মনিফ শাহ চৌধুরী
১.
ও হ্যালো!
গোলাপী আলোর মাঝে টানা চার মাস খাটুনির পর Oryza sativa চারা ভর্তি বীজ নিয়ে হাসি দিলে আমার অন্তরে যেমন প্রশান্তি আসে ঠিক তেমন প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যাক আপনার অন্তরেও।
আমার কথা মনে আছে? চাষার ছেলে, মহাশূন্যে চাষবাস করি? ঠিক চিনেছেন। আমি অভি এবং এই মুহুর্তে চাষবাস থেকে অনেক দূরে।
ছয়টি X5 Ion Engine আমার স্পেসশিপকে প্রবল ধাক্কা দিয়ে ঘন্টায় নয় লাখ কিলোমিটার গতিতে বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পুরো ভ্রমণে সময় লাগার কথা ৩১ দিন।
রেফ্রিজারেটর ভর্তি কয়েকশ' কেজি Algae নিয়ে আমার এবারের মিশন ইউরোপাতে যেয়ে এগুলো বাচতে পারে কীনা তা দেখা, এবং একটা বেজ তৈরী করে ফেলা যেখানে চাষ করা সম্ভব হবে, এবং একই সাথে সেখানে কিছু ডিনামাইট সেট করে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসা।
ভাবছেন বোমার প্রয়োজন পড়ছে কেন? ব্যাপারটা আমারও পছন্দ না, কিন্তু একদল নীরস বিজ্ঞানীর মতে ইউরোপার বরফের আস্তরণের নিচে প্রাণ থাকতেও পারে। সেটা দেখতেই আমাকে পাঠানো। হাতের কাছে চাঁদ পেয়ে গেলে কার ধৈর্য্য সয়?
এই যে পৃথিবীর বাইরে প্রাণ থাকতে পারে, এই চিন্তাটা কেমন লাগে আপনার কাছে? বা কখনো কি ভেবেছেন বিজ্ঞানীরা কী করে ঠিক করে কোন গ্রহে প্রাণ থাকতে পারে? আসলে প্রাণের সংজ্ঞাটাই বা কী?
আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন আমি বলব প্রাণ হল এমন এক বৈশিষ্ট্য যা দ্বারা কোন কিছু নিজের প্রায় নিখুত রেপ্লিকা তৈরী করে। হ্যা অবশ্যই সেটা খাদ্য গ্রহণ করবে, বর্জ্য বের করবে বা নড়াচড়া করবে, কিন্তু এ সবই মুলত নিজের রেপ্লিকা তৈরী করার জন্য অপরিহার্য কিছু বিষয়।
সবচেয়ে সাধারণ প্রাণ তৈরী হওয়ার জন্য যেসব উপাদান বা আবহাওয়া প্রয়োজন সেগুলো আমাদের পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও কী থাকতে পারে না? স্রেফ আমাদের আকাশগঙ্গাতেই তো একশ' বিলিয়ন গ্রহ থাকার কথা। এর মাঝে মাত্র কয়েক হাজারটার মাঝে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে এমন ধারণা করা কী ভুল?
আমি যখন নীরস, নিষ্প্রাণ মঙ্গলের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছি, আমি এর মরীচারঙা মাটির দিকে তাকিয়ে ভাবি একসময় এই গ্রহেও পানি ছিল, হয়তো নিজস্ব ম্যাগনেটিক ফিল্ড ছিল। যেই গ্রহে প্রাণ প্রস্ফুটিত হতে পারত তা এমন নির্জন কেন?
প্রিয় সহযাত্রী, আমার জীবনের খোজে অভিযাত্রার একঘেয়েমি কাটাতে মহাকাশে প্রাণের সন্ধান কীভাবে করা হয় তা নিয়েই বকবক করে যাব। অনিচ্ছাস্বত্তেও পুরোটা শুনতে হচ্ছে আপনাকে, নয়তো যেকোনো সময়ই এয়ারলক উইন্ডো থেকে লাফ দিতে পারেন, ইয়োর চয়েজ!
শুরু করা যাক।
২.
