকে মাঝারি নিউক্লিয়াস সবগুলোই এই উইক ফোর্স আর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সের আধিক্যের জন্যই তেজস্ক্রিয় হয়। বোঝাই যাচ্ছে যে এজন্য নিউক্লিয়াসগুলো বিটা বিকিরণ করবে। কারণ এদের দরকার আকর্ষণ আর বিকর্ষণের মধ্যে সামঞ্জস্যতা তৈরি করা।
কার্বন-14 এর ক্ষেত্রে β⁻ মানে ইলেক্ট্রনের বিকিরণ হয়েছে। এই ব্যাপারটা দেখেই বলে দেওয়া যায় যে এখানে একটা নিউট্রন প্রোটন হয়ে গেছে।
আবার একই কারণে প্রোটনও নিউট্রনে পরিণত হয়ে বিকর্ষণ কমিয়ে স্ট্যাবল নিউক্লিয়াসে পরিণত হতে পারে। সেক্ষেত্রে,
₊₁¹p → ₀¹ n + β⁺ + Energy
যেমন,
⁶⁴Cu → ⁶⁴Ni + β⁺
এক্ষেত্রে আরেকটা ব্যাপার আছে। বিটা বিকিরণের পরও নিউক্লিয়াসে যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি থাকলে গামা রশ্মির বিকিরণ হয়। বিটা বিকিরণের সময় প্রচণ্ড শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তি আসলে প্রোটন-নিউট্রন পরিবর্তন হওয়ার সময় হারিয়ে যাওয়া ভর। এই ভরই শক্তিতে রুপান্তরিত হয়। যার কিছু অংশ বিটা নিয়ে নেয় আর কিছু নেয় নিউট্রিনো কণা আর বাকি শক্তিটুকুর পরিমাণ অনুযায়ী পরে গামারশ্মি হিসেবে বিকিরিত হয়।
১৪.
এবার আসি একটু বড়ো টাইপের নিউক্লিয়াসে।
এই বড়ো কিসের হিসেবে বড়ো?
আসলে বড়ো নিউক্লিয়াস তারাই, যারা আলফা বিকিরণ করতে পারে। সেটা নিয়ে পরে দেখা যাবে।
আপাতত আমরা কার্বন বা কপারের চেয়ে বড়ো নিউক্লিয়াস নিয়ে দেখব। যেমন Sn-100 বা টিনের আইসোটোপ।
আচ্ছা এত কিছু থাকতে টিন কেন নিতে হলো?
আসলে আপনি যদি পর্যায় সারণি একবার চেক করে দেখেন, তাহলে প্রোটন নিউট্রনের 1:1 অনুপাতের অসাড়তা প্রমাণের জন্য এই টিন-100 ছাড়া উপযুক্ত কাউকে পাবেন না। কেন একথা বলছি?
Sn-100 তে প্রোটন আছে 50 টা। টিনের পারমাণবিক সংখ্যাই 50। তাহলে নিউট্রন প্রোটন অনুপাত কত, নিশ্চই 1:1? হ্যাঁ, কিন্তু এই Sn-100 একটা তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ! এ বিটা বিকিরণ করে।
আরও বড়ো ব্যাপার হলো টিনের আইসোটোপ আছে 99 থেকে শুরু করে 139 পর্যন্ত, যার হাতেগোণা কয়টা মাত্র স্ট্যাবল। আর সব তেজস্ক্রিয়। 118, 119, 120 স্ট্যাবল কিন্তু বাকিগুলোর খুব অল্পই স্ট্যাবল। তাহলে কেন এই টিনে এত আইসোটোপ তাও আবার তেজস্ক্রিয়?
১৫.
টিনের ব্যাসার্ধ দরকার।
সমীকরণ টেনে পাওয়া যায়, A = 100 'র জন্য,
R = 5.8 fm
অনেক বড়ো, তাই না?
