আবু রায়হান
১।
সাগর যেমন অসীম সম্পদের ভান্ডার, ঠিক তেমনই সাগর সর্বনাশা হয়ে হাজির হতেও জানে। সাগরের সেই সর্বনাশা রূপেরই একটি বহিঃপ্রকাশ হলো ঘূর্ণিঝড়।
আর আমরা হলাম পৃৃথিবীর অন্যতম ঘূর্ণিঝড়
প্রবণ অঞ্চলের বাসিন্দা।
ভূমিকা দীর্ঘায়িত করব না।
তো, দেরি না করে চলুন জেনে নিই ঘূর্ণিঝড়ের নাড়িভুঁড়ি সম্বন্ধে।
ধৈর্য ধরে না পড়লে সব মাথার ওপর দিয়ে যাবে।
ঘূর্ণিঝড় কীভাবে হয় সেটা বোঝার আগে কর্কটক্রান্তি রেখা, মকরক্রান্তি রেখা, উত্তর গোলার্ধ, উত্তর মেরু, দক্ষিণ গোলার্ধ, দক্ষিণ মেরু এসব চেনা প্রয়োজন। এসব চিনতে নিচের চিত্রে ভালোভাবে খেয়াল করুন, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে।
আমরা জানি, পৃৃথিবীকে পূর্ব-পশ্চিমে বেষ্টনকারী কাল্পনিক কর্কটক্রান্তি রেখা ও মকরক্রান্তি রেখার অক্ষাংশ একই কিন্তু কর্কটক্রান্তি রেখা হলো পৃৃথিবীর নিরক্ষ/বিষুবরেখার উত্তরে আর মকরক্রান্তি রেখা বিষুবরেখা থেকে দক্ষিণে।
সূর্যের আলো এই রেখাব্যাপী লম্বভাবে কিরণ দেয়।
চিত্রে দেখুন-নিরক্ষরেখা, কর্কটক্রান্তি রেখা, মকরক্রান্তি রেখা।
এই দুটি রেখাব্যাপী যে অঞ্চলগুলো রয়েছে তাতে সূর্যের আলো সবচেয়ে বেশি পতিত হয়। ফলে এই অঞ্চলগুলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল/ক্রান্তীয় অঞ্চল (Tropics) বলে।
চিত্রে দেখুন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল।
এই দুই ক্রান্তিরেখার মাঝের অঞ্চলটুকু এবং এই দুটি রেখার হালকা আশেপাশের বা বাইরের অঞ্চলে সূর্যের আলো তুলনামূলক তীব্রভাবে পতিত হয়ে থাকে বা পেয়ে থাকে
কেন এ অঞ্চল অধিক উত্তপ্ত থাকে ?
আমরা জানি, লম্ব/খাড়াভাবে কোথাও সূর্যের আলো পড়লে তাতে তাপের প্রভাব বেশি থাকে, কারণ তাপ বেশি ছড়িয়ে পড়ে না। কিন্তু
কোনো স্থানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে যদি সেখানে সূর্যালোক একটু কাত/তীর্যক হয়ে পড়ে, তবে তার আলো আশেপাশের বৃহত্তর এলাকায় ছড়িয়ে যাবে। ফলে তীর্যকভাবে সূর্যালোক পড়েছে এমন এলাকা লম্বভাবে আলোকপ্রাপ্তির চেয়ে কম মাত্রায় আলো ও তাপ পাবে।
চিত্রে দেখুন ক্রান্তীয় অঞ্চলে সূর্যালোকের খাড়া পতন।
২।
Clockwise এবং Anti বা Counter Clockwise :
(ঘড়ির কাঁটার দিক এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিক কথাটার মানে কি ? )
আমরা জানি, ঘড়ির কাঁটা সবসময় ডান থেকে বামে যায়।
ঘড়ির কাঁটা যেমন ডান থেকে বামে যায় ঠিক তেমনই যদি কেউ যায় বা গতিশীল থাকে তবে তার গতির দিককে বলি ঘড়ির কাঁটার দিক বা clockwise।
আর যদি ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘোরে মানে ১ থেকে ২,৩,...১১ না গিয়ে
উলটা মানে ১,১২,১১,১০.......এভাবে যায় তবে তার গতির দিককে বলা হবে Anti বা Counter Clockwise ।
চিত্রে দেখুন ক্লকওয়াইজ, অ্যান্টিক্লকওয়াইজ।
★নিম্নচাপ এবং উচ্চচাপ কী ?
এ দুটো জানার আগে আমাদের জানা প্রয়োজন যে বায়ুচাপ কী।
বায়ুচাপ :
পৃথিবীর চারদিকে বায়ুমণ্ডল বেষ্টন করে আছে। পৃথিবী তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাহায্যে বায়ুমণ্ডলকে নিজের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে। ফলে অন্যান্য পদার্থের মতো বায়ুরও ভর অনুভূত হয়। বায়ুর এই ভরকেই বায়ুচাপ (Pressure of Air) বলে ।
সমুদ্রপৃষ্ঠে বায়ুর চাপ এক বর্গ ইঞ্চিতে প্রায় ১৪.৬৯৬ পাউন্ড বা প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ১ কিলোগ্রাম ভরের সমান।
যতই ওপরে ওঠা যায় বায়ুস্তরের গভীরতা ততই কম হয় (আরও ওপরে ভিন্ন রকম)। সেজন্য চাপও কমে যায়। বিভিন্ন স্থানের বায়ুর চাপের মধ্যে পার্থক্য থাকে। এমনকি সকল সময়েও একই স্থানে বায়ুর চাপ সমান থাকে না।
বায়ুচাপ মূলত দুই প্রকার। যথা–
১। উচ্চচাপ (High Pressure)
২। নিম্নচাপ (Low Pressure)
★উচ্চচাপ :
ভূপৃষ্ঠের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট আয়তনের বায়ুর চাপ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অপেক্ষা বেড়ে গিয়ে যখন সেটি ১০১৩.২৫ মিলিবারের তার বেশি হয়, তখন তাকে বায়ুর উচ্চচাপ (High Pressure) বলা হয়।
নিম্নচাপ :
ভূপৃষ্ঠের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট আয়তনের বায়ুর চাপ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অপেক্ষা কমে গিয়ে যদি সেটি ৯৮৬ মিলিবার বা তার কম হয়, তখন তাকে বায়ুর নিম্নচাপ (Low Pressure) বলে ।
(সামনে বিস্তারিত আলোচনা আসছে)
৩।
নিম্নচাপ এবং উচ্চচাপ কীভাবে সৃষ্টি হয় ?
আমরা জানি, তাপের ফলে পদার্থের কণার গতিশক্তি/কম্পনশক্তি বেড়ে যায়। যত বেশি তাপ, তত বেশি গতিশক্তি প্রাপ্তি। আর যত গতিশক্তি বাড়ে বা পদার্থের কণাগুলো যত বেশি কাঁপে তত তাদের, মানে কণাদের মাঝের আন্তঃকণা আকর্ষণ শক্তি ধীরে ধীরে কমে যায়। আবার, বায়বীয় পদার্থ যেমন বাতাসের ওপর চাপ এবং তাপের প্রভাব উভয়ই বেশি। কোনো অঞ্চলে দীর্ঘক্ষণ সূর্যের তাপ পড়লে তাপের উষ্ণতায় সেখানকার বাতাস তাপশক্তি পেয়ে বায়ুর কণাগুলোর গতিশক্তি বেড়ে যায়। কণাগুলোর কম্পন বৃদ্ধি পেয়ে তাদের ছুটাছুটি বেড়ে যায়। ফলে বাতাস প্রসারিত ও হালকা হয় এবং সেখানকার বায়ুর ঘনত্ব কমে যায়। ফলে এটি আশেপাশের বায়ুর চেয়ে তুলনামূলক অধিক হালকা হওয়ায় হালকা বায়ু ওপরে উঠতে থাকে এবং আশেপাশের ও উপরিস্তরের তুলনামূলক ভারী, ঠান্ডা বায়ু নিচে নামতে থাকে বা চারপাশের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে ছুটে আসতে থাকে। আর নিম্নচাপ অঞ্চলের সে হালকা বায়ুর চাপও কম হয় কারণ বায়ুর ঘনত্ব তাতে তুলনামূলক কম।
অর্থাৎ যে অঞ্চলে অত্যধিক তাপ পতিত হয় সেখানকার বায়ুর চাপ কম হয়ে যায়। আর সে পরিবেশে বায়ুর সে কম চাপীয় অবস্থাকে বায়ুর নিম্নচাপ বলে।
আবার, সমুদ্র সমতল থেকে যতই ওপরে ওঠা হয় ততই বায়ুস্তরের গভীরতা কমতে থাকে। তাই বায়ুর চাপও কমে যায়। এই বিষয়গুলো জেনে রাখেন, সামনে কাজে আসবে।
চিত্রে উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপ এলাকায় বাতাসের চলন।
আর কোনো অঞ্চলে যদি সূর্যের তাপ তেমন একটা না পতিত হয় তবে সেখানের বায়ু এত হালকা হয় না বা প্রসারিত হয় না। ফলে সেখানকার বায়ুর ঘনত্বও তেমন একটা কমে না। সে অঞ্চলের বায়ু এই কারণে তুলনামূলকভাবে নিম্নচাপ অঞ্চলের বায়ু থেকে তুলনামূলকভাবে ভারী থাকে। সেখানকার বায়ু যেহেতু তেমন প্রসারিত হয়নি বা হালকা হয়নি ফলে সেখানকার বায়ুর ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি থাকায় সেখানে বাতাসের উচ্চচাপ সৃষ্টি হয়।
যাহোক, সারকথা হলো
উষ্ণ বায়ু নিম্নচাপ সৃষ্টি করে এবং ভারী ও ঠান্ডা বায়ু উচ্চচাপ সৃষ্টি করে।
এখন, যে অঞ্চলে বায়ুর নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় বা যে অঞ্চলের বায়ু তাপের ফলে বেশি হালকা ও প্রসারিত হয়ে ওপরে উঠে যায় সে অঞ্চলে কিন্তু বায়ুশূন্য অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। সে শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য উচ্চচাপ অঞ্চলের বেশি ঘনত্বের ভারী ও ঠান্ডা বাতাস সে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ফলে আমরা বায়ুর প্রবাহ দেখতে পাই যা মাঝেমাঝে ভয়ংকর আকার ধারণ করে কালবোশেখির সৃষ্টি করেও থাকে।
চলুন এখন ঘূর্ণিঝড়ের আলোচনায় সরাসরি প্রবেশ করি। ওপরে যা যা আলোচনা করলাম তা না জানলে ঘূর্ণিঝড়ের ম্যাকানিজম বুঝতে পারা কঠিন হতো।
৪।
বিভিন্ন নাম :
সাইক্লোন, হারিকেন ও টাইফুন
শুনতে তিনটি পৃথক ঝড়ের নাম মনে হলেও আসলে এগুলো অঞ্চলভেদে ঘূর্ণিঝড়েরই ভিন্ন ভিন্ন নাম।
আসলে এই সবগুলো একই জিনিস। চীন সাগরে চীন ও জাপানের আশেপাশে এটি টাইফুন নামে পরিচিত।
পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আমেরিকার কাছাকাছি অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের এলাকায় এটি হারিকেন নামে পরিচিত এবং বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর এলাকায় এটি সাইক্লোন নামে পরিচিত।
অ্যাটলান্টিক মহাসাগর এলাকা তথা আমেরিকার আশেপাশে ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ যখন ঘণ্টায় ১১৭ বা মতান্তরে ১১৮ কি.মি.-এর বেশি হয়, তখন জনগণকে এর ভয়াবহতা বোঝাতে হারিকেন শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মায়া দেবতা হুরাকান- যাকে বলা হতো ঝড়ের দেবতা, তার নাম থেকেই হারিকেন শব্দটি এসেছে। আর প্রশান্ত মহাসাগর এলাকা তথা চীন, জাপানের আশেপাশে হারিকেন-এর পরিবর্তে টাইফুন শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যা ধারণা করা হয় চীনা শব্দ টাই-ফেং থেকে এসেছে, যার অর্থ প্রচণ্ড বাতাস। অনেকে অবশ্য মনে করেন ফার্সি বা আরবি শব্দ তুফান থেকেও টাইফুন শব্দটি আসতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় :
ঘূর্ণিঝড় হলো ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি,
বজ্র ও প্রচণ্ড ঘূর্ণিবাতাস সম্বলিত আবহাওয়ার একটি নিম্নচাপ প্রক্রিয়া যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে।
মেরু অঞ্চলের দিকে কেন ?
কারণ, মেরু অঞ্চল তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা অঞ্চল। এ কারণে তাপ গতিবিদ্যার নিয়ম মেনে বাতাস অধিক গরমের স্থান (ক্রান্তীয় অঞ্চল) থেকে তুলনামূলকভাবে শীতল স্থানের (মেরু অঞ্চল) দিকেই যাবে।
এই ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণন উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে (Anti/Counter Clockwise) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে (Clockwise)
(বিস্তারিত আসছে)
চিত্রে দেখুন ক্লকওয়াইজ এবং অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘূর্ণিঝড়
ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানলে যদিও দুর্যোগের সৃষ্টি হয়, কিন্তু এটি আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যা পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে। অধিকাংশই ঘূর্ণিঝড় সমুদ্রে মিলিয়ে যায়, কিন্তু যে অল্প সংখ্যক উপকূলে আঘাত হানে তা অনেক সময় ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রকারভেদ :
উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে ঘূর্ণিঝড়/ঘূর্ণিবাত দুই প্রকার।
1) ক্রান্তীয় বা উষ্ণমণ্ডলীয় ঘূর্ণিবাত
2) নাতিশীতোষমণ্ডলীয় বা মধ্য অক্ষাংশীয় ঘূর্ণিবাত
ক) ক্রান্তীয় বা উষ্ণমণ্ডলীয় ঘূর্ণিবাত।
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় কে নিয়ে। সিংহভাগ ঘূর্ণিঝড় এখানেই ঘটে।
৫।
কীভাবে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় ?
গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপে স্থলভাগের বাতাস গরম হয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়।
তাহলে সমুদ্র কি সূর্যের তাপের কোনো প্রভাব নেই ? সমুদ্রে কি গ্রীষ্মকাল নেই ?
আছে। তবে সমুদ্রে তার প্রভাব স্থলভাগের চেয়ে কম। কেন কম ?
সেখানে কি লম্বভাবে সূর্যের আলো পড়ে না ? হ্যাঁ, সমুদ্রেও সূর্যের আলো পড়ে। সেখানকার বায়ুমণ্ডলও গরম হয়। তবে স্থলভাগের তুলনায় খুব অল্প।
কেন ?
সমুদ্র আর স্থল তো একই জিনিস না। স্থলে আছে সাধারণত মাটি, আর সমুদ্রে আছে পানি। সারা পৃথিবীর স্থলের আয়তনের তুলনায় প্রায় তিন গুণ পানি আছে সমুদ্রে। আর সেই পানির রয়েছে তাপকে ধরে রাখার ক্ষমতা। পানি বেশ ভালোই তাপ ধরে রাখতে পারে যা পানির মাঝে সুপ্ততাপ হিসেবে জমা থাকে। স্থলের চেয়ে পানি তুলনামূলকভাবে বেশি তাপ ধারণ করতে পারে। তাপ ধরে রাখার ক্ষমতার কারণে সে পানির তাপমাত্রা বাড়াতে সময় লাগে স্থলের চেয়ে বেশি।
আর তেমনই উত্তপ্ত পানিকে ঠান্ডা করতেও বা তাপ বর্জন করাতেও সময় লাগে বেশি।
এক কেজি পানিকে তাপ দিয়ে তাপমাত্রা যে পরিমাণ বাড়ানো যায়, ঠিক একই পরিমাণ তাপ লোহার ওপর দিলে লোহার তাপমাত্রা পানির তুলনায় অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে।
তার মানে, পানির নিজের বেশ ভালোই তাপধারণ ক্ষমতা আছে। খেয়াল করেন, পানিকে প্রদত্ত তাপ পানি নিজের মাঝে জমা রেখেই পানি তার বাহ্যিক তাপমাত্রা তেমন বৃদ্ধি হতে দিচ্ছে না। আর পানির নিজের মাঝে সে জমানো তাপই পানির সুুপ্ততাপ/লীনতাপ (Latent Heat) হিসেবে জমা হচ্ছে।
পানিতে যদি তাপ প্রদান করা হয় তবে সে পানি তাপ গ্রহণ করে বাষ্প হতে পারে। বাষ্পের ভেতর তাপ জমা হলো। আবার বাষ্পকে যদি উলটা বা ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় পানির ফোঁটায় (যেমন : মেঘের কণা) পরিণত করা যায়, তবে সে জলীয়বাষ্প প্রকৃতিতে তার আগের গৃহীত তাপ নিঃসরণ করে দিতে জানে। মানে জলীয়বাষ্প পানিতে পরিণত হওয়ার সময় তাপ ছেড়ে দিতে পারে। (আগে গ্রহণ করেছিল, উলটা প্রক্রিয়ায় ছেড়ে দেয়)
এসব জেনে রাখুন। আলোচনা আসছে।
> পানি>জলীয়বাষ্প(বাষ্পীভবন) =
তাপ গ্রহণ (সুপ্ততাপ হিসেবে জমা)
> জলীয়বাষ্প>পানি (ঘনীভবন) =
তাপ বর্জন (সুপ্ততাপ বর্জন)
পানির আরও একটা বিরাট গুণ আছে। একশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি বাষ্পীভূত হয়, আবার একশ ডিগ্রি সেলসিয়াসেই পানি তরল অবস্থায় থাকে (নবম শ্রেণীর রসায়ন বইয়ের ১ম অধ্যায়ের তাপীয় বক্ররেখাটা দেখুন)।
নবম শ্রেণির পদার্থ বইয়ের পদার্থের অবস্থা অধ্যায়টা দেখুন, আরও ক্লিয়ার হবে।
এই একশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানি বাষ্পে পরিণত হওয়ার সময় প্রচুর তাপ শোষণ করে নেয়। শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের পানি একশ ডিগ্রিতে পৌঁছাতে যে পরিমাণ তাপ শুষে নেয়, একশ ডিগ্রির পানি থেকে ১০০ ডিগ্রির বাষ্পে পরিণত হতে তাপ শুষে নেয় তার থেকে পাঁচ গুণেরও বেশি। পানির আরও একটি গুণ হলো তার নড়াচড়া করার ক্ষমতা। সূর্যের তাপে সমুদ্রের উপরিভাগের পানি যখন গরম হয়ে যায়, তখন সে পানি নড়েচড়ে গিয়ে নিচের দিকে বা আশপাশের পানির মাঝে তাপ ছড়িয়ে দিতে পারে। বিশাল ও গভীর সমুদ্রের ব্যাপক পানির তাপধারণ ক্ষমতা কত বিশাল একটি সংখ্যা তা তো বুঝতেই পারেন।
অপরদিকে স্থল বা ডাঙা তুলনামূলকভাবে নড়াচড়া করতে পারে না, তাই তাপও তেমন ছড়িয়ে দিতে পারে না।
দেখা যায় পানি তাপ ধরে রাখে প্রচুর কিন্তু সামগ্রিকভাবে পানির তাপমাত্রা বাড়ে সামান্য। আর স্থলভাগের তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা কম, তাই তাপমাত্রা সহজেই বেড়ে যায়।
ভাত রান্না করার সময় ভাতের হাঁড়ি থেকে গরম বাষ্প যেমন ওপরে উঠে যায়, তেমনই স্থলভাগের গরম বায়ুও উঠে যায় ওপরে। গরম বায়ু ওপরে উঠে যাওয়ায় সে এলাকায় পরিবেশের তাপমাত্রার পরিবর্তন হয় এবং বাতাস তাপে প্রসারিত হয়ে হালকা ও ঘনত্ব কমে যাওয়ায় সৃষ্টি হয় পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে বায়ুচাপের পার্থক্য। গরম বায়ু এলাকায় বা স্থলের দিকে নিম্নচাপ এবং আশেপাশের বা সমুদ্রের দিকে তুলনামূলকভাবে কম গরম এলাকায় উচ্চচাপ বিরাজ করে। এই পার্থক্য মেটাতে সমুদ্র থেকে স্থলের দিকে ছুটে আসে ভারী, ঘন ও ঠান্ডা বায়ু। সাথে নিয়ে আসে বৃষ্টি। এটা হলো সাধারণ ঝড়।
আবার বিশেষ কন্ডিশন সৃষ্টি হলে উলটাটাও ঘটে। উলটা অবস্থাতেই (স্থল থেকে সমুদ্রে বায়ু ছুটে আসা) সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড়।
৬।
সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় কীভাবে ?
সমুদ্রে কোনো স্থানে বায়ুর তাপ বৃদ্ধি পেলে সেখানকার বায়ু প্রসারিত, ঘনত্ব কমে হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায়। কেন ওপরে উঠে যায় তা আগেই জানিয়েছি। ফলে বায়ুর চাপ ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। একে সমুদ্রের নিম্নচাপ বলে। এই নিম্নচাপ অঞ্চলে প্রায় বায়ুশূন্য অবস্থা থাকে বলে আশপাশের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে বায়ু প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে নিম্নচাপ সমুদ্রের কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসে। একে নিম্নচাপ কেন্দ্রমুখী প্রবল ঘূর্ণি বলে। সমুদ্রের উষ্ণ পানির কারণে বায়ু হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে এসব ঝড়ের তৈরি করে। তখন তুলনামূলকভাবে উষ্ণ বাতাস হালকা হয়ে যাওয়ার কারণে ওপরে উঠে যায়, আর সমুদ্রের ওপরের থাকা এবং উচ্চচাপের অঞ্চল থেকে আসা ঠান্ডা, ভারী বাতাস সমুদ্রের সে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে চলে আসতে থাকে।
কী কী শর্ত লাগে ?
১। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৬-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা আবশ্যক।
২। একটি নির্দিষ্ট গভীরতা (কমপক্ষে ৫০ মিটার) পর্যন্ত এ তাপমাত্রা থাকতে হয়। সাধারণত কর্কট ও মকর ক্রান্তিরেখার কাছাকাছি অঞ্চলের সমুদ্রগুলোতে গ্রীষ্মকালে বা গ্রীষ্মের শেষে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। অন্য কোথাও অতটা হয় না বললেই চলে।
৩। সমুদ্রের নিম্নচাপ অঞ্চলে আগত বাতাস কিন্তু চার দিক থেকে আসবে।
i) উত্তর দিকের উচ্চচাপ অঞ্চল
ii) দক্ষিণ দিকের উচ্চাচাপ অঞ্চল
iii) সমুদ্রের উপরিস্তরের উচ্চচাপ বায়ুস্তর অঞ্চল।
iv) আশেপাশের উচ্চচাপ অঞ্চল।
এখন, বাতাসের তিনটা স্তর কল্পনা করি।
১.সবার নিচে ভারী বাতাস
২. তুলনামূলকভাবে হালকা উত্তপ্ত বাতাস (মাঝামাঝি পজিশনে)
৩. তার ওপরে উঠে যাওয়া আরও হালকা, উত্তপ্ত বাতাস (সবার ওপরে/উচ্চতর পজিশনে)।
এখন,
1.
তিন দিক থেকে ছুটে আসা এই উচ্চচাপ অঞ্চলের বাতাস একত্রিত হয়ে সমুদ্রের গরম পানির ওপরের বাতাসকে (মাঝামাঝি পজিশনের বাতাসকে) ঠেলে দেয় আরও ওপরের দিকে।
2.
তখন তাদের (মাঝামাঝি পজিশনের বাতাসকে) জায়গা করে দিতেই (মানে নিচের স্তরের বাতাসের ধাক্কা খেয়ে ওপরে উঠা বাতাসকে জায়গা দিতে) ওপরে উঠতে থাকা বাতাসের ধাক্কায় আগেই আরও ওপরে উঠে আছে যে বাতাস, তা ছুটে যায় নিচের দুই দিকে।
(কেন নিচের দুইদিকে যায় তার আলোচনা আসছে)
৭।
কেন নিচের দুইদিকে বাতাস নেমে যায় ?
উচ্চতর পজিশনে থাকা বাতাস ওপরে উঠে ঠান্ডা, ভারী হয়ে যায়। মানে উচ্চচাপ সৃষ্টি করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ফলে সমুদ্রের ওপরের স্তরে বা তিন নাম্বার উচ্চতর পজিশনে উচ্চচাপ সৃষ্টি হয় এবং নিচের উত্তপ্ত সমুদ্রের ফলে বায়ুশূন্য হয়ে খালি হওয়া শূন্যস্থান পূর্ণ করতে বা তাপের ভারসাম্য রক্ষার্থে সে উচ্চতর পজিশনের বাতাসই আবার উচ্চতর পজিশনের সেই উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নিচের উষ্ণ, নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে নেমে আসে।
3.
আবার নিচে নেমে আবার সমুদ্রের উষ্ণতায় উষ্ণ ও হালকা হয়ে আবার ওপরে উঠে যায়, আবার… এভাবে এ চক্র চলতেই থাকে।
ভাতের মাড় যেমন নিচের গরম পানির ধাক্কায় একবার ওপরে উঠে আবার হালকা ঠান্ডা হয়ে পাতিলের চতুর্পাশ দিয়ে নিচে নেমে যায় তেমন আর কি।
5. সমুদ্র নতুন করে উষ্ণ হওয়া :
ক)
সূর্যের তাপে বাতাস হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায় এবং সাথে সাথে পানি উত্তাপে জলীয়বাষ্প হয়ে ওপরে উঠতে থাকে।
খ)
জলীয়বাষ্প গরম ও হালকা বাতাসের সাথে মিশে।
গরম, হালকা বাতাস জলীয়বাষ্প ধারণ করে বা জলীয়বাষ্পের সাথে মিশে স্যাঁতসেঁতে বাতাসে পরিণত হয়।
গ)
সে স্যাঁতসেঁতে জলীয়বাষ্পযুক্ত বাতাস হালকা হওয়ায় ওপরে উঠে ওপরের শীতল বায়ুর সংস্পর্শে আসে এবং শীতলতার কারণে সে জলীয়বাষ্প যুক্ত হালকা বাতাস ঘনীভূত হয়।
ঘ)
আর সে জলীয়বাষ্পযুক্ত বাতাসই পরে দীর্ঘ অঞ্চলব্যাপী ভয়ংকর কালো মেঘে রূপ নেয়।
ঙ)
ওপরে উঠা গরম বাতাস ঘনীভূত হওয়ার সময় মানে জলীয় বাষ্প থেকে পানিতে পরিণত হওয়ার সময় বাষ্প তার সুপ্ততাপ প্রকৃতিতে বর্জন করে। সে সুুপ্ততাপ তাপগতিবিদ্যার নিয়মে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে।
ছড়িয়ে পড়ার ফলে সমুদ্রের ওপরের স্তরটা বাষ্প থেকে ক্রমাগত বর্জিত নতুন মাত্রায় নতুন তাপ পাওয়ায় সেখানের সমুদ্র আরও বেশি উত্তপ্ত হয়ে যাবে।
সমুদ্র নতুন মাত্রায় উত্তপ্ত হলো।
চ)
অন্যদিকে, আশেপাশের উচ্চচাপ অঞ্চল এবং সমুদ্রের ওপরের দিক থেকে তখনো ঠান্ডা, ভারী বাতাস নিচের দিকে প্রবাহিত হতে থাকবে। কারণ ওপরের দিকে উচ্চচাপ অঞ্চল আর নিচের দিকে নিম্নচাপ অঞ্চল। আর বাতাস উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে সর্বদা নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়।
ছ)
খেয়াল করেন, বর্জিত তাপ পেয়ে সমুদ্র নতুন করে আগের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত হলো।
তাপের কারণে সমুদ্রে আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় নিম্নচাপ সৃষ্টি হলো। সমুদ্রে তাপের আধিক্যের কারণে বাতাস হালকা হয়ে, প্রসারিত হয়ে, ঘনত্ব কমে গিয়ে আরও বেশি নিম্নচাপ সৃষ্টি করবে।
ফলে নিচের স্তরের গরম বাতাস সমুদ্রের ওপরের স্তরে আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় দ্রুততর উঠবে। ফলে নিচের দিকে আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় এবং পূর্বের চেয়ে দ্রুততর সময়ে বায়ুশূন্য স্থান সৃষ্টি হতে শুরু করবে। আর আশেপাশের উচ্চচাপ অঞ্চলের বাতাস পূর্বের চেয়ে অধিক দ্রুত গতিতে সে নিম্নচাপ অঞ্চলে আসতে থাকবে। যত বেশি নিম্নচাপ সৃষ্টি হবে তত বেশি বেগে সেখানে মানে নিম্নচাপ অঞ্চলে বাতাস আসতে থাকবে।
মানে সমুদ্রের সে নিম্নচাপ অঞ্চলে বা বায়ুশূন্য স্থান হতে যাওয়া স্থানে আগের চেয়ে দ্রুত বেগে ও বেশি মাত্রায় ভারী, ঠান্ডা উচ্চচাপ অঞ্চলের বাতাস এবং সমুদ্রের ওপর থেকে আগত উচ্চচাপ অঞ্চলের বাতাস নিম্নচাপ সমুদ্রের জায়গাটায় আসতে থাকবে। সমুদ্র কিন্তু মেঘের জলীয়বাষ্প থেকে বর্জিত নতুন তাপ পেয়ে আগের চেয়েও বেশি উত্তপ্ত। ফলে উচ্চচাপ অঞ্চল, সমুদ্রের ওপর থেকে আসা সেসকল ঠান্ডা, ভারী বাতাস সমুদ্রের নিম্নচাপ অঞ্চলে এসে সেখানের সমুদ্রের পরিবেশের অধিক তাপের কারণে সেসব বাতাস ঠান্ডা থেকে গরম হয়ে যাবে। অর্থাৎ উচ্চচাপ অঞ্চল (স্থল, সমুদ্রের ওপরের বায়ুমণ্ডল) থেকে আগত ঠান্ডা, ভারী বাতাসও উত্তপ্ত হয়ে গেল। আর সে বাতাস উত্তপ্ত হয়ে, প্রসারিত হয়ে, হালকা হয়ে ওপরে উঠে যাবে। সাথে সাথে উত্তপ্ত পরিবেশের কারণে সমুদ্র থেকে পানি বাষ্প হয়ে ওপরে উঠতে থাকবে।
তার মানে, উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে আগত বাতাস সমুদ্রের নিম্নচাপ অঞ্চলে এসে উত্তপ্ত হয়ে সমুদ্রের বাষ্পের সাথে যুক্ত হয়ে ওপরে উঠে যাবে। আর ওপরে উঠে শীতল, ভারী বাতাসের উপস্থিতিতে সে বাষ্পযুক্ত হালকা ও উত্তপ্ত বাতাস ঘনীভূত হয়ে ক্ষুদ্র পানিকণায় পরিণত হবে এবং কালো মেঘে পরিণত হয়ে যাবে। উত্তপ্ত বাষ্প ঘনীভূত হয়ে
পানিকণায় পরিণত হওয়ার সময় সে আগের মতো সুুপ্ততাপ বর্জন করবে এবং সমুদ্রের সেখানকার পরিবেশ আবারও উত্তপ্ত করবে (৩য় বার)। আবার উচ্চচাপ থেকে আসা ভারী, ঠান্ডা বাতাস প্রসারিত, উত্তপ্ত, হালকা হয়ে ওপরে উঠে যাবে, আবার মেঘ তৈরি হবে, আবার… এভাবে চলতেই থাকবে আর উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে বাতাস সেখানের তাপীয় ভারসাম্য রক্ষার্থে আসতেই থাকবে, আর সমুদ্রের ওপরে কালো মেঘ সৃষ্টির পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। আর যত নিম্নচাপ সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাবে ততই উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে বাতাস আসতেই থাকবে। যত বেশি সময় যাবে তত বেশি সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়বে এবং উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে আগত বাতাসের পরিমাণ ও আসার গতিও বাড়তে থাকবে। সে উচ্চচাপ অঞ্চলের বাতাস আবার সে নিম্নচাপ অঞ্চলে এসে হালকা, উত্তপ্ত হয়ে ওপরে উঠে ঘনীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হতে থাকবে+মেঘ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে মেঘের জলীয়বাষ্প কণা থেকে বর্জিত তাপের পরিমাণও বাড়তে থাকবে। ফলে সমুদ্রের সে জায়গাটায় আরও ভয়ংকর নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে থাকবে। এভাবে চক্রাকারে এটা ঘটতেই থাকে।
চিত্রে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি দেখুন।
প্রচণ্ড বায়ুপ্রবাহ, প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প এবং তা থেকে বর্জিত সুপ্ততাপ নিম্নচাপ অঞ্চলের কেন্দ্রের দিকে বয়ে নিয়ে আসে যা ঘূর্ণিঝড়ের প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দেয়। উষ্ণ এ বায়ুই ঘূর্ণিঝড়ের জ্বালানি বলা যেতে পারে।
সাপের মতো কুণ্ডলী পাকানো ঘূর্ণায়মান বাতাস নিম্নচাপ অঞ্চলের কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হলে সেখানে প্রচণ্ড গতিবেগ সৃষ্টি করে।
এতে ঝড়ের ঘূর্ণি আরও বড়ো হতে থাকে। তাছাড়া পূর্বদিক থেকে আসা ঢেউরাজিও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় কিছু ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি হয় বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি।
নিরক্ষরেখার উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিকেই ০-৫ ডিগ্রি পর্যন্ত জায়গায় কোনো ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় না।
যাহোক,
সাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে সে অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণ জলীয়বাষ্পযুক্ত বায়ু ওপরের দিকে উঠে যায়। আর এই শূন্যস্থান পূর্ণ করার জন্য উভয় মেরু অঞ্চল থেকে বাতাস নিরক্ষরেখার দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু পৃথিবীর ঘূর্ণনের প্রভাবে সৃষ্ট কোরিওলিস শক্তির (coriolis force) কারণে এ বায়ু সোজাসুজি প্রবাহিত না হয়ে উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায়। এর ফলে উত্তর গোলার্ধে সৃষ্ট বায়ুপ্রবাহ ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বায়ু ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরতে থাকে। নিরক্ষরেখার ওপর এ শক্তির প্রভাব শূন্য। কাজেই, এ অঞ্চলের তাপমাত্রা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির অনুকূলে থাকলেও নিরক্ষরেখার ০ ডিগ্রি থেকে ৫ ডিগ্রির মধ্যে সাধারণত কোনো ঘূর্ণিঝড় হতে দেখা যায় না।
সাধারণত বিষুবরেখা থেকে ওপরে ৫° উত্তর থেকে ৩০° উত্তর অক্ষাংশ এবং বিষুবরেখা থেকে নিচে ৫° দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে ৩০° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলির উৎপত্তি ঘটে।
৮।
গোলাকার চক্র সৃষ্টি হয় কেন ?
প্রথমেই বলে নিই, আমরা ঘূর্ণিঝড়ের সময় যে চক্রের মতো কিছু ঘুরতে দেখি তা কিন্তু সমুদ্রের ওপরে সৃষ্ট ও জড়ো হওয়া বাতাস ও মেঘের ঘূর্ণন। এদের দাপটে নিচের সমুদ্রের পানিও উত্তাল থাকতে দেখা যায়।
সমুদ্রের দিকে যখন বাতাস ছুটে আসে তখন তা সরাসরি সরল রেখায় আসে না। পাক খেয়ে খেয়ে অগ্রসর হয়।
ওপরেই বলেছি পৃথিবীর ঘূর্ণনের প্রভাবে সৃষ্ট কোরিওলিস বলের (coriolis force) কারণে এ বায়ু সোজাসুজি প্রবাহিত না হয়ে উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে বা বাম থেকে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে বা বাম দিকে বেঁকে যায়। এর ফলে উত্তর গোলার্ধে সৃষ্ট বায়ুপ্রবাহ ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বায়ু ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরতে থাকে এবং ওভাবে ঘুরতে ঘুরতে বাতাস অগ্রসর হতে থাকে এবং সমুদ্রের ওপরে সৃষ্ট মেঘও সে গতির প্রভাব দেখা যায়।
আসলে পৃথিবী যদি স্থির থাকত, নিজের অক্ষের ওপর না ঘুরত তবে বাতাসটা ঠিক ঠিক উত্তর দিক থেকেই আসত। দক্ষিণের বাতাসও আসত দক্ষিণ দিক থেকেই। কিন্তু পৃথিবী প্রতিনিয়ত তার অক্ষের ওপর ঘুরছে। পৃথিবীর এই ঘূর্ণনবেগ বাতাসের বেগকেও প্রভাবিত করে। সে জন্যই উত্তরের আর দক্ষিণের বাতাস সামান্য বাঁকা হয়ে আসে। উত্তরের হাওয়া আসে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে, আর দক্ষিণেরটা আসে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে কেন এমনটা হয় সেটাও বেশ জানার মতো জিনিস। বলছি ওয়েট, এটা না বুঝলে কিছুই বোঝা হলো না।
কোরিওলিস ইফেক্ট :
উনবিংশ শতকের ফরাসি গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী গুস্তাভ-গাসপার্ড ডি কোরিওলিস (Gustave-Gaspard De Coriolis, 1792-1843) সর্বপ্রথম ঘূর্ণন সাপেক্ষে গতিশীল বস্তুর দিক বিক্ষেপকারী এই প্রকার বলের বিষয়ে আলোকপাত করেন বলে তাঁর নামানুসারে এই বলের নাম কোরিওলিস বল রাখা হয়েছে ।
পৃথিবীর আবর্তনজনিত ঘূর্ণনের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠস্থ যে-কোনো স্বচ্ছন্দ, গতিশীল বস্তুর ওপর একধরনের বল কাজ করে, যা উক্ত বস্তুর দিক বিক্ষেপ ঘটায়। এই বলকে কোরিওলিস বল (Coriolis Force) বলে ।
কোরিওলিস বল ও তার প্রভাব :
আমরা জানি, পৃথিবী পশ্চিম-পূর্বে ঘূর্ণনশীল। তবে আপনার মনে একটি চিন্তা কৌতহলবশত জাগতে পারে যে, কাল্পনিকভাবে একটি বল যদি ক্ষিপ্রগতিতে উত্তর দক্ষিণ মুখে নির্দিষ্ট বিশাল দূরত্বে ছোড়া হয় তাহলে তো তা সঠিক স্থানে না পড়ে ডানে বা বামে পড়বে।
বলটি তো সোজাই গিয়েছিল, কিন্ত ঘূর্ণনের কারণে পৃথিবীর যে স্থানে পড়ার কথা সে স্থানটি কিছুটা দূরে সরে গিয়েছে। কিন্তু কেন ?
এর উত্তরটি একটু জটিল। বিষয়টির মূলে রয়েছে কোরিওলিস বল ও তার প্রভাব।
ধারণাটার ব্যাখ্যা :
কোরিওলিস বল বলতে পদার্থবিদ্যায় গতিশীল বস্তুসমূহের আপাত বিচ্যুতিকে বোঝায়। বস্তুসমূহের গতিকে এক্ষেত্রে একটি ঘূর্ণায়মান কাঠামোর সাপেক্ষে বর্ণনা করা হয়। যেমন–কাঠামোটিতে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘূর্ণনে বস্তুর গতিবিক্ষেপ বাম দিকে এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘূর্ণনে ডান দিকে বিচ্যুতি ঘটে। বিজ্ঞানী কোরিওলিস এই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে সর্বপ্রথম ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট গতিশীল বস্তুর গতিবিক্ষেপ সংক্রান্ত ধারণাটি গাণিতিকভাবে প্রকাশ করেন, যা বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই আবহবিদ্যায় পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাপেক্ষে গতিশীল বস্তুর গতিবিক্ষেপ সংক্রান্ত আলোচনার ভিত্তি হিসাবে কোরিওলিস বল নামে ব্যবহৃত হতে থাকে।
ব্যাখ্যা :
কোরিওলিস বল পৃথিবীর ঘূর্ণন ও বস্তুর জড়তার কারণে ক্রিয়াশীল হয়। সমগ্র পৃথিবীর ওপর কোরিওলিস বলের প্রভাব খুব সামান্যই অনুভূত হলেও গতিশীল বস্তু তথা–বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রস্রোত প্রভৃতির গতিবিক্ষেপের ক্ষেত্রে এই বলের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই অনুভূমিক বিক্ষেপ নিরক্ষরেখায় সর্বনিম্ন এবং মেরুদ্বয়ের নিকট সর্বোচ্চ হয়। মানে এই বলের প্রভাবের পরিমাণ পৃথিবীর সর্বত্র সমান নয়, বিভিন্ন অক্ষাংশে এর মান বিভিন্ন মাত্রার। যথা–নিরক্ষীয় অঞ্চলে তথা ০° অক্ষাংশে ০%, ৩০° – ৫০° অক্ষাংশে ৫০%, ৬০° – ৮০° অক্ষাংশে ৮৫% – ৯০% এবং মেরু অঞ্চলে তথা ৯০° অক্ষাংশে ১০০% ।
এ বলের প্রভাবে বিষুবরেখা হতে উত্তর মেরু পর্যন্ত প্রশস্ত উত্তর গোলার্ধে বস্তুসমূহের গতির দিকের সাথে ডান দিকে (anti clockwise) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে (clockwise) বিচ্যুতি ঘটে।
সমুদ্রস্রোত এবং বায়ুপ্রবাহ এ নিয়ম মেনে চলে। সেই কারণে বড়ো বড়ো সাইক্লোন, হারিকেন, টাইফুন, টর্নেডোর জন্য এই বল দায়ী।
বিষয়টি ভালো করে বোঝার জন্য নিচের আলোচনাটা লক্ষ করতে হবে।
৯।
উত্তর গোলার্ধে কোরিওলিস প্রভাব-১ :
নিচে A থেকে ওপরের জায়গাটুকু উত্তর গোলার্ধ ধরা যাক।
কল্পনা করা যাক, কদ্দুস উত্তর গোলার্ধে বিষুবরেখার কাছাকাছি মেক্সিকো উপকূলে A বিন্দুতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে একটি ক্রিকেট বল সোজা উত্তর মেরুর নিকটবর্তী তার বান্ধবী জরিনার নিকট, কানাডা বরাবর B বিন্দুতে পাঠাল।
জানা আছে, পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘোরে। কিন্ত সব প্রান্ত, পৃথিবীর সকল বিন্দু সমান গতিতে ঘূর্ণন সম্পন্ন করে না। উত্তর দক্ষিণ মেরু প্রান্ত কিছুটা চাপা। তাই এই দুই অক্ষের ব্যাস সবচেয়ে কম। পক্ষান্তরে বিষুবরেখায় ব্যাস সবচেয়ে বেশি। বিষুবরেখা থেকে যত উত্তর বা দক্ষিণ দিকে যাওয়া যায় অক্ষাংশের ব্যাস তত কমতে থাকে।
তাই, একটি নির্দিষ্ট সময়ে উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর কোনো অঞ্চল যে গতিতে ঘুরবে বিষুবরেখায় তার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে ঘুরে আসবে।
তাহলে, কদ্দুস A বিন্দু থেকে সোজা বল প্রেরণ করল। কিন্ত আগেই বলা হলো, উত্তর গোলার্ধে কোনো গতিশীল বস্তু ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘুরে অগ্রসর হয় বা ডান দিকে বেঁকে অগ্রসর হয়।
ফলে A বিন্দু হতে বলটি B বরাবর যেতে যেতে ডান দিকে অ্যাটলান্টিক মহাসাগর বরাবর বেঁকে যাবে।
(বলটাকে বাতাস হিসেবে মনে করুন।)
উত্তর গোলার্ধে কোরিওলিস প্রভাব-২ :
এখন জরিনা, সে এবার কদ্দুসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। কিন্তু জরিনাও উত্তর গোলার্ধেই আছে।
এখন ধরা যাক, বলটি জরিনা উত্তর মেরু A হতে B বিন্দু (মেক্সিকো) বরাবর প্রেরণ করবে। উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘোরায় বলটি উত্তর মেরু A থেকে B পর্যন্ত পৌঁছাতে গিয়ে বলটি প্রশান্ত মহাসাগর বরাবর আবারও নিজের গতির ডান দিকে বেঁকে যাবে।
কদ্দুসের সাপেক্ষে A থেকে ডান দিকে বেঁকে আসা বলটিকে কদ্দুসের কাছে বাম দিকে বেঁকে বলটি আসছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু আপনি গ্লোবটা উলটা করে জরিনার পজিশনে যান। দেখবেন বলটি জরিনার সাপেক্ষে বলটি ডান দিকেই বেঁকেছে।
সুতরাং, বোঝা গেল উত্তর গোলার্ধে গতিশীল বস্তু সর্বদা তার নিজের গতির ডান দিকে বেঁকে যাবে, মানে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে।
দক্ষিণ গোলার্ধে কোরিওলিস প্রভাব-১ :
এবার তাহলে দক্ষিণ গোলার্ধের কথা বিবেচনা করা যাক। কদ্দুস এবার দক্ষিণ আমেরিকার A বিন্দু থেকে দক্ষিণ মেরুর দিকে তার বান্ধবী জরিনার দিকে B বিন্দুতে বলটি পাঠাবে। দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘূর্ণনের জন্য বলটির বিচ্যুতি বাম দিকে বেঁকে যাবে। প্রথম দিকেই ক্লকওয়াইজ, অ্যান্টিক্লকওয়াইজ বোঝানোর সময় বলেছি বাম দিকে মানে ঘড়ির কাঁটার দিকে।
আপনাকে A বিন্দুতে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে তাকিয়ে দিক বিবেচনা করতে হবে। যখন যেদিক থেকে ছুড়বেন সেদিক থেকে চিন্তা করতে হবে বলটি কোন দিকে গেল। গ্লোব উলটা করে A বিন্দুতে দাঁড়িয়ে দেখুন, দেখতে পারবেন বলটি বাম দিকেই বেঁকে যাচ্ছে।
দক্ষিন গোলার্ধের কোরিওলিস প্রভাব-২ :
এবার, দক্ষিণ মেরু হতে জরিনা কদ্দুসকে A হতে B বিন্দু বরাবর বলটি ছুড়ে মারে। এবার বলটি প্রশান্ত মহাসাগরের দিক বরাবর কিছুটা বাম দিকে বেঁকে যায়। মানে ঘড়ির কাঁটার দিকে বিচ্যুতি।
কারণ, ঘূর্ণনটি ঘড়ির কাঁটার দিকে সম্পন্ন হয় এবং মেরুর ব্যাসের চেয়ে B বিন্দুর ব্যাস অনেক বেশী হওয়ায় তা দ্রুত ঘুরে। ফলে বলটি বামে সরে যায়। বলটি সরাসরি সরলরেখায় B বিন্দুতে পৌঁছানোর আগেই B বিন্দু সামনে সরে যায় এবং B বিন্দুর পেছনের অংশ B বিন্দুতে এসে যায়। ফলে বলটি B বিন্দুতে না গিয়ে নতুন বিন্দুতে যায়, যাকে বেঁকে যাওয়া বলে মনে হয়।
এভাবে ওপরের সবগুলোই।
অতএব, বোঝা গেল দক্ষিণ গোলার্ধে গতিশীল বস্ত নিজের গতির বাম দিকে বিচ্যুত হয়।
সারমর্ম :
ওপরের আলোচনা ও পরীক্ষা দ্বারা বোঝা গেল কোনো গতিশীল বস্ত কোরিওলিস বলের প্রভাবে উত্তর গোলার্ধে নিজের গতির ডান এবং দক্ষিণ গোলার্ধে নিজের গতির বাম দিকে বেঁকে যায় বা বিচ্যুত হয়।
১০।
ঘূর্ণিঝড়ের গঠন :
সাইক্লোনের চোখ :
ঘূর্ণিঝড়ের চোখ বলতে কী বোঝায় ?
চোখ কিভাবে তৈরি হয় এবং বজায় থাকে ?
আই ওয়াল (eye wall) কি ?
ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে অবস্থিত গোলাকৃতি অঞ্চলকে ঘূর্ণিঝড়ের চোখ (eye) বলা হয়। অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রকে ঘূর্ণিঝড়ের চোখ বলে। ঘূর্ণিঝড়ের একদম কেন্দ্রে অর্থাৎ চোখের অঞ্চলে সবচেয়ে কম বায়ুচাপ থাকে।
এখানে বাতাস সর্বাধিক উষ্ণ থাকে। এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও বাতাসের গতি থাকে মাত্র ২০-২৫ কিলোমিটার/ঘণ্টার ভেতরে।
ঘূর্ণিঝড় যেখানে উৎপত্তি হয় সেখানে ১০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ব্যাসার্ধে তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে এবং বায়ুর গতিবেগ খুব কম থাকে। সেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম থাকে। এ চোখের বাইরে ১৫০ থেকে ৭৫০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় বিস্তৃত হতে পারে এবং সেখানেই ঘন কালো মেঘের বিস্তার ও প্রবল বায়ুপ্রবাহসহ বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়াগত গোলযোগ সংঘটিত হয়। দুই দিক থেকে আগত বাতাস বেঁকে এসে নিম্নচাপ অঞ্চলে কেন্দ্রে ফাঁকা স্থান এবং চক্র সৃষ্টি করে।
এ চোখকে কেন্দ্র করেই ঘূর্ণিঝড় ঘুরতে থাকে। এটি নিম্নচাপ অঞ্চল বিধায় আশপাশের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে বাতাস বেঁকে বেঁকে এই কেন্দ্রের চোখের দিকেই ধাবিত হয়।
কোরিওলিস বলের প্রভাব চারপাশের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে আগত বাতাস পাক খেয়ে খেয়ে অগ্রসর হওয়ায়, চোখের চারপাশে (দেওয়ালে) চক্র তৈরি করে ফেলে বিধায় চোখ অঞ্চল বাতাসের/ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবমুক্ত রয়ে যায় এবং এর ফলে চোখের ওখানে বাতাস শান্ত থাকে।
ঘূর্ণিঝড়ের চোখ অঞ্চল যত উষ্ণ থাকে, ঝড় তত বেশি শক্তিশালী হয়। কারণ যত বেশি উষ্ণ হবে তত বেশি উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে বাতাস আসতে থাকবে এবং ঘূর্ণির পরিমাণ বাড়াতে থাকবে। এর ওপরে মেঘ থাকে না বললেই চলে।
Eye wall :
ঘূর্ণিঝড়ের চোখের চারপাশের অংশকে Eye wall বলে।
চোখটির বৃত্তাকার পরিসীমার বাইরে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় যাকে চোখ-দেওয়াল বলা হয়, সেখানে বাতাসের বেগ এবং বৃষ্টিপাত সবচেয়ে বেশি।
চোখের এর চারপাশের অংশে শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ বিরাজমান থাকে এবং ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক অংশ হলো এটা (দেওয়াল)। এই অংশে বাতাস খুব শক্তিশালী হয়, যার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে।
চোখের বাইরে যে ঝড়ো দেওয়াল তৈরি হয় তাতে ঝড়ের ক্ষমতা অনুসারে বাতাসের গতি ২৫০-৩০০ কিলোমিটার/ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। এই বাতাসের সাথে থাকে অবিরাম প্রচুর বৃষ্টিপাত। একই সাথে সমুদ্র থেকে উত্থিত দেওয়াল সদৃশ জলোচ্ছ্বাস। এই জলোচ্ছ্বাস ঝড়ের ক্ষমতা অনুসারে প্রায় ১৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। সমুদ্রের জোয়ারের সময় জলোচ্ছ্বাস হলে, তা ভয়ংকর রূপ লাভ করে।
উপগ্রহ চিত্রগুলিতে এ চোখের গঠন বা আকৃতি আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
স্পাইরাল ব্যান্ড/রেইন ব্যান্ড :
মেঘের দেওয়ালকে ঘিরে থাকে দুটি স্পাইরাল ব্যান্ড। মেঘের দেওয়ালের চারদিকে দুটি স্পাইরাল ব্যান্ড থাকে যাকে উপগ্রহ থেকে দেখলে ছোটোখাটো গ্যালাক্সি মনে হয়। এটি বেশ কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ হতে পারে। এই অঞ্চলের প্রভাব স্থলভাগে যেখানে পড়ে সেখানে বৃষ্টিপাত ঘটায় সেই কারণে এটির আরেক নাম রেইন ব্যান্ড।
চোখ-দেওয়ালের বাইরের সীমানা থেকে বাতাসের বেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ঘূর্ণিঝড়গুলি প্রায়শই কেন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে একটি লম্বা লেজের মতো অঞ্চল নিয়ে আবর্তিত হয় এবং এ প্রলম্বিত অংশে একাধিক বলয় থাকে। সমগ্র বিষয়টি একটি সর্পিলাকার কাঠামো তৈরি করে যা অনেকটা ‘উলটানো কমা’ বা ‘উদ্ধরণ চিহ্নের’ মতো। ঘূর্ণিঝড়ের লেজটি কয়েক শত কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের লেজের মতো অংশটি সাধারণত প্রাণকেন্দ্র বা মূল অংশটির পূর্বেই ভূমিকে অতিক্রম করে যার ফলে ঝড়ের পূর্বে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় এবং ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার শুরুতে প্রায়শই বৃষ্টিপাত ঘটে। এ ধরনের লক্ষণ সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত হতে পারে।
চিত্রে দেখুন
বহিঃসীমা অঞ্চল :
এটি ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বাইরের অঞ্চল। যখন কোনো ঘূর্ণিঝড় স্থলভাগে প্রবেশ করে তখন সবার প্রথম এই অঞ্চলের প্রভাব পরে। এটিকে ঘূর্ণিঝড়ের সীমানাও বলা যায়।
ঘূর্ণিঝড়ের স্থলভাগে আঘাত করা বা আছড়ে পড়া বলতে কী বোঝায় ?
ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে ল্যান্ডফল (landfall) বা স্থলভূমিতে আছড়ে পড়া বলতে বোঝায় যে, ঘূর্ণিঝড়ের সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে স্থলভূমিতে প্রবেশ বা আঘাত করা। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রস্থল যে তীব্রতার সঙ্গে স্থলভূমিতে প্রবেশ করে তার ওপর নির্ভর করে ঘূর্ণিঝড়টি কোন শ্রেণীর তা নির্ণয় করা হয়। একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে সেটির চোখ (eye) স্থলভাগের ওপর ঘুরতে থাকে। এর ফলে স্থলভাগের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের চোখের চারপাশের অংশ অর্থাৎ eye wall অংশটিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। প্রচুর বৃষ্টিপাত ও ঝড় হয়। তবে স্থলভাগে আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি কমতে থাকে।
সমুদ্র থেকে ছুটে এসে স্থলে আঘাত হানার পর স্থলের কারণে জলীয়বাষ্প সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বা জলীয়বাষ্প সরবরাহ খুব কমে যাওয়ায়, ঘূর্ণিঝড়টি স্থলে এসে সাগরের মতো সুবিধা করতে পারে না। সাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির মূল নিয়ামক সে উষ্ণবায়ু, জলীয়বাষ্প, সাগরের নিম্নচাপ অঞ্চল, এসব স্থলে এসে আর ওভাবে আর না পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড় ক্রমশ দুর্বল হয়ে সমাপ্তির পথে হাঁটে।
তথ্যসূত্র :
1. https://en.wikipedia.org/wiki/Cyclone
3.https://en.m.wikipedia.org/wiki/Tropical_cyclone
4.https://en.m.wikipedia.org/wiki/Coriolis_force
5.
7.https://sobbanglay.com/sob/question-answer-related-to-cyclone/
8. https://www.youtube.com/watch ? time_continue=4&v=WB4dxpUS530
9.https://www.youtube.com/watch ? v=bFp3Q7LivJA
10.
https://en.wikipedia.org/wiki/Beaufort_scale
11.
https://en.wikipedia.org/wiki/Tropical_cyclone_scales
12.
https://en.wikipedia.org/wiki/Template:Tropical_cyclone_classification
13.
https://en.wikipedia.org/wiki/Saffir%E2%80%93Simpson_scale