একটা গ্রহে প্রাণ থাকবে কী থাকবে না তা নির্ভর করে এর অবস্থানের ওপর। তার নক্ষত্র থেকে এটা কতটুকু দূরে, বা এর গতি কীরকম ইত্যাদি বিষয়। আমাদের গ্রহ হ্যাবিটেবল জোনে রয়েছে। অর্থাৎ, সূর্য থেকে আমাদের পৃথিবী এতটাও কাছে নয় যে তরল পানি তৈরীই হবে না, আবার এতটাও দূরে নয় যে সব পানি বরফ হয়ে থাকবে। একটা আরামদায়ক, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে থাকার কারণে এর উপরিভাগে তরল পানি টিকে রয়েছে।
আমাদের সৌরজগৎ-এর হ্যাবিটেবল জোনে কিন্তু মঙ্গল গ্রহও আছে। তাই এর উপরিভাগে যে পানি তৈরী হতে পারে তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। নাসার তরফ থেকে হওয়া বিভিন্ন মিশনে মঙ্গলে একসময় নদী, খাল এমনকি সমুদ্র থাকার প্রমাণও মিলেছে।
হ্যাবিটেবল জোন একেক নক্ষত্রের জন্য আলাদা। আমাদের সূর্যের থেকে বিশাল বড় নক্ষত্রগুলোর হ্যাবিটেবল জোন সেই নক্ষত্র থেকে অনেক দূরে। এসব নক্ষত্র থেকে পাওয়া এনার্জির তীব্রতা অনেক বেশি হয়। আর জীবন ধারণের জন্য অবশ্যই এনার্জি প্রয়োজন। সমস্যা হল, এসব নক্ষত্রের বয়স অনেক অল্প হয়ে থাকে। এত বেশি পরিমাণে এনার্জি ছেড়ে কিছুদিন গর্জন করে মাত্র কয়েকশ' মিলিয়ন বছর পরেই জ্বালানী শেষ করে বসে থাকে। কয়েকশ' মিলিয়ন বছর আপনার কাছে অনেক মনে হলেও জীবন সৃষ্টি এবং বিবর্তনের জন্য খুবই নগণ্য একটা পরিমাণ এস্ট্রোবায়লজিস্টদের কাছে।
পৃথিবীর কথাই ধরা যাক। বয়স কত হবে? সাড়ে চার বিলিয়ন বছর। আর মাল্টিসেলুলার বা বহুকোষী প্রাণ কবে এসেছে? মাত্র ছয়শ মিলিয়ন বছর আগে। যদিও কিছু প্রমাণ রয়েছে যে দেড় বিলিয়ন বছর আগেও বহুকোষী প্রাণ ছিল, সেসব সত্য ধরে নিলেও পৃথিবীর সাড়ে তিন বিলিয়ন বছরের মত সময় লেগেছে উল্লেখযোয্য, বহুকোষী প্রাণ বিবর্তিত করতে।
তাহলে এত সময় কোন গ্রহ পাচ্ছে?
কম ভরের যে নক্ষত্রগুলো আছে সেগুলো নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহল বেশি। তার অন্যতম কারণ হল এসব নক্ষত্রের এনার্জি এমিশন যদিও অনেক অনেক কম, তাও সেগুলোর বয়স অনেক হয়ে থাকে। এদের জ্বালানী ফুরোতে ট্রিলিয়ন বছরও লাগতে পারে। অর্থাৎ, এদের গ্রহ, যেগুলো হ্যাবিটেবল জোনে আছে, সেগুলো অনেক সময় পায় প্রাণ সৃষ্টি ও বিবর্তনের জন্য।
এধরণের গ্রহের অবস্থান নক্ষত্রের অনেক কাছে হয়ে থাকে। অধিকাংশ সময়ই এরা টাইডাল লক- এ আটকে পড়ে। অর্থাৎ, এদের একপাশ সবসময় নক্ষত্রের দিকে থাকে, আরেকপাশ অন্ধকারের পানে। সেই হিসেবে এক পাশ অত্যাধিক গরম আরেকপাশ অত্যাধিক ঠান্ডা হওয়ার কথা, কিন্তু পানি কিছুটা বাষ্পীভূত হয়ে পুরো গ্রহে ছড়িয়ে পড়লে একটা গ্যাসীয় আবরণ তৈরী করবে। আর পানির গ্রিনহাউজ বৈশিষ্ট্যর কারণে গ্রহের ঠান্ডা অংশেও তাপ ধরে রাখা সম্ভব হবে। তাই অত্যধিক ঠান্ডা অঞ্চল এতটাও ঠান্ডা হবে না। আর গরম অংশেও সরাসরি বামন সূর্যের আলো পরবে না। আর গ্যাসীয় আবরণ থাকার ফলে বায়ুমন্ডলীয় চাপ যথেষ্ট থাকবে পানিকে তরলবস্থায় রাখার জন্য। চাপ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মঙ্গলেই আবার ফিরে তাকান। ওখানে এখন পানি রাখলে সাথে সাথে বাষ্পীভূত হবে। এর বায়ুমন্ডল এতটাই পাতলা। তাই ঘন বায়ুমন্ডল থাকলে জীবন ধারণের প্রথম চেকলিস্টে এসব গ্রহ উত্তীর্ণ হয়ে যায় সহজেই।
বায়ুমন্ডল তো স্রেফ তৈরী হলেই হবে না। গ্রহের ভর এমন হতে হবে যাতে এর মাধ্যাকর্ষণ এটাকে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট হয়। মঙ্গলের বায়ুমন্ডল আগে বেশ ঘন ছিল, তাই এর উপরিভাগে তরল পানি ছিল। কিন্তু এর কম ভর হওয়ার কারণে বায়ুমন্ডল ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায়।
তাই কোনো গ্রহে প্রাণ থাকতে পারে কি পারে না, সেটা বোঝার জন্য গ্রহের অবস্থান এবং ভর জানা খুব প্রয়োজন।
কী ভাবছেন, বকবকানি শেষ? শুরুই তো করলাম না।
৩.