আমাদের এবার ত্রিমাত্রিক ভাবে চিন্তা করতে হবে।
এই পরিমাণ ব্যাসার্ধের নিউক্লিয়াস – নিশ্চই স্ট্রং ফোর্স থাকবেই।
একটা প্রোটন কয়জনকে গ্লুয়ন দিয়ে নিয়ে আকর্ষণ বজায় রাখতে পারে? আশে পাশে ধরুন চারটা বা ছয়টা নিউট্রন বা প্রোটন!
অনেক বেশিই ধরলাম।
তাহলে চিন্তা করুন, ওই প্রোটনকে আকর্ষণ করে ধরে রাখছে মাত্র চার-ছয়টা নিউট্রন আর প্রোটন। আর বাকি যে 40 টার মতো প্রোটন কিন্তু ওই প্রোটনকে বিকর্ষণ করবেই কারণ ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ফোর্স আছে এবং এরা স্ট্রং ফোর্সের রেঞ্জের বাইরে বলে এদেরকে আকর্ষণও করা যায় না।
একইভাবে নিউক্লিয়াসের অপেক্ষাকৃত বাইরের প্রোটনগুলো ভেজালে আছে, ওদের ভিতরের প্রোটনগুলো বিকর্ষণ করছে। এদিকে তো এত বেশি নিউক্লিয়নের জন্য নিউক্লিয়াসের মাঝের দিকে রেঞ্জ 10⁻¹⁸ m ছাড়িয়ে গেছে নিশ্চই। উইক ফোর্সও বাইরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমনিতেই ভিতরের প্রোটনের বিকর্ষণে বাইরের প্রোটনগুলো টিকতে পারছিল না, সেখানে আবার এই উইক ফোর্স ভিতর থেকে ঠেলে দিচ্ছে বাইরের দিকে। এতে নিউক্লিয়াসের অপেক্ষাকৃত বাইরের নিউক্লিয়নগুলো নড়বড়েভাবে থাকছে। যেকোনো সময় এরা ভেঙে গিয়ে বিটা বিকিরণ করে নিউট্রন হয়ে যায় এবং নিউক্লিয়াস কিছুটা স্ট্যাবল হয়। আবার ওইযে নতুন মৌলে পরিণত হলো, সেটাও এই বেশি নিউক্লিয়নের কারণে আনস্ট্যাবল হয়ে আবার বিকিরণ করে।
এখানে আমাদের Sn-100 বিটা প্লাস (প্রোটন নিউট্রন হয়ে যায়) বিকিরণ করে In-100 বা Cd-99 আইসোটোপে পরিণত হয়। বেশি পরমাণ বিটা বিকিরণে Cd-99 আর কমে In-100 তে পরিণত হয়।
আবার আপনি যদি Sn-139 এর আশেপাশের আইসোটোপ দেখেন, তাহলে দেখবেন যে এরা বিটা মাইনাস (নিউট্রন প্রোটন হয়ে যায়) বিকিরণ করছে। মানে এরা আসলে নিউট্রন কমাচ্ছে। আর আগেরটাতে নিউট্রন বাড়াচ্ছিল।
এতে কি বোঝা গেল?
বড়ো বা এই টাইপের নিউক্লিয়াসে নিউট্রন প্রোটনের অনুপাত 1:1 হওয়ার চেয়ে প্রোটন থেকে নিউট্রন বেশি হলে বেশি স্ট্যাবল। অতটাও বেশি নিউট্রন থাকলে আবার স্ট্যাবল হবে না। এই অনুপাত তখন মোটামুটি 1.3:1 বা এরকম হতে হয় মানে নিউট্রন বেশি হওয়া ভালো। অনুপাত ঠিক করা যে বোকামি, সেটা একটু পরেই বোঝা যাবে। কিন্তু আপনি যদি ব্যাপারটাকে মোটামুটি অনুভব করতে চান বা আন্দাজ করতে চান, তাহলে এই অকাজের অনুপাত কাজের হয়ে উঠতেও পারে – আমার কিছু বলার নেই।
১৬.
এতক্ষণ আমরা দেখলাম যে কেন বিটা বা গামা বিকিরণ হয়। এসব নিউক্লিয়াসের সমস্যাই হলো যে এদের নিউট্রন অথবা প্রোটন বেশি। এরা নিউট্রন অথবা প্রোটন কমিয়ে স্ট্যাবল হতে চায়।
পারমাণবিক সংখ্যা 82 পার হলে এদের নিউক্লিয়াসে অনেক বেশি নিউট্রন ও প্রোটন থাকে। আগের মৌলগুলোর মতো হয় প্রোটন অথবা নিউট্রন বেশি নয়, বরং এদের প্রোটন আর নিউট্রন দুটোই বেশি।
উইক ফোর্স আর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সের জন্য এমনিতেই নিউক্লিয়াসের অপেক্ষাকৃত উপরের নিউক্লিয়নগুলো অল্প বলে আটকে থাকে। আর নিউক্লিয়াসের আকৃতির তুলনায় ভর অনেক বেশি হয়ে যায়। আপনি যদি নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ আর ভরের গ্রাফের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন যে প্রথমদিকে পারমাণবিক সংখ্যার অল্প বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যাসার্ধ অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু পারমাণবিক সংখ্যা শেষের দিকে বেশি বৃদ্ধির জন্যও ব্যাসার্ধ অনেক কম বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেকারণে আকারের সাথে ভরের সামঞ্জস্যতা নষ্ট হচ্ছে।
এই ব্যাপারগুলোর জন্য এইসব নিউক্লিয়াস নিউক্লিয়ন সংখ্যা কমিয়ে স্ট্যাবল হতে চায়। এর সবচেয়ে সহজ উপায় আলফা কণা বিকিরণ করা।
একটা আলফা কণা ছেড়ে দিলে 4 টি নিউক্লিয়ন কমে যায়। পারমাণবিক সংখ্যা দুইঘর নিচে নামে।
তবে এরা তাদের অবস্থাভেদে শুধু আলফা অথবা আলফা, বিটা প্লাস ও গামা অথবা আলফা, বিটা মাইনাস ও গামা বিকিরণ করে।
১৭.
কোন নিউক্লিয়াস কতটুকু স্ট্যাবল, সেটা পরিমাপ করার একটা মানদণ্ড আছে।
সেটা হলো বেন্ডিং এনার্জি।
বেন্ডিং এনার্জি হলো ওই পরিমাণ শক্তি যতটা শক্তি প্রয়োগ করলে একটা নিউক্লিয়াস থেকে নিউক্লিয়নগুলো বেরিয়ে আসবে।
বোঝাই যাচ্ছে যে নিউক্লিয়াসের ভিতরে বিভিন্ন বল কাজ করছে। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স নিউক্লিয়নদের বাইরে ঠেলে দিচ্ছে, উইক ফোর্সও তাই, স্ট্রং ফোর্স সবাইকে আকর্ষণ করে ধরে রাখছে।
এই পরস্পর বিপরীতমুখী বলের জন্য লব্ধি বল যতটা নিউক্লিয়াসকে স্ট্যাবল রাখতে চায়, নিউক্লিয়াস ততটাই স্ট্যাবল থাকে। আমরা বাইরে থেকে যদি শক্তি প্রয়োগ করি, তাহলে কণাগুলোর গতিশক্তি বৃদ্ধি পাবে।
এভাবে একটা নিউক্লিয়াস থেকে নিউক্লয়ন বের করতে কম শক্তি দিতে হলে সেই নিউক্লিয়াস কম স্ট্যাবল। যত বেশি শক্তি দিতে হবে, নিউক্লিয়াস তত বেশি স্ট্যাবল। বেন্ডিং এনার্জি বাড়লে স্ট্যাবিলিটিও বাড়বে।
বেন্ডিং এনার্জি বের করার সমীকরণ হলো,
B(Z,N) =
(Mₚ x Z + Mₙ x N – Mₐₜₒₘ(Z,N)) x (931.494 MeV)
যেখানে,
Mₚ = 1.007825 u,
Mₙ = 1.008665 u,
Mₐₜₒₘ(Z,N) =পারমাণবিক ভর,
Z = প্রোটন সংখ্যা,
N = নিউট্রন সংখ্যা।
একটা নিউক্লিয়াসের সব নিউক্লিয়ন বের করে ফেলতে যত শক্তি লাগে, সেটা এই সমীকরণ থেকে আসবে।
এই সমীকরণ দিয়ে বেন্ডিং এনার্জি MeV এককে বের করা যাবে। আর পুরো শক্তিকে ভরসংখ্যা দিয়ে ভাগ দিলে যে শক্তি পাওয়া যাবে, সেটা হলো একটা মাত্র নিউক্লিয়ন মুক্ত করতে যত শক্তি লাগবে সেটা।
বেন্ডিং এনার্জির সমীকরণ থেকে গ্রাফে মান বসালে নিচের গ্রাফের মতো হবে।
এখানে একটা নির্দিষ্ট লিমিটের মাঝে বেন্ডিং এনার্জি সর্বোচ্চ হচ্ছে। এইটুকু রেঞ্জের নিউক্লিয়াস সবচেয়ে বেশি স্ট্যাবল আরকি!
১৭.
নিউক্লিয়াসের স্ট্যাবিলিটির ব্যাপারগুলো তো বোঝা গেল। কিন্তু আমরা একটা মহা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ফেলে এসেছি। সেটা হলো স্ট্যাবিলিটি গ্রাফ।
এই গ্রাফ আসলে অনেক অনেক তথ্য বহন করে।
আমাদের এই গ্রাফে x অক্ষ বরাবর আছে প্রোটন সংখ্যা আর y অক্ষতে আছে নিউট্রন সংখ্যা। আমরা সবার প্রথমে যেটা দেখতে যাচ্ছি সেটা হলো নিউট্রন প্রোটনের 1:1 অনুপাতের সেই ব্যাপারটা। এই গ্রাফের ওই যে সরলরেখা যেটা সোজা হয়ে চলে গেছে, সেটা হচ্ছে 1:1 অনুপাত। আর তার উপরের যে বিস্তৃত অংশ, সেটার মাঝে যে একটা কাটাকাটা রেখা চলে গেছে, সেটা হচ্ছে একদম স্ট্যাবল মৌলদের স্থান। এই রেখায় যারা পরবে, সবাই স্ট্যাবল হবে।
গ্রাফ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে কেন 1 থেকে 20 পারমাণবিক সংখ্যার জন্য 1:1 স্ট্যাবল মৌল হয়। দেখা যাচ্ছে যে 1:1 রেখার গায়ে যেন লেগে আছে ওই স্ট্যাবিলিটি লাইন। এরপর থেকে এই লাইন একটু একটু করে অনেক বেশিদূর চলে গেছে।
খেয়াল করলে দেখা যাবে যে 1 থেকে প্রায় 20 টি প্রোটন পর্যন্ত স্ট্যাবিলিটি লাইন আর 1:1 লাইন মিলে ছিল। এজন্যই 1:1 এতটা স্ট্যাবল যখন প্রোটন হয় 1 থেকে 20 এর মধ্যে।
১৪.
এবার দেখা যাক কারা বিটা বিকিরণ করবে।
দেখা যাচ্ছে যে বিটা প্লাস আর বিটা মাইনাস দুইটার জন্য দুরকম। কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর আগেই দিয়েছি।
যাদের প্রোটন বেশি, তারা প্রোটন কমিয়ে নিউট্রন বানাবে। এতে বিটা প্লাস বিকিরণ হয়, তাই না?
এই গ্রাফে স্ট্যাবিলিটি লাইনের নিচের মৌলগুলোতে প্রোটন বেশি। কারণ গ্রাফের যত উপরে যাওয়া যায় তত নিউট্রন বাড়ে। আর যত ডানে যাওয়া যায়, তত প্রোটন বাড়ে। তো এই বাড়িতি প্রোটন বাদ দেওয়ার জন্য তারা বিটা প্লাস বিকিরণ করার কথা।
এবার গ্রাফ দেখুন। সত্যিই তো! স্ট্যাবিলিটি লাইনের নিচেই বিটা প্লাস বিকিরণ দেখায়!
আমার মনে হয়না যে আবার বিটা মাইনাস কেন বা কোথায় সেটা বলতে হবে। বিটা প্লাস বুঝলে বিটা মাইনাস না বোঝার কিছুই নেই। লাইনের উপরে বিটা প্লাস দিবে।
আবার দেখা যাচ্ছে যে যাদের প্রোটন নিউট্রনের তুলনায় খুব বেশি অথবা নিউট্রন প্রোটনের তুলনায় খুব বেশি, তাদের একটু একটু অংশ দেখা যাচ্ছে। লাইনের একেবারে নিচে, যাদের নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ খুব কম, তাদের মাঝে। এরা প্রোটন বা নিউট্রন সরাসরি ছেড়ে দেয়। হ্যাঁ, এরা অত কৌশলী না, যেটা বাদ দেওয়ার সেটা পুরাই বের করে দেয়।
১৫.
এখানে আরেকটা ভুতুড়ে ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন?
82 টা প্রোটনের পর আর স্ট্যাবিলিটি লাইন নেই!!
কেন?
কারণ তো বলেছিই। ওগুলোর নিউট্রন প্রোটন সবই বাজে রকমের বেশি। তাদের নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধের তুলনায়। তাই এরা আলফা ছেড়ে দেয়। এখানে আরেকটা ব্যাপার আছে।
দেখুন, ওখানে যদি একটা কাল্পনিক স্ট্যাবিলিটি লাইন ধরে নেওয়া হয়, তাহলে লাইনের নিচে সবাই আলফা, বিটা প্লাস আর গামা — তিনটাই বিকিরণ করবে। আর উপরে হলো আলফা, বিটা মাইনাস আর গামা।
কেন? আগেই বলেছি, বলিনি কি?
১৬.
এইযে আলফার পরে, উপরে আরও একটা জায়গা দেখা যাচ্ছে। ওইখানে আছে হলো ফিশন যোগ্যতাওয়ালা মৌল। এদেরকে একটু নিউট্রন দিয়ে ধাক্কা দিলেই ফঁটুঁস ফুঁটুঁস করে নতুন দুই তিনটা মৌল তৈরি করে দেয়।
বেশ মজার জিনিস। যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবে এগুলো হয়, তবে ভয়াবহতার অন্ত নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ফিউশন কাদের হবে?
হেহ্, আমি নাকি আরও বলব!
এখন আরেকটা প্রশ্ন, পরমাণুগুলো কীভাবে বুঝতে পারে যে ওর এখন নিউট্রন কে প্রোটন করতে হবে বা প্রোটনকে নিউট্রন করতে হবে? পরমাণুর তো প্রাণ নেই, তাহলে এগুলো বুঝে কেমনে?
হেহ্, চা-কফি খেয়ে লেখ্খাটা আব্বার পইড়া নিয়েন। স্যরি। ;)
তথ্যসূত্র:
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Gamma_ray
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Beta_decay
https://www.britannica.com/science/alpha-decay
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Alpha_decay
https://www.britannica.com/science/decay-constant
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Radioactive_decay
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Half-life
https://www.britannica.com/science/half-life-radioactivity
http://labman.phys.utk.edu/phys222core/modules/m12/nuclear_properties.html
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Particle_physics
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Valley_of_stability
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান