Ads Area

advertise

শরতে লেখা চিঠি

0

মনিফ শাহ চৌধুরী 



স্নেহাশিস, 

শরৎ-এর সময়টা বড্ড অনিশ্চিত। মানুষের ছাতি লইয়া বাজারে বেরোনোর পূর্বে ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবিতে হয় এই ছাতিখানা তাকে রৌদ্রের প্রতাপ হইতে রক্ষা করিবে নাকি জলের অঝোর আলিঙ্গনে বাধা প্রদান করিবে। বাড়ির মালকিনরা প্রত্যূষের সোনালি আভা দেখিয়াও চিন্তিত থাকেন আজি বিছানার চাদর, জানালার পর্দা ধুয়ে শুকাইতে দিলে আচমকা লাজুক অম্বরী তার মুখের ওপর ঘোমটা টানিয়া দিবেন না তো? এমনই এক অনিশ্চিত সময়ে যখন গদিতে বসিয়া ভাবছিলাম এ বেলা মাথার ওপর ক্যাচর ক্যাচর করে ঘুরতে থাকা শীর্ণ, হীনবল কংকালের চিকিৎসা করাইব নাকি আর দুটো দিন গরমের জ্বালা সইয়ে শীতবাবুকে বরণ করিবার সংকল্প করিব, ঠিক তখনই তোমার পাঠানো একেবারেই অপ্রত্যাশিত ডাক (কুরিয়ার) চলে আসিল। 


বাক্স খুলিয়া আমি যথাযতই আপ্লূত হইয়া ছিলাম। আমি জানি না আমাদের মস্তিষ্কের কোন নিউরণের সমষ্টি একত্রে যোগাযোগ করিয়া তোমায় জানাল আমার এই মূহুর্তে একখান ফ্যানের বড় প্রয়োজনবোধ হচ্ছিল। তুমি যে আমার কথা ভাবিয়া এই টেবিল ফ্যানখানা পাঠাইছ তাতে আমি বেশ আনন্দিত হইয়াছি। 


টেবিল ফ্যান নিয়ে আমার অনেক কৌতুহল ছিল ছেলেবেলায়। হাফপ্যান্ট পড়া বয়সে আমি প্রথম দেখেছিলাম এমন ফ্যান। ছোট, সহজে বহনযোগ্য। ইংরেজ অফিসাররা শিকারে গেলেও তাদের সঙ্গে এই জিনিস রইত। বুনো হাতি আর আদমখোর বাঘের ধাওয়া করে যখন তেনারা ক্লান্ত হইয়া যাইতেন, কোথা থেকে এক ভৃত্য আসিয়া মাথার কাছে এনে রেখে দিত ফ্যান। বনবন করে ঘুরিত, তাদের পিতলরঙা চুল উড়িয়া নিয়ে যাইত। 


অবশ্য, তখন এগুলি বিদ্যুৎ দিয়ে চলিত না। বরং সেগুলি তাপশক্তি ব্যবহার করিত। নিচে ফাকা জায়গায় কোনো মোমবাতি কীংবা কুপি জ্বালিয়া দিলেই হইত। ভেতরে একখান ছোট সিলিন্ডার থাকিত যার ভেতরে একজোড়া পিস্টন থাকিত। সিলিন্ডারের ভেতরে বাতাসও বন্দী করে রাখা হইত। অর্থাৎ, নিচ হইতে তাপের কারণে বাতাস গরম হইয়া ছোটাছুটি বাড়াইয়া দিলে পিস্টন ওপরে উঠিয়া যাইত এবং প্রায় সাথে সাথেই ঠান্ডা হইয়া বাতাসের ছোটাছুটি কমে গেলে পিস্টন আবার নিচে নামিয়া আসিত। পুরো ব্যাপারটা একসেকেন্ডে বহুবার পুনরাবৃত্তি হইত। এর ফলে, ধীরে ধীরে ফ্যানের পাখাগুলির গতি বৃদ্ধি পেয়ে বনবন করে ঘুরিত। এর ভেতরের কলকব্জায় কোনো তাড়িত যন্ত্র ছিল না। এমন ইঞ্জিনকে Stirling Engine বলা হইয়া থাকে। যদিও এর বাতাস খাওয়ার ভাগ্য কোনোদিন হয় নাই, তবু আমার ঘোর সন্দেহ, হাওয়া বড়ই গরম হওয়ার কথা। ইংরেজরা শুধু ভাব দেখাইতেই রৌদ্রপ্রতাপের নিচে চুরুট টানিতে টানিতে এর হাওয়া খাইতেন। 


তাই বলিয়া ভাবিও না তুমি আমাকে যে ফ্যানখানা পাঠাইছো তার ব্যাপারে আমি কিছুবৎ জানি না। সরল সীকারোক্তি হিসেবে বলা যায় টেবিল ফ্যানের যান্ত্রিক প্রকৌশল আমাকে মুগ্ধ করে। তুমি হয়তো ভাবিতেছ নানাজান এক সামান্য ফ্যানকে রীতিমত মাথায় তুলিয়া নাচিতেছে, কিন্তু নিজেকে জিজ্ঞেস কর তো, ফ্যানখানা কী আসলেই সামান্য? কখনও ভাবিয়া দেখেছ কি, ইহার চারখান সুইচের মধ্যে শুধু "শূন্য" সুইচটাতে চাপ দিলেই কেন সেটা আটকে থাকে না? বাকিগুলো কেন আটকে থাকে? অথবা, প্রতিটা সুইচ চাপলে আলাদা গতিতে এর পাখাগুলো কেন ঘুরে? অথবা ভাবিছ কি, ইহার ভেতরের মোটর কীভাবে কাজ করে? বা কেন ঘাড়ের ওপরের সুইচখানা চাপলে ইহার মাথা লাইটহাউজের আলোর মত দুই পার্শ্বে ঘুরিতে থাকে? 


ফ্যানের সবচেয়ে সরল অংশ মনে হয় ইহার সুইচবোর্ড। সাধারণত চারটা সুইচ থাকে। একদম শুরুরটায় চাপলে বন্ধ হইয়া যায়। আমরা যদি একটু নিচে তাকাই, (অবশ্যই ফ্যানের ওপরের কভার খুলিয়া) আমরা দেখিব ইহার সুইচগুলো একটা খাজকাটা মেটালের ওপর রাখা। খাজগুলো মূলত হুকের ন্যায় কাজ করে। সুইচে চাপ দিলে খাজের ঢালু অংশে ঠেলা লাগার কারণে তা ধীরে ধীরে একপাশে সরিয়া যায় আর সুইচের সাথে লাগোয়া বাকা অংশ খাজের নিচে ফাকা জায়গায় আটকে যায়। এখন তুমি ওই সুইচে যতই চাপ দাও তা আর নিচেও নামিবে না, ওপরেও উঠিবে না। 

      কিন্তু, তুমি যদি অন্য কোনো সুইচে এবার চাপ দাও, সেটা এবার ঠেলা দেবে আরেকটা খাজকাটা অংশে। ফলে পুরো মেটালের অংশটি আবার একপাশে সরে যেতে থাকবে, আগের সুইচ মুক্তি পাইবে, এই দ্বিতীয় সুইচ বেচারা আটকে যাইবে। 

      ব্যতিক্রম হইতেছে জিরো সুইচখানা। ইহার নিম্নাংশের মেটাল বডিতে খাজ থাকিলেও হুকের মত কিছু নেই। তাই ইহাতে চাপ দিলে খাজ অংশ ঠেলা খেয়ে সরে গিয়ে অন্য সুইচকে উঠাইয়া দিলেও জিরোকে আটকাইতে পারে না। তোমার বুঝিতে অসুবিধা হইলে একখান ছবি সংযুক্ত করিয়া দিব।


ফ্যানের মূল অংশ হইতেছে এর single phase induction motor। তবে মজার কথা হল, একটা মোটর নিজেই একখানা আলাদা যন্ত্র। মোটর কী করিয়া কাজ করে সেটা তুমি কতদূর জানো আমি সঠিক জানি না, তবে অন্তত এটুক তো জানিয়াই থাকিবে একখান পেচানো তারের মাঝে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হইলে সেথায় চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরী হয় , একপাশে উত্তর অপরপাশে দক্ষিণ মেরু সৃষ্টি হয়। এখন ভাব তো ইহার দুইপাশে যদি দুইটি চৌম্বক রাখা হয় যাহার উত্তর মেরু পেচানো তারের দিকে মুখ করা, তাহা হইলে তারের এক মেরু ঠেলা খাইত আরেক মেরু অন্যদিকে আকর্ষিত হইত না? 

      এই প্যাচানো তার একবার ঠেলা খেয়ে পার্শ্ব পরিবর্তন করার ভেতরেই যদি আমি খুবই দ্রুত তাহার মেরু বদলিয়ে দিই তাহলে কী ঘটবে? সঠিক ভাবিয়াছ, আমার তারটি আবার ধাক্কা খেয়ে ঘুরিয়া পার্শ্ব পরিবর্তন করার চেষ্টা করিবে। এভাবে যদি আমি খুবই দ্রুত মেরুর দিক পরিবর্তন করাইতে পারি আমার পেচানো তার ঘুরিতেই থাকিবে। 

      প্রশ্ন করিতে পারো এই মেরু পরিবর্তন কীভাবে করা হইবে? তাহার আগে কিছু শব্দ পরিবর্তন করিয়া লই। এই যে পেচানো তারের কথা বলিতেছি তখন হইতে, ইহাকে ডাকি armature. ইহা মুলত একখানা মেটাল লুপ। কারেন্টের দিক পরিবর্তন করাও এমন কঠিন কিছু নয়। একখানা গোল খোলা সিলিন্ডারের মত পাত কল্পনা কর যা armature এর দুই তারের অংশে সংযুক্ত। এর মাঝখানে আবার দুটো ফালি করে কাটা রইয়াছে। তুমি যদি মোটর খুলিয়া দেখ তোমার এগুলি দেখে ইংরেজি সি অক্ষরের মত লাগবে। এগুলিকে commutator বলে। ইহার বাইরের অংশের দুপাশে দুটো ব্রাশ থাকিবে। ব্রাশগুলি সংযুক্ত থাকিবে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের সাথে। ব্রাশগুলির মুখ সর্বদাই commutator এর সাথে সংযুক্ত থাকিবে। পুরো ব্যাপারটা কল্পনা করিয়া নাও। দুইধারের চৌম্বক প্রায় গোলাকৃতির, মাঝে তারের লুপ যার দুই প্রান্ত প্রায় গোলাকার সি অক্ষরের পাতের সাথে লাগানো, যা আবার দুইটি ছোট ব্রাশের সাথে লাগানো যেটা সরাসরি সাপ্লাইয়ে লাগানো থাকে। তোমার বোঝার সুবিধার্থে এই চিঠিতে কিছু ছবি সংযুক্ত করিয়া দিব। 


চিঠিখানা লিখিতে লিখিতে খেয়াল হইল, এইবার আমাদের উঠানে তরমুজের ফলন অত্যাধিক ভাল হইয়াছে। ওপরের খোলসটা কচুপাতা সবুজ, ডোরাকাটা, ভেতরটা টকটকে লাল। কদাচিৎ তালু তাতানো গরম পড়িলে বরফকুচি দিয়া তরমুজের শরবত খাইতে যে কী ভালো লাগে! তুমি বেড়াইতে আসিলে অবশ্যই খেয়ে দেখিবে। লাল সবুজের মিশেলে এমন ফল আর আছে কী? 


যখন বিদ্যুৎ প্রভাবিত হয়, আমাদের armature নব্বই ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরিয়া যান, সেই মুহুর্তে ইলেক্ট্রিক আর ম্যাগনেটিক ফিল্ড প্যারালেল হয়ে যাওয়ার কারণে কোনো বল প্রয়োগ হয় না। তবে armature তখনও নিজের মোমেন্টামের জন্য আরো ৯০ ডিগ্রি ঘুরিয়া যায়। ফাকা জায়গায় এসে দুই তারের প্রান্ত আবার ব্রাশের সাথে সংযোগ স্থাপন করে, ফলাফল কারেন্টের প্রবাহ আবার পূর্বের দিকে হইয়া যায় অর্থাৎ, সে আবার ঘুরিতে শুরু করে। এভাবেই মোটর চলিতে থাকে। 

      ইহার শক্তি বাড়ানো যায় শক্তিশালী চুম্বক, অনেক তার, তারের মাঝে বেশি প্যাচ ব্যবহার করিয়া, ভোল্টেজ বাড়াইয়া ইত্যাদি। 


মোটামুটি ফ্যানের ব্যাপারে প্রায় পুরোটা জানিয়া গেলে। তবে এখন বাকি রয় কি করিয়া ফ্যানের মাথা একপাশ থেকে অন্যপাশে ঘোরে সেটা নিয়ে আলোচনা করা। 


4 Bar Mechanism সম্পর্কে তুমি কতটুকু জানো? আমি যেই ছবিখানা সংযুক্ত করিয়া দিব সেখানে চারটি বার বা দন্ড দেখিতে পাইবে। প্রতিটি একে অপরের সাথে সংযুক্ত।  ইহার কিছু সংযোগস্থল বা জয়েন্ট হইতেছে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিতে সক্ষম এবং চারটার মধ্যি তিনটে বার নড়াচড়া করিতে সক্ষম। যেই বারটি নড়িতে পারে না সেটিকে বলে fixed bar. এইটার পাশে যেই বারটি সংযুক্ত থাকে সেটাকে যদি মোটরের সাথে সংযোগ করিয়া দেয়া যায় তবে সেটি ঘুরিতে আরম্ভ করিবে। যেই ছবিখানা দিয়েছি সেটার নীল অংশটি ধরা যাক fixed. আর যদি ধরি হলুদ অংশটি মোটরের সাথে সংযোগ করিয়া দেয়া তাহলে সেটি ঘুরিবে এবং দোল খাইতে শুরু করিবে ডান থেকে বায়ে, বা থেকে ডাইনে। 

      মোটরের সহিত সরাসরি সংযোগ করা হইলে ইহা যে জোরে দোল খাইতে থাকিবে তাতে পুরো ফ্যান ভাঙিয়া মানুষকে আহত করিয়া ফেলতে পারে। তাই অনেকগুলি ক্লকওয়ার্ক গিয়ার এর সাথে সংযুক্ত করিয়া এরপর মোটরের সাথে লাগানো গোল ঘূর্ণিয়মান দন্ডের সহিত লাগানো হয়। ইহাকে worm বলা হয়। আর ইহার সহিত যেই গিয়ার সরাসরি যুক্ত থাকে তাহাকে worm gear বলা হয়। এই ওয়ার্ম গিয়ারের সহিত একখান পিন সংযুক্ত থাকে যা ওয়ার্ম গিয়ারকে নিচে আরেকটি গিয়ারের সহিত সংযুক্ত করে। এই পিন ওপরে টানিলে নিচের গিয়ারের সহিত ওয়ার্ম গিয়ারের কোনোই সংযোগ থাকে না, ফলে ফ্যানের মাথা একমুখী হইয়া থাকে। যেই পিনটা নিচে নামাইয়া দিই, সংযোগ স্থাপন হয়, গিয়ার ঘুরে, বারগুলি ঘোরে অতপর ফ্যানের মাথাও ঘুরিতে থাকে। 



একখানা টেবিল ফ্যানের প্রকৌশল আমি খুবই পছন্দ করি। আশা করি আমি বোঝাইতে পারিয়াছি কেন ফ্যানকে সামান্য মনে করা উচিৎ নয়। আজকাল শুনেছি অনেক অত্যাধুনিক ফ্যান তৈরী হইয়াছে। পাখা ছাড়াও নাকি ফ্যান পাওয়া যাইতেছে? সেটা কীভাবে কাজ করে আমাকে জানাইয়া পত্র লিখিও। তোমার পরিবারকে আমার স্নেহ ও সালাম দিও। আর শীঘ্রই আমার সহিত দেখা করিতে আসিও। শরৎকালের কথা বলেতিছিলাম। এই শরৎ-এর মতই অনিশ্চিত আমার জীবন, বুড়ো শরীরটার ইঞ্জিন যেকোনো দিনেই বন্ধ হইয়া যাইতে পারে। 

ভালো থাকিও।

ইতি, 

তোমার পত্রবন্ধু নানাজান 


পুনশ্চঃ 

মোটরের কাজ ভালোভাবে দেখিতে পারো এখানে- https://sites.google.com/site/physicsacehci/page2 

আর 4 Bar Mechanism দেখিতে পারো এখানে- 

https://www.youtube.com/watch?v=KBFFwgCCP0U&ab_channel=SkylineTutorials


(সমাপ্ত) 

মনিফ শাহ চৌধুরী

ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad

Below Post Ad

advertise