আমার পাইলট সিটের ডান পাশে সপ্তর্ষী মন্ডল দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হল পৃথিবী থেকে আমি কখনো এটা দেখিনি। আলোদূষণকে দুষে লাভ নেই, বরং আমারই আগ্রহ ছিল না কখনো। আমার চিন্তা-ভাবনা সব ছিল নিজ গ্রহকে আরো বাসযোগ্য করে তোলা নিয়ে। ISS এ বোটানিস্ট হিসেবে কাজ করার উদ্দেশ্য আমার কখনোই এটা ছিল না যে একসময় মঙ্গলের বুকে সূর্যমুখীর হাসি দেখব কীংবা এন্ড্রোমিডার কোনো গ্রহের বাতাসে ভাসবে কাশফুলের বীজ। না, বরং আমার চেষ্টা ছিল কীভাবে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার যোগ্য করা যায় উদ্ভিদগুলোকে যাতে তারা আমাদেরই অসুস্থ পৃথিবীমায়ের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে পারে।
আর তাই, দূর হতে নক্ষত্রমালার আলো আমার জানালার কাচে বিচ্ছুরিত হতে দেখে খেয়াল হল, কোটি প্রাণের স্পন্দন এর জন্য আলোকে আমরা একটূ বেশিই কৃতিত্ব দিয়ে ফেলি না? প্রাণের সৃষ্টির এবং টিকে থাকার জন্য কী আসলেও আলোর প্রয়োজন আছে?
প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করি। প্রাণের বিকাশের জন্য যে অপরিহার্য এনার্জি সাপ্লাই প্রয়োজন সেটা কী শুধু আলো থেকেই আসতে হবে? অন্যকোনো ভাবে নেয়া সম্ভব না?
আপনার পেছনে তাকালে আপনি সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা সিলিন্ডার ভর্তি Algae দেখতে পাবেন। এর মাঝে কিছু আছে সবুজ, কিছু আছে লাল, কিছু আছে কালো, এবং কিছু সিলিন্ডার পুরোটা অন্ধকারে ঢেকে রাখা।
যেই সিলিন্ডারে আলোর উপস্থিতি নেই, তার ভেতর একটা ছোট্ট হিটিং ডিভাইস রয়েছে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপ সেটা সিলিন্ডারে সাপ্লাই দিচ্ছে, এবং এলগিরা সেভাবেই ইঞ্জিনিয়ার করা যাতে তারা এই তাপশক্তি কাজে লাগিয়ে জীবনের বিভিন্ন কাজকর্ম করতে পারে।
সত্যি বলতে ইঞ্জিনিয়ারিং করাটা এতটাও কঠিন ছিল না। স্রেফ প্রশান্ত মহাসাগরের তলে টেলুরিয়াম খনির আশেপাশে কিছু হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে বাস করা ব্যাক্টেরিয়ার ডিএনএ দিয়েই পুকুরবাসী এলগির মাঝে পরিবর্তন আনা গেছে।
সমুদ্রতলে যদি কোনো টেকটনিক প্লেট থাকে যেগুলোর নড়াচড়ার কারণে তৈরী হওয়া ফাটলের মাঝে সমুদ্রের ঠাডা পানি ঢুকে নিচে থাকা ম্যাগমার কারণে প্রচন্ড গরম হয়ে ওপরের দিকে প্রবাহিত হতে থাকলে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট সৃষ্টি হয়। সমুদ্রতলে থাকা প্রচন্ড চাপের কারণে পানির তাপমাত্রা কয়েকশ' ডিগ্রী পর্যন্ত বেড়ে যায়। এসব তাপ ব্যবহার করে কিছু এককোষী প্রাণ Chemosynthesis করতে পারে। এবং কোটি কোটি বছর পর আমরা হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের আশে পাশে আরো বড় প্রাণীদেরও দেখতে পাই, যেমন অন্ধ চিংড়ি।
তো বুঝতেই পারছেন, ইউরোপা আমার গন্তব্য কেন। ইউরোপার উপরিভাগের পুরোটাই বরফে ঢাকা। তবে এর নিচেই রয়েছে তরল লবণাক্ত পানির সমুদ্র। আশেপাশে থাকা অন্যান্য চাঁদ এবং বৃহস্পতির মাধ্যাকর্ষণের কারণে যে টাইডাল ওয়েভ তৈরী হয়, জোয়ার-ভাটা বলতে পারেন, তার ফলে এর মাঝে তাপমাত্রা একটু বেশি থাকে। এছাড়াও এর কোর এর তেজষ্ক্রিয় পদার্থের কারণেও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এর উপরন্তু, সমুদ্রতলে এর নিজস্ব হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট রয়েছে। অর্থাৎ, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপ। এক্ষেত্রে, বায়ুমন্ডলেরও প্রয়োজন পড়ছে না।
সেভাবে চিন্তা করলে আমাদের লিস্ট আরো লম্বা হয়ে যাচ্ছে। স্রেফ হ্যাবিটেবল জোনে থাকা গ্রহের দিকে না তাকিয়ে আমরা এও খোজ করতে পারি কোন চাদগুলোর গভীরে এমন উষ্ণ মহাসমুদ্র রয়েছে, যেখানে কেমিক্যাল স্যুপ ও হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের তাপ খেয়ে কিলবিল করতে পারে ভীনগ্রহী ব্যাক্টেরিয়া!
৪.
বোর হচ্ছেন? গ্রিন টি খান। এলগি পাউডার আর পরিশোধিত মুত্র দিয়ে বানিয়েছি। আরেহ ভাববেন না, এই স্পেশাল এলগিরা ফ্রুকটোজ জমায় নিজেদের কোষে, চা খেতে মোটেও তিতা লাগবে না। কী বললেন? ও, এখনও পরিশোধিত মুত্রেই আটকে আছেন। ওয়াসার পানি খেয়ে বড় হয়েছেন, ঢং না করে এটা খেয়ে নিন, পুরো মহাবিশ্বে এরচেয়ে বিশুদ্ধ পানি আর কোথাও পাবেন না।
পানির কথায় খেয়াল হল, এই পানিকেও কী জীবনের জন্য একটু বেশিই কৃতিত্ব দেয়া হয় না? বলুন দেখি, পানির এত সুনাম কেন? অন্যতম কারণ হচ্ছে এটা অনেক ভাল একটা solvent বা দ্রাবক। এর মাঝে নানান কেমিক্যাল দ্রবীভূত হতে পারে যার ফলে অনেক রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্ভব হয় যা জীবন ধারণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে পানিই একমাত্র নয়।
আসুন পরিচিত হই কার্বন ডাইঅক্সাইডের সাথে। ভাবছেন এর সাথে নতুন করে আর কি পরিচিত হবেন? এই ভোলাভালা, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্যাস যে কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে পানির চেয়েও ভাল দ্রাবকের পরিচয় দেয় তা জানা ছিল আপনার?
Super Critical Fluid বা SCF হল যখন একটা কমপাউন্ড নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও চাপের সীমা অতিক্রম করার ফলে এটা তরল ও গ্যাসীয় অবস্থার মাঝামাঝি কিছু একটাতে থাকে। এর ফলে, এটা কঠিন পদার্থের ভেতর দিয়ে গলে বেরিয়ে যেতে পারে ঠিক কোনো গ্যাসের মত, আবার এর মাঝে কোনো কিছুকে দ্রবীভূত করতে পারে তরলের মত। সুপার ক্রিটিকাল ব্যাপার-স্যাপার।
কার্বন ডাইঅক্সাইডের ক্রিটিকাল পয়েন্ট হল ৩১.১ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৭২.৯ atm বা বায়বীয় চাপ। পৃথিবীতে এমন চাপ আপনি সহজেই সমুদ্রের আধা-মাইল নিচে পাবেন। পৃথিবীতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের সুপারক্রিটিকাল ভার্সন ব্যবহার করা হয় কফির বীজ থেকে ক্যাফেইন কমানোর জন্য।
পানির চেয়েও কার্বন ডাইঅক্সাইডের এই রূপ ভাল দ্রাবক। এমনকি এটায় এনজাইম আরো বেশি স্ট্যাবল থাকে, অর্থাৎ, তারা তাদের Substrate molecule দের ব্যাপারে আরো বেশি নির্দিষ্ট বা স্পেসিফিক থাকে যার ফলে অপ্রয়োজনীয় সাইড রিয়েকশও হয় না।
কথা হচ্ছে, শুক্র গ্রহের বায়ূমন্ডলের ৯৭% হল কার্বন ডাইঅক্সাইড। আর এর গড় তাপমাত্রা ৪৬৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস ও চাপ হল ৯০ atm. অর্থাৎ, ক্রিটিকাল ফ্লুইড হওয়ার জন্য বেশ উপযোগী পরিবেশ। শুক্রের বায়ূমন্ডলে সুপার ক্রিটিকাল কার্বন ডাইঅক্সাইড রয়েছে এটা সহজেই অনুমেয়। প্রশ্ন করতে পারেন, জীবন কী এই গ্যাসের মাঝে বাচতে পারবে?
সত্যি বলতে আমাদের নিজ গ্রহেরই কিছু অণুজীবদের SC-CO2 এর মাঝে ছেড়ে দিলে তারা দিব্যি বাচতে পারে, তাদের এনজাইম সহজেই বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারে।
বিজ্ঞানীরা তাই এমন গ্রহের দিকেও চোখ রাখেন যেগুলোতে SC-CO2 আছে।
৫.
একটু কষ্ট করে সিট বেল্ট বেধে বসে পড়ুন, মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ ব্যবহার করে একটু দিক পরিবর্তন করব। ওই যে কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে, আমরা প্রবল বেগে নিচের দিকে পড়ছি, তবে আমাদের আদি বেগের কারণে সামনের দিকেও এগোচ্ছি। অরিজিনাল ট্র্যাজেক্টরি একটু বেকে মঙ্গলের অপর পাশের দিকে চলে যাবে, এরপর আবার সোজা পথ ধরে এগোতে থাকব কিছুদিন, পৌছে যাব ইউরোপাতে।
এতে দিক পরিবর্তনে জ্বালানি কম লাগল বুঝলেন? এটাকে সায়েন্স ফিকশনের ভাষায় গ্র্যাভিটিশনাল স্লিং শট বলা হয়।
দুঃখিত, চিৎকার করার কোনো প্রয়োজন ছিল না, উত্তেজিত হয়ে গেছিলাম আর কি।
প্রবল বেগে সামনে এগোচ্ছিলাম, পুরো ম্যান্যুভার ১১২ বার অনুশীলন করেছি সিমুলেশনে, সবই মুখস্থ। কিন্তু হঠাৎই চোখের সামনে কী যেন চকচক করে উঠল। মনিটরে দেখি খুবই ছোট ছোট ডট দিয়ে পুরো স্ক্রিনের উপরিভাগ ভর্তি হয়ে গেছে। এখানে উল্কাপিন্ড বা asteroid তো থাকার কথা নয়। তাহলে?
আমার মাথায় সম্ভাব্য অনেক কিছুই চলছে, সবচেয়ে ভয়ানক যেটা সেটাই ধরে নিলাম।
প্রিয় কসমোনাট, আপনি জলদি স্পেসস্যুট পড়ে নিন, আমি কন্ট্রোল রুম ফোর্সড ভ্যাক্যুয়েম করছি। মানে এই ঘর থেকে সব বাতাস বের করে দেব, কারণ ওই ক্ষুদ্র চকচকে জিনিসগুলো যদি আমাদের শিপে আঘাত হানে সামনের কাচও ভেঙে যেতে পারে, তখন ভেতরে বাতাস থাকলে আমরা হুশ করে বাইরে বের হয়ে যাব, শ্বাস আটকে মারা যাওয়ার আগে ভেতর থেকে সেদ্ধ হয়ে যাব। তাড়াতাড়ি!
জিজ্ঞেস করছেন ওই জিনিসগুলো কী? আমার ধারণা মতে ওগুলো স্পেস জাঙ্ক বা আবর্জনা। জানেন তো, মানুষ যেখানেই যায় আবর্জনা ছড়িয়ে আসে। আমরা গত কয়েক দশকে তো কম মিশন পাঠাইনি মঙ্গলে। সেই প্রজেক্টগুলোর জাঙ্ক এগুলো। এসব সমস্যার সমাধান না করলে একসময় দেখা যাবে পৃথিবী থেকেই কোনো রকেট উড়তে পারছে না, নিজেদের আবর্জনার জেলে নিজেরাই আটকে পড়ব। যে গতিতে এগোচ্ছি তাতে হালকা ম্যান্যুভার করে পাশ কেটে যাওয়ার উপায় নেই, সঙ্ঘর্ষ অনিবার্য!
স্যুট না পড়া থাকলে চা খেতে পারতাম। আর কয়েক সেকেন্ড, আমাদের ও তেজষ্ক্রিয়তায় মরণের পথে বাধা হয়ে আছে চার সেন্টিমিটার পুরু সাঁজোয়া কাচ। প্রয়োজন শুধু অল্প একটু ফাটলের, সাথে সাথেই সূর্য থেকে আসা অতি উৎসাহী তেজষ্ক্রিয় আলো গ্রাস করে নেবে আমাদের। অথবা করবে না, আমরা বেচে যাব।
তেজষ্ক্রিয়তা! প্রকৃতিতে যা প্রাণ নেয়, তা প্রাণ দেয়ও। জানতেন?
৬.
বিজ্ঞানীরা প্রাণ আছে এমন সম্ভাব্য গ্রহের লিস্ট তৈরী করার সময় সেই গ্রহে তেজষ্ক্রিয় পদার্থ কতখানি আছে সেটায় খুব জোর দেন। কারণ, একটা গ্রহে টাইডাল ওয়েভ বা সরাসরি এর নক্ষত্র থেকে পাওয়া আলো ছাড়াও এর অভ্যন্তরীন তেজষ্ক্রিয় পদার্থ তাপ তৈরীতে ভূমিকা রাখে। তেজষ্ক্রিয় পদার্থ অবশ্যই এমন হতে হবে যেগুলোর হাফ-লাইফ অনেক অনেক বেশি, যেমন ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম বা পটাশিয়াম, যাতে তারা গ্রহে লম্বা সময় ধরে টিকে থাকতে পারে।
শুধু যে তাপ তৈরী করবে সেটাই একমাত্র কারণ নয়। অভ্যন্তরীন তেজষ্ক্রিয় তাপের ফলে গ্রহে নিজস্ব একটা ডায়নামো বা মেকানিজম শুরু হতে পারে যা থেকে Plate Tectonics শুরু হতে পারে যেটা গ্রহের উপরিভাগ বা Crust এ বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে পারে, এমনকি গ্রহের নিজস্ব ম্যাগনেটিক ফিল্ডও তৈরী করতে পারে।
ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরী হওয়া মানে নক্ষত্র থেকে আসা ক্ষতিকর সোলার উইন্ড বা কসমিক রশ্মি থেকে রক্ষা পাওয়া। ঠিক যেমন বৃষ্টির সময় আপনার ঘরের ছাদ আপনাকে রক্ষা করে।
আর Plate tectonics এর ব্যাপারে বললে এটা ভেতরের তাপ রেগুলেট করতে সহায়তা করবে। মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে সেই তাপ বাইরেও বের করে দেবে যার ফলে সহজেই বায়ূমন্ডল তৈরী হবে। সবকিছু প্রাণের পক্ষে !
এখন প্রশ্ন থাকে কতটুকু তেজষ্ক্রিয়তা প্রয়োজন? ওয়েল, উত্তরটা আপনার জানার কথা। ঠিক পৃথিবীর মত! বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর তেজষ্ক্রিয়তার মডেল তৈরী করে সেটার মান ওঠা নামা করিয়ে সিমুলেশনে পরীক্ষা করেছেন। দেখা গেছে যদি তেজষ্ক্রিয়তা পৃথিবীর চেয়ে বেশি হয় তাহলে ডায়নামো মেকানিজম খুব বেশিদিন টিকবে না। যেহেতু তেজষ্ক্রিয় পদার্থগুলো দ্বিতীয় লেয়ার অর্থাৎ mantle এ থাকে, তাই ওই লেয়ার বেশিই গরম হয়ে গেলে সেটা অনেকটা insulator এর মত কাজ করবে। নিচের কোর তখন তাপ রেগুলেট করতে পারবে না ঠিক মত, তাই ম্যাগনেটিক ফিল্ডও থাকবে না।
আবার খুব বেশি তেজষ্ক্রিয়তা মানে খুব বেশি তাপ, খুব বেশি আগ্নেয়াগিরি, খুব বেশি mass extinction ঘটনা ঘটা। কী একটা অবস্থা!
আবার তেজষ্ক্রিয়তা কম অর্থাৎ কোনো ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা আগ্নেয়াগিরিই না হওয়া। সহজভাষায় বললে গ্রহটা নিজের সিভি তৈরী করলে কোয়ালিফিকেশনে লিখতে হবে, "মৃত গ্রহ"।
এস্ট্রোনমাররা বিভিন্ন তারা, সুপারনোভা এবং সম্প্রতি নিউট্রন স্টার কোথাও সংঘর্ষ করলে সেখানে চোখ রাখছেন যে ইউরেনিয়াম্বা থোরিয়াম তৈরী হচ্ছে কী না। কারণ যেই নক্ষত্রের মাঝে এগুলো থাকবে তার আশেপাশের গ্রহেও এগুলোর উপস্থিতি পাওয়া যেতে পারে। কথা হচ্ছে এগুলো খুব বেশি নজরে আসে না। তাই ইউরোপিয়াম নামের এক এলিমেন্টেরও খোজ করা হয়। কারণ এটাও একই প্রসেসে তৈরী হয় যেই ভাবে ইউরেনিয়াম আর থোরিয়াম হয়। তাই এটার উপস্থিতি মানে বাকিরাও সেখানে আছে সেই আশা করা যায় আর কি।
ভাবছেন এতদূর থেকে কীভাবে বুঝি কোন তারায় কী আছে? এটাকে spectroscopy বলে। দূর নক্ষত্র হতে আসা রেডিও ওয়েভ, আলো বা এক্স-রে ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখা হয় যে এরা কোন ফ্রিকোয়েন্সীতে তরঙ্গ দিচ্ছে, এরপর ডাটাবেসের সাথে মেলানো হয় কোন এলিমেন্ট এমন সিগনেচার দেয় সেসব মিলিয়ে ধারণা করা হয় কোন পদার্থ থাকতে পারে।
নিউটনের কথা মনে আছে? কীভাবে একটা প্রিজমের মাঝে আলো ঢুকিয়ে রঙধনু বানিয়েছিলেন তিনি। আলোর এই ছড়িয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যকে বলে dispersion. যেই আলোই পাচ্ছি আমরা মহাকাশ থেকে সেটাকেই বিচ্ছুরিত করে ফেলছি এটা দেখতে যে কোন স্পেক্ট্রামের আলো এগুলি। বোঝার সুবিধার্থে বলি, ক্লাস নাইনের chromatography-র মতই শুধু এখানে আলো নিয়ে কারসাজি।
৭.
বকবক করতে করতে খেয়াল করিনি আপনি ভয়ে আধ্মরা হয়ে আছেন। চোখ খুলতে পারেন, তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। হালকা চিড় ধরেছে কাচের সামনের অংশে তবে তেমন কিছুনা। চেম্বারে আবার বাতাস ভর্তি করাই যায়। এই যে সুইচ টিপে দিলাম।
আমাদের এখন শীতঘুমে যেতে হবে। সাইফাই মুভিতে দেখেছেন নিশ্চয়ই, ক্রায়োস্লিপে থাকে নভোভারীরা। অতি ঠান্ডা তাপমাত্রায়, বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়া যায়। বয়স বাড়ে না। ওয়েল সেটা ফিকশন। তবে আমার শিপে যেটা আছে সেটা বাস্তব। টোটাল লিকুইড হাইবারনেশন বলে এটাকে। শরীরের মেটাবলিজম অনেক কম রাখা যায়। এতে অক্সিজেন খরচ, খাবার খরচ কম হয়। কয়েকমাসও কাটিয়ে দেয়া যায় কিছু মডেলে। আপনিও ঢুকে পড়ুন। ঘুম আনার জন্য আমি রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা শুনতে থাকব, আর আপনার জন্যেও প্লে লিস্ট ঠিক করে রেখেছি, চিন্তা করবেন না। আপনি শুনবেন জীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ কার্বন এলিমেন্টের প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা। আমি সেন্ট্রাল কম্পিউটারকে কমান্ড দিয়ে রেখেছি, আপনি ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত এটা শোনাতে থাকবে আপনাকে। ওভাররাইট অথরিটি আপনার নেই, আর উল্টাপাল্টা সুইচ চাপাচাপি করবেন না, শেষে দুজনেই মারা পড়তে পারি।
ওকে, হ্যাপি স্লিপিং!
৮.
কার্বন। ৬টা ইলেকট্রন, ৬টা প্রোটন। আহামরি কী?
আমাদের গ্রহের যেখানেই তাকাই প্রাণের স্পন্দন দেখতে পাই। বড়সড় হাতি, তিমি কীবা অজগর থেকে শুরু করে ছোটখাট কেচো, ব্যাক্টেরিয়া বা এলগি এমনকি ভাইরাস। সবখানেই জীবন যৌগের প্রমাণ মেলে। জীবন যৌগ, তা RNA বা DNA হোক সেটার মলিকিউলার গঠনে তাকালে আমরা কার্বন পাই। সেটা neucleotide এ থাকা রাইবোজ সুগার হোক আর সাথে লাগোয়া নাইট্রোজেনাস বেজ হোক, কার্বন তো আছেই।
কার্বন যেহেতু একই সাথে চারটা আলাদা অণুর সাথে বন্ড তৈরী করতে পারে তাই এটা বিশাল বড় বড় চেইন তৈরী করতে পারে, যেমন ডিএনএ বা প্রোটিন ইত্যাদি। তবে প্রাণের মেরুদন্ড কার্বনের প্রতিপক্ষ হতে পারে সিলিকন।
সিলিকনও একই সাথে চারটা অণুর সাথে বন্ড তৈরী করতে পারে। কার্বনের সাথে এর খুব মিল। এমনকি পৃথিবীর নানান ঘাস ও এলগির মাঝে সিলিকন ডাইঅক্সাইডের ক্ষুদ্র অংশ পাওয়া যায়। তবে এখনও কার্বন-সিলিকন মিলে কোনো কিছু তৈরী করেছে এমনটা প্রকৃতিতে দেখা যায় না।
কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ফ্রান্সিস আর্নোল্ড, সিনথেটিক অর্গানিক কেমিস্ট জেনিফার কান, বায়োইঞ্জিনিয়ার রাসেল লুইস এবং কেমিস্ট কাই চেন মিলে অণুজীবদের দ্বারা কার্বন-সিলিকন একত্রে করে মলিকিউল তৈরী করিয়েছেন। তারা জানান, যে জিনিস আমরা ল্যাবে করেছি আমার বিশ্বাস প্রকৃতি কোথাও না কোথাও সেটা ঠিকই করতে পেরেছে।
প্রথমত বায়লজিক্যাল সিস্টেম অনেক জটিল, এবং সেগুলোকে সরাসরি ইনফ্লুয়েন্স করা, কন্ট্রোল করা বিজ্ঞানীদের জন্য বেশ কঠিন। তাই তারা সহজ পথ বেছে নিলেন। তারা অণুজীবদের সিলেক্টিভ ব্রিড করাতে লাগলেন এবং একই সাথে তাদের এনভায়রনমেন্ট হালকা বদলে দিলেন। এভাবে ধীরে ধীরে জেনারেশন পর জেনারেশন ধরে তাদের একটু একটূ করে কাঙ্খিত মলিকিউল তৈরী করতে ডিরেক্ট করছিলেন তারা। ব্যাপারটা অনেকটা সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মতই। এই টেকনিকের নাম হল Directed Evolution. অর্থাৎ, অণুজীবদের বিবর্তন করা ঠিক আমরা যেমন চাই সেভাবে। এভাবে অনেক কেমিক্যাল তৈরী করা হয় এখন, যেমন ডিটারজেন্ট, ওষুধ বা জ্বালানী, যেগুলো সাধারণ ফ্যাক্টরিতে তৈরী করতে গেলে অনেক বর্জ্য তৈরী হয়। তার তুলনায় অণুজীবদের ব্যবহার অনেকটাই পরিবেশবান্ধব।
বিজ্ঞানীদের এই ক্ষুদ্র দলটির মূল উৎসাহ ছিল এমন এনজাইম তৈরী করানো অণুজীবদের দিয়ে যেই এনজাইম অর্গানো-সিলিকন বেজড মলিকিউল তৈরী করবে। এরজন্য শুরু করা হয়েছিল এমন এনজাইম ওয়ালা অণুজীবদের দিয়ে যেই এনজাইম সিলিকনকে কিছুটা হলেও পরিচালনা করতে সক্ষম। এরপর সেই অণুজীবদের ডিএনএর মিউটেশন করানো হয়, যেটা ছিল পুরোপুরি র্যান্ডম। তারা নিজেরাও জানতেন না মিউটেশনের ফলে কী রেজাল্ট আসবে। এরপর দেখা হয় কারা সিলিকন রিলেটেড রিয়েকশনের আগের তুলনায় ভাল করছে। তাদের আলাদা করে নিয়ে আবার মিউটেড করা হয়। এভাবে অনেক জেনারেশন প্রসেসটা রিপিট করতে করতে একসময় তারা তাদের কাঙ্খিত এনজাইম পেয়ে যান।
অর্গানো-সিলিকন বেজড মলিকিউল তৈরী করার মত এনজাইম তৈরী করতে যেয়ে তারা দেখেন খুব বেশি মিউটেশন লাগেনি। এমনকি, এক প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়া তো মাত্র তিনবার মিউটেড হয়েই খুবই ভাল মানের এনজাইম তৈরী করেছে। যদিও পুরো ব্যাপারটা র্যান্ডম তারপরেও প্রকৃতিতে অর্গানো-সিলিকন বেজড এনজাইম যে কত সহজে তৈরী হওয়া সম্ভব তা আমরা ধারণা করতে পারি।
মহাবিশ্বে কার্বনের চাইতে সিলিকন অনেক অনেক বেশি পাওয়া যায়। তাই বিজ্ঞানীদের লিস্ট আরো লম্বা করে এমন গ্রহতেও ঢু মারতে হবে যেখানে...
[কম্পিউটার ভয়েসঃ Subject Fallen Asleep. Set awakening schedule to T-24 days 13 hours 59 mins:]
৯.
হ্যালো এগেইন! কেমন লাগছে লম্বা ঘুম দিয়ে উঠে? ফ্রেশ হতে চাইলে বাথরুমে যেতে পারেন। পানি ব্যবহার করতে পারবেন না যদিও, টিস্যু আছে।
আমরা এই মূহুর্তে ইউরোপা কে কেন্দ্র করে ঘুরছি। এই চাদের আরেকটা বিশেষত্ব হল এতে ম্যাগনেটিক ফিল্ড আছে, বাতাসে খুবই হালকা অক্সিজেন আছে। তাকান এর দিকে, সৌরজগৎ এর সবচেয়ে মসৃণ পৃষ্ঠতলের দিকে চেয়ে রইবেন। কোথাও উচু-নিচু নেই, পাহাড় পর্বত নেই, গর্ত নেই। যেন আক্ষরিক অর্থেই বিশাল এক বরফের গোলক।
আমরা কিছুক্ষণ অরবিটে থাকব, লোকেশন পিনপয়েন্ট করা মাত্রই অবতরন করব। তখন ভয়ে পেচ্ছাব করে দিলে চলবে না কিন্তু। হে হে!
মাইন্ড করে লাভ নেই। এটা প্রকৃতির নিয়ম। সবাই মুত্র বিসর্জন করে, আমিও করি। আমার সিলিন্ডারে রাখা এলগিরাও বর্জ্য ছাড়ে। ব্যাক্টেরিয়াও একই। এর কারণ হচ্ছে আমরা সবাই একেবারে মলিকিউলার লেভেলে একইরকম। সবার মাঝেই ডিএনএ রয়েছে। প্রাণ আছে তো ডিএনএ থাকবেই!
আবার বেশি বলে ফেললাম। প্রাণের জন্য কী আসলেই ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিডই দরকার? অন্য কোনো মলিকিউল প্রাণ গঠন করতে পারে না? জেনেটিক তথ্য জেনারেশন থেকে জেনারেশনে পাঠানোর জন্য কী ডিএনএ ছাড়া আর কেউ নেই?
একই প্রশ্ন করা হয়েছিল এক সুপার কম্পিউটার কে। তাকে একটা পরিশীলিত প্রোগ্রাম দেয়া হয়েছিল যেটার কাজ ছিল ডিএনএ-র মত আর কতগুলো স্ট্যাবল মলিকিউল থাকতে পারে সেটা বের করা। মলিকিউলগুলো ডিএনএ-র মতই দুটো স্ট্র্যান্ড তৈরী করবে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রোগ্রামটি ১১ লক্ষেরও বেশি কম্বিনেশন দিয়েছে যেগুলো ডিএনএ-র সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে।
ভেবে দেখুন তো, আমরা যে অন্য গ্রহে প্রাণের খোজ করছি, আমরা কী নিজেরাও ধারণা করতে পারি সেই প্রাণগুলো কেমন হতে পারে? তাদের বায়োকেমিস্ট্রি কত আলাদা হতে পারে তার ইয়ত্তা নেই। সেক্ষেত্রে প্রাণ তৈরী হওয়ার জন্য যে পৃথিবীর মতই পরিবেশ লাগবে এটা অমূলক হয়ে যায়।
আমরা নামছি বেশ জোরে, কিন্তু কাপুনি অল্পই হচ্ছে, কারণ ইউরোপার বায়ূমন্ডল বেশ পাতলা। বরফ থেকে মাত্র কয়েক মিটার ওপরে থাকতেই আমাকে থ্রাস্টার ব্যবহার করে গতি কমাতে হবে। দক্ষ পাইলট হিসেবে স্বীকৃতি নিতেই পারি।
দরজা খুলে যাবে কিছুক্ষণ পরেই। সহযাত্রী, ইউরোপায় প্রথম মানুষ হিসেবে অবতরণ করতে কেমন লাগছে? আমি অবশ্য আগে আমাদের চাদে নেমেছিলাম তাও মহাকাশ দস্যুদের থেকে চুরি যাওয়া কলা ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু আপনার জন্য তো সব নতুন। আপনার প্রথম বাক্য কী হবে? দরজা খুলে গেছে, পা রেখে কিছু বলুন। এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ আগামী অনেক দশক মানুষ এসব তাদের পাঠ্যবই এ অধ্যায়ন করবে। অ্যাঁ!? কী বললেন?
হা ঈশ্বর! Oryza sativa মানে ধান গাছ! শান্তি?
(সমাপ্ত)
রেফারেন্সঃ
1. জীবনের খোজে- https://exoplanets.nasa.gov/search-for-life/can-we-find-life/
2. তেজষ্ক্রিয় প্রাণ- https://astrobiology.nasa.gov/news/how-radioactivite-elements-may-make-planets-suitable-or-hostile-to-life/
3. https://www.cell.com/current-biology/pdf/S0960-9822(12)00327-2.pdf
4. https://www.scientificamerican.com/article/searching-for-life-on-other-planets/
5. কোন গ্রহে খুজব?! - https://astronomy.com/magazine/2020/09/planets-and-life
6. জীবন যৌগের অন্য ভার্সন- https://www.eurekalert.org/pub_releases/2019-11/tiot-dio103119.php
7. Supercritical CO2- https://www.mdpi.com/2075-1729/4/3/331
মনিফ শাহ চৌধুরী
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান