Ads Area

advertise

REVISITING KILOGRAM (2018)

0

লেখক: ওমর খালিদ সোহাগ

কিলোগ্রামের ইতিহাস আর নতুন সংজ্ঞা, সেই সাথে বদলে যাওয়া আরও ৩টি মৌলিক SI এককের গল্প।

কিলোগ্রাম বা ১ কিলোগ্রাম কাকে বলে? বা যে-কোনো এককেরই সংজ্ঞা বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? সহজ একটা স্ট্যান্ডার্ড পরিমাপ যেটাকে ভিত্তি ধরে বাকি সকল পরিমাপ করা হয়। যেমন, ১০ কেজি মানে ১ কেজি বলতে যা বুঝি তার ১০ গুণ। ১০০ মিটার মানে ১ মিটার বলতে একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য আছে তার ১০০ গুণ। তার মানে সব ধরনের হিসাব নিকাশের জন্য আসলে সেই এককের হিসাবটা নির্ভুল এবং স্থির হতে হবে। কিলোগ্রাম এরকমই একটা একক আর এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা একক কারণ অন্যান্য অনেক SI একক এই কিলোগ্রামের ওপরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আবার এই কিলোগ্রামই একমাত্র একক যাকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য আমাদেরকে এক ধাতব সিলিন্ডারের সাহায্য নিতে হয়, যা কিনা আবার নিজেই ১০০% স্থির না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেছেন বছরের পর বছর, আর এতদিন পরে, অবশেষে তারা সফল।  


নভেম্বর ১৬, ২০১৮। প্রায় ৬০ দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিগণ একত্রিত হয়েছেন ফ্রান্সে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে আসার জন্য। এখানে ভোট গ্রহণ করা হয় বহুল ব্যবহৃত এস আই (SI) একক কিলোগ্রামের সংজ্ঞা পাল্টানোর জন্য। আর এরই মাধ্যমে শুধু কিলোগ্রামই না, তারা এর সাথে সাথে তাপমাত্রার একক কেলভিন, পদার্থের পরিমাণের একক মোল, বিদ্যুৎ প্রবাহের একক এম্পিয়ারকেও পুনসঙ্গায়িত করতে যাচ্ছেন। মানে একই দিনে চার চারটি মৌলিক এস আই (SI) এককের সংজ্ঞা আসছে নতুন করে। আর এর মাধ্যমে এর পর থেকে সকল এস আই মৌলিক একক (৭টি) সংজ্ঞায়িত করা হবে কোনো ভৌত রাশির নির্ভরশীলতা ছাড়া, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক অপরিবর্তনশীল ধারণা দিয়ে। কারণ অনেকেই হয়তো জানেন না এই চারটি এস আই একককে আসলে সংজ্ঞায়িত করা হয় কিলোগ্রামের সাথে সম্পর্ক দিয়ে, আর কিলোগ্রাম নিজেই সংঙ্গার জন্য এক ধাতব সিলিন্ডারের ওপর নির্ভরশীল, যে সিলিন্ডারের ভর আবার সময়ের সাথে বিচ্যুত হতে থাকে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ একক এমন একটা জিনিসের ওপর নির্ভরশীল যেটা নিজেই পরিবর্তনশীল, আবার সেই অতি দুর্লভ সিলিন্ডার সাধারণ মানুষের হাতের নাগালেরও বাইরে রাখা। তাহলে এখন কীভাবে কিলোগ্রামকে এমন একটা পদ্ধতিতে সংজ্ঞায়িত করা যায় যেটা কখনও পরিবর্তন হবে না আবার সকলের হাতের নাগালের মধ্যের থাকবে যে-কোনো যায়গায় যে-কোনো সময়? সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ভালকরে বুঝতে হলে আগে দরকার কিলোগ্রামকে সংক্ষিপ্তভাবে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার।


কিলোগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

কিলোগ্রামকে আবার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কী আছে। এটাকে আবার কি চেনে না। পদার্থবিজ্ঞান বা বিজ্ঞান পাঠ করেনাই যে কোনোদিন সে-ও তো কেজি কী জিনিস জানে। ঘরে বাইরে সব যায়গাতেই প্রতিদিন ব্যবহার করা হয় এই বহুল প্রচলিত একক পদ্ধতি।


মেট্রিক সিস্টেমে ভরের মৌলিক এককের নাম ছিল গ্র্যাভ (Grave)। যেই সিস্টেম পরে গিয়ে হয় সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল অব ডিউনিট্যে (System International d’unite) বা এস আই পদ্ধতি। ১৭৯৩ সালে প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী এন্টনি ল্যাভয়সিয়ের একটি কমিশন বরফ বিন্দুতে এক ঘন ডেসিমিটার আয়তনে পানির ওজনকে ভরের মৌলিক একক হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যেটাকে সহজ ভাষায় এক লিটার বরফ গলা পানির ওজন বলা যায়। গ্র্যাভ নামটি এসেছে ল্যাটিন নাম গ্র্যাভিটাস থেকে যার মানে হল ভর/ওজন। কিন্তু এই নামে ভরের একক বেশি দিন চলতে পারেনি, তার কারণ অন্য একটি শব্দ গ্র্যাফ (Graf)। তৎকালিন সময়ে গ্র্যাফ সমাজে একটি সম্ভ্রান্ত পদবী ছিল, যার উচ্চারণের সাথে গ্র্যাভ অনেকটাই মিলে যায়। সময়টা ছিল ফরাসি বিপ্লবের, যখন সমাজের সকলেই আন্দোলন করছে সমঅধিকার পাওয়ার জন্য, এমন সময়ে এরকম একটা নামের কারণে একটা একক অন্য এককের থেকে মর্যাদায় উঁচু শোনাবে তা কীভাবে হতে দেওয়া যায়। তখনকার নতুন গণতান্ত্রিক সরকার চিন্তা করলেন গ্র্যাভ হয়তো পরিমাপের জন্য অনেক বড়ো একটা একক, ছোটো জিনিস পরিমাপের জন্য তাদের একটা ছোটো একক দরকার। এইজন্য তারা গ্র্যাভের এক হাজার ভাগের এক ভাগকে নতুন একক ধরেন, নাম দেন গ্র্যাম (Gramme)। কিন্তু আবার কিছু সময় পরে দেখা গেল আসলে গ্র্যাম ভর পরিমাপের জন্য একটু বেশিই ছোটো হয়ে যায়, এক্ষেত্রে আগের বড়ো একক গ্র্যাভ বাস্তবে বেশি সুবিধার। কিন্তু নামের বিভ্রান্তি, যার জন্য তারা গ্র্যাভ নাম ব্যবহার করতে পারবে না, তাই তারা এর নতুন নামকরণ করে কিলোগ্রাম (গ্র্যামের এক হাজার গুণ)। এবং এই জন্যই সাতটি মৌলিক এস আই এককের মধ্যে কিলোগ্রাম একমাত্র একক যার নামের মধ্যে মূল শব্দের আগে প্রিফিক্স (Prefix) দেখতে পাওয়া যায়।


১৭৯৯ সালে কিলোগ্রামের সংজ্ঞা আবারও বদলানো হয়। এবার বলা হয় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক লিটার পানির ওজন এক কিলোগ্রাম, (যে তাপমাত্রায় পানির ঘনত্ব সর্বাধিক)। কিন্তু একটু ভালভাবে চিন্তা করলেই দেখা যায় পানি বা তরল কিলোগ্রামকে সঙ্গায়িত করার জন্য খুব সুবিধাজনক কোনো পদার্থ না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য একেবারে বিশুদ্ধ প্লাটিনাম সিলিন্ডার তৈরি করা হয়, যার ওজন ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক লিটার পানির ওজনের সমান। এই প্লাটিনাম সিলিন্ডারের মাধ্যমে কিলোগ্রামের সংজ্ঞা পানি বা তরল দিয়ে সংজ্ঞায়িত করার পদ্ধতি থেকে বের করে এনে মোটামুটি একটা স্থির সংজ্ঞা দেওয়া হয়।


৯০ বছর পরে ১৮৮৯ সালে কিলোগ্রামের সেই সিলিন্ডারকে আবারও সংশোধন করা হয়। এবার এটাকে বিশুদ্ধ প্লাটিনামের বদলে প্লাটিনাম-ইরিডিয়াম সংকর দ্বারা নতুন করে তৈরি করা হয়। আর এটাই কিলোগ্রামের এখন পর্যন্ত শেষ সংশোধিত সংজ্ঞা হিসেবে চলে এসেছে। এক কিলোগ্রাম মানে ওই প্লাটিনাম-ইরিডিয়াম সিলিন্ডার, পৃথিবীর একমাত্র এবং সবথেকে নির্ভুল এক কিলোগ্রাম হল ঐ এক ছোটো সিলিন্ডার, কারণ এটা নিজেই কিলোগ্রাম। সেই সাথে এটা একমাত্র এস আই একক যেটাকে এখন পর্যন্ত ভৌত পদার্থ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়, আর কোনো এককের ফিজিক্যাল (বস্তগত) রূপ নেই। অফিশিয়ালি এই সিলিন্ডারের নাম আন্তর্জাতিক প্রোটোটাইপ কিলোগ্রাম (IPK), প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হয় গ্র্যান্ড কে (Grand K or Big K)। এই এক কিলোগ্রামকে রাখা আছে তিনটি বেল জারের ভিতরে, ছয়টি অনুরূপ কিলোগ্রাম সিলিন্ডারের সাথে (প্রত্যেকটি তিনটি করে বেলজারের নিচে), অত্যন্ত সুরক্ষিত ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রিত একটি কক্ষে, যেই কক্ষটি অবস্থিত প্যারিসের আন্তর্জাতিক ওজন ও পরিমাপ ব্যুরো অফিসের বেইজমেন্টে।


কিন্তু তাহলে সারা পৃথিবীর মানুষ কীভাবে জানবে যে আসল কিলোগ্রাম আসলে কতটুকু বা সেটা পরিমাপে কোনো পরিবর্তন আসলো কিনা। বিভিন্ন স্থানে পরিমাপ নিয়ে যেন মানুষকে এই সমস্যায় না পড়তে হয় সেইজন্য যখন কিলোগ্রামের অরিজিনাল সিলিন্ডার বানানো হয় ১৮৮৯ সালে, তখন একই সাথে অনুরূপ আরও ৪০টি সিলিন্ডার বানানো হয়। একেবারে সূক্ষ্মভাবে ধরলে আসলে সবগুলো শতভাগ অনুরূপ ছিল না, তাদের ভর খুবই সামান্য পরিবর্তিত ছিল (যান্ত্রিক ত্রুটি), সেই পরিবর্তনকে রেকর্ড করে রাখা হয়। এরপর এই রেপ্লিকা সিলিন্ডারগুলোকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় একটা স্ট্যন্ডার্ড পরিমাপের একক হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য (সবগুলোকেই অরিজিনালের মতো সেই একই সুরক্ষায় সংরক্ষিত করা হয়)। তখন থেকে সারা পৃথিবীতে এক কিলোগ্রাম হিসেবে এই সিলিন্ডারগুলোকেই বুঝানো হয়ে আসছে।


আসল সমস্যা শুরু হয় প্রায় ৬০ বছর পর ১৯৪৮ সালে, যখন পৃথিবির বিভিন্ন প্রান্তে থাকা সকল কিলোগ্রাম সিলিন্ডারকে পুনঃনিরীক্ষণের জন্য একত্র করা হয়। এসময় পরীক্ষা করে দেখা যায়, যদিও সবগুলো সিলিন্ডার একই সংকর দিয়ে, একই পদ্ধতিতে তৈরি আর সবগুলো একই পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয়েছিল, কিন্তু তাও তাদের প্রত্যেকের ভর প্রস্তুতির সময়ের ভর থেকে বিচ্যুত হয়েছে। গ্র্যান্ড-কে এর ভরও একইভাবে বিচ্যুত হয়েছে, কোনো সিলিন্ডারের ভরই আগের অবস্থায় নেই। তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালাতে থাকেন কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। প্রায় ৪০ বছর পরে আবারও সকল কিলোগ্রাম সিলিন্ডারকে একত্র করে পরীক্ষা করা হয়, দেখা যায় প্রত্যেকের ভর আরও সরে গেছে তাদের ৪০ বছর আগের ভরের থেকে। এই বিচ্যুতি বাস্তবে অনেক ছোটো, প্রায় ৫০ মাইক্রোগ্রাম, যা প্রায় একটা আঙ্গুলের ছাপের (Fingerprint) ওজনের সমান। কিন্তু পরিমাণ এত ক্ষুদ্র হলেও সমস্যা অনেক বড়ো। এই পরীক্ষাগুলো থেকে বুঝা যায় প্লাটিনাম-ইরিডিয়াম সংকরের সিলিন্ডারগুলোর ভর সময়ের সাথে বিচ্যুত হতে থাকে, সেটা কেন হয় তা এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি, তবে সেটা অন্য আলোচনা। কিলোগ্রামের মতো এত বড়ো আর গুরুত্বপূর্ণ একক, যার ওপরে সাতটি এস আই এককের মধ্যে সরাসরিভাবে চারটি বড়ো একক নির্ভরশীল (অন্য সব লব্ধ এককের কথা বাদই দিলাম), এর মান অবশ্যই স্থির হতে হবে। যেসব দেশে এস আই একককে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা হয় না তাদের ভরের যে একক (যেমন পাউন্ড) এমনকি সেটাকেও সংজ্ঞায়িত করা হয় কিলোগ্রামের মাধ্যমেই। তাহলে অবশ্যই এমন কিছু একটা করতে হবে যাতে কিলোগ্রামের সংজ্ঞা কোনো ভৌত রাশির ওপর নির্ভরশীল না হয় যেটা সময়ের সাথে নিজেই পরিবর্তিত হয়। এই সমস্যা সমাধানে অনেক বিজ্ঞানী অনেকভাবে কাজ করেছেন কিন্তু সবগুলোর মধ্যে যে ২টি পদ্ধতি সব থেকে আলোচিত সেই দুটি হলো- 

এক, সিলিকন গোলক পদ্ধতি যেখানে পৃথিবীর সব থেকে নিখুঁত ও সব থেকে গোলাকার সিলিকন গোলক (যার ভর প্রোটোটাইপ কিলোগ্রামের সমান) তৈরির মাধ্যমে অ্যাভোগেড্রো ধ্রুবককে একেবারে স্থির করার চেষ্টা করা হয়।

 আর দুই, ওয়াট ব্যালেন্স পদ্ধতি যার মাধ্যমে নিখুঁতভাবে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক নির্ণয় করে স্থির করার চেষ্টা করা হয়। এই দুই পদ্ধতিতেই কিলোগ্রামের সংজ্ঞা ভৌত রাশির নির্ভরশীলতা থেকে জগতের অপ্রিবর্তনশীল প্রাকৃতিক এককে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।


সমস্যার সমাধান

অনেক আলোচনার পরে ২০১১ সালে বিজ্ঞানীরা ঠিক করেন যে কিলোগ্রামকে ভৌত রাশির নির্ভরশীলতা থেকে বের করে প্রাকৃতিক মৌলিক ধারণা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করতে হবে, যা করা হবে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের মাধ্যমে। এর মানে আবার এটা নয় যে অ্যাভোগেড্রোর নম্বর স্থির করার পদ্ধতি কাজের না, সেটাও অবশ্যই কাজের। কারণ অ্যাভোগেড্রোর নম্বর দিয়েও প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক হিসেব করা সম্ভব। এইজন্য প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক আর অ্যাভোগেড্রোর নম্বর উভয়কেই সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে দুটি পদ্ধতিই কম বেশি ব্যবহার করা হবে। কিন্তু এখন আলোচনার সুবিধার্থে ফিরে আসি প্ল্যাঙ্কের কথায়।


তো এই মতামত অনুযায়ী হিসাব নিকাশের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় পিছিয়ে ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল করা হয়, পরে যেটা আবারও পিছিয়ে ২০১৮ করা হয়। ২০১৮ সালের ১৬ নভেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে কিলোগ্রাম সংজ্ঞা পাল্টানোর এ মতামতকে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করা হয়। চূড়ান্তভাবে গৃহীত এই সিদ্ধান্তে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের সঠিক ও স্থির মান নির্ধারণ করা হয় 6.62607015×10^−34 kg⋅m^2⋅s^−1, যার মাধ্যমে এখন কিলোগ্রামকে সংজ্ঞায়িত করা হবে মিটার ও সেকেন্ড দিয়ে। আবার যেহেতু মিটারকেও সংজ্ঞায়িত করা হয় শূন্য মাধ্যমে সময়ের সাথে আলোর বেগের সম্পর্ক দিয়ে, তার মানে কিলোগ্রামকে সঙ্গায়িত করা হবে শুধু সময় দিয়ে। একসময় মিটারকেও কিলোগ্রামের মতো ভৌত রাশি দ্বারা সঙ্গায়িত করা হত, যেটাকে পরে আলোর বেগের মাধ্যমে সঙ্গায়িত করা হয়, যার জন্য আলোর বেগের সবথেকে নির্ভুল আর নিশ্চিত মান নির্ণয় করতে হয়েছে, 299792458.00ms^-1। এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ফলাফলের প্রয়োগ শুরু হয় ২০১৯ সালের মে মাস থেকে।


তাহলে কিলোগ্রামের প্রাকৃতিক আর অপরিবর্তনশীল সংজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের এক অপরিবর্তনশীল মান নির্ধারণ করার মাধ্যমে। এখন একটু এই সমাধানের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় আসা যাক। প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক বহুলভাবে প্রচলিত একটি ফোটন কণার কম্পাংকের সাথে এর শক্তির সম্পর্ক স্থাপনের জন্য (E=hf)। কিন্তু আমরা এটাও জানি যে শক্তি আর ভর আইনস্টাইনের E=mc^2 সমীকরণের মাধ্যমে সম্পর্কিত। এই দুই সমীকরণ থেকে বুঝা যায় প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক আসলে কিভাবে ভরের সাথে সম্পর্কিত (E=hf=mc^2)। কিন্তু এখন অব্দি সমস্যাটা হলো, প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকে কিছু অনিশ্চয়তা আছে। আমরা প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের মান দশমিকের পর অনেক ঘর পর্যন্ত জানি (যেমন h=6.626070XXXX x10^-34Js), কিন্তু বাস্তবে আসলে এই মানের শেষের কিছু অংক একেবারে স্থির না, সেগুলোকে নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যায় না। প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকে এই অনিশ্চয়তা থাকলেও, একটা জিনিস নিশ্চিত, সেটা হল সেই প্যারিসের অরিজিনাল প্লাটিনাম-ইরিডিয়াম সিলিন্ডারের ভর, এটার ভর সন্দেহাতীতভাবে ১ কেজি। পরিবর্তনশীল কোনো ধ্রুবক দিয়ে অপরিবর্তনশীল কোনো কিছুকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। এজন্য বিজ্ঞানীরা প্রথমেই যে কাজটি করেন সেটা হলো, প্ল্যাংকের ধ্রুবককে সম্পূর্ণ স্থির সংখ্যা মানে নিয়ে আসা। এরপরে এটা দিয়ে কিলোগ্রামকে ডিফাইন করা, যার মাধ্যমে ওই সিলিন্ডারের সংজ্ঞার আর কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের একটা নিশ্চিত, স্থির মান গ্রহণ করা যার মাধ্যমে প্যারিসের সেই সিলিন্ডারের ভর আর নিশ্চিতভাবে ১ কেজি থাকবে না। অবশ্যই সেই সিলিন্ডার তবুও ভরে ১ কিলোগ্রামই থাকবে কিন্তু একেবারে নিশ্চিতভাবে না। নিশ্চিত হবে এখন প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক যা নির্ধারণ করবে ১ কেজি আসলে কতটুক বা কত বড়ো ধারণা।


জল্পনা কল্পনা শুরু হয় এই প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক সংশোধনের জন্য। অবশ্যই এটা একটা বড়ো সিদ্ধান্ত কারণ যদি আসলেই এই ধ্রুবকের মান স্থির করা হয়, তাহলে এটাকে অবশ্যই একেবারে নির্ভুল হতে হবে, সেই সাথে বর্তমানে প্রচলিত সকল পরিমাপ আর ভরের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে এটাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকতে হবে। এমন একটা মান নির্ধারণের জন্য বিজ্ঞানীরা অনেক পদ্ধতি ধরে এগিয়েছেন, তার মধ্যে সবথেকে নির্ভুল মান গ্রহণে যে পদ্ধতির পক্ষে সহমত জানানো হয় সেটা হল ওয়াট ব্যালেন্স পদ্ধতি, বর্তমানে যেটাকে আবিষ্কারকের নামানুসারে বলা হয় কিবল ব্যালেন্স পদ্ধতি (Bryan Kibble, যিনি ২০১৬ সালে মারা যান)। এই জটিল পদ্ধতি আর কমপ্লেক্স মেকানিজমের বিস্তর বর্ণনায় না গিয়ে এক বাক্যে বলা যায়, এই পদ্ধতিতে বায়ুশূন্য ব্যাবস্থায় ১ কেজি ভরকে তড়িৎচৌম্বক শক্তির সাহায্যে ব্যালেন্স করা হয়, এই ব্যবস্থায় প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের ব্যবহার রয়েছে আর বিভিন্ন নিখুঁত মাপজোকের পরে এই ধ্রুবকের নিশ্চিত মানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়।


এখানে লক্ষ্য করার মতো একটা জিনিস হলো, আমরা কিন্তু কোনো একককে সঙ্গায়িত করার জন্য সেই একককে সংজ্ঞার সাথে ধরে নিতে হচ্ছে। যা বলতে চাইছি, এই কিবল ব্যালেন্স পদ্ধতিতে প্ল্যাংকের ধ্রুবক নির্ণয়ের সময় কিন্তু আমাদের ঠিকই ১ কেজি ভরের প্রয়োজন হয়েছে। অথচ আমরা সেটাকেই সংজ্ঞায়িত করতে চাই। আবার ১ মিটারকে এক সময় একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের প্লাটিনাম দন্ড দিয়ে পরিমাপ করা হতো। কিন্তু এই সংজ্ঞাকে ফিজিকাল থেকে মহাবিশ্বের কোনো ধ্রুবক দিয়ে প্রকাশের চেষ্টায় ১৯৮৩ সালে এই দন্ডের সমপরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর যতটুকু সময় লাগে সেটা হিসাব করা হয় (যেটার জন্য প্রথমে আলোর বেগকে স্থিরভাবে নির্ণয় করা হয়)। এই হিসাবকেই আবার উলটিয়ে বলা হয় যে, এত সময়ে আলো যত দূরত্ব অতিক্রম করে সেই দূরত্বকে ১ মিটার বলে! ঠিক একইভাবে কিলোগ্রামকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য আমরা আগে থেকেই ধরে নিচ্ছি যে, কতটুকু ভরকে আমরা আসলে কিলোগ্রাম বলতে চাই। 


কিন্তু এত কিছুর পরেও এককভাবে শুধু কিলোগ্রামের সংজ্ঞা পাল্টানো যাবে না কারণ, অন্য অনেক একক এই কিলোগ্রামের ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মোল (mole)। বর্তমানে ১২ গ্রাম কার্বন-১২ -তে যত সংখ্যক অণু আছে সেই সংখ্যাকে এক মোল ধরা হয়, যেটাকে আবার অ্যাভোগেড্রোর নম্বর বলা হয়। মানে অ্যাভোগেড্রো সংখ্যা নিজেই নির্ভর করছে আসলে ১২ গ্রাম বলতে কী বুঝায় তার ওপর, যেটা আবার নির্ভর করছে ১ কিলোগ্রাম বলতে কী বুঝায় তার ওপর। তো এই হিসেবে অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যাতেও রয়ে গেছে কিছু অনিশ্চয়তা। কিন্তু ১৮ নভেম্বরের সিদ্ধান্তের পর অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যাকেও নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করা হয় এমনভাবে যেটা নব নির্ধারিত প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ (6.02214076x10^23 mol^-1)। কেননা অ্যাভোগেড্রো সংখ্যা আর প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।


একইভাবে বিদ্যুৎপ্রবাহের একক এম্পিয়ারকে (ampere)  কিলোগ্রামের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা হবে না আর, এটাকে এখন সংজ্ঞায়িত করা হবে নতুনভাবে ও নিশ্চিতভাবে নির্ধারিত ইলেক্ট্রনের চার্জের মাধ্যমে (1.602176634x10^-19C)। এবং তাপমাত্রার একক কেলভিনকে সংজ্ঞায়িত করা হবে নতুনভাবে ও নিশ্চিতভাবে নির্ধারিত বোল্টজম্যান ধ্রুবকের মাধ্যমে (1.380649x10^-23J/K), যা আসলে গ্যাসের তাপমাত্রার সাথে এর কণাগুলোর গড় গতিশক্তির সম্পর্ক স্থাপন করে।


ভোল্টও (volt) আসলে একটু পরিবর্তন হবে (প্রায় দশ মিলিয়ন ভাগের সামান্য কিছু অংশ) আর রোধও তার থেকে আরও একটু অল্প পরিমানে পাল্টাবে। তার কারণ হল ১৯৯০ সালের দিকে বৈদুতিক পরিমাপের প্রতিনিধিগণ সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা আর প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের মান হালনাগাদ করবে না, এর বদলে ১৯৯০ সালে এর মান যা ছিল, সেটাকেই ধরে সামনে এগিয়ে যাবে। এই সিদ্ধান্ত তখন সুবিধার মনে হয় কারণ এর ফলে ঘন ঘন বিভিন্ন সংজ্ঞা বা যন্ত্রপাতির সেটিং বদলানোর ঝামেলা আর থাকে না। কিন্তু এখন এত বছর পর আমরা জানতে পারলাম যে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক আসলে ১৯৯০ সালে যা ছিল তার থেকে সামান্য আলাদা, তাই এখন বিভিন্ন বৈদুতিক পরিমাপের সংজ্ঞা বা যন্ত্রপাতিকেও হালনাগাদ করতে হবে।


এই সব নতুন নির্ধারিত মানগুলো হল সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা বিহীন, একেবারে স্থির আর অপরিবর্তনশীল। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, এই যে নতুন সব সংজ্ঞা, বাস্তবে কি আসলেই এগুলো কিছু পরিবর্তন করবে?


বাস্তব জীবনে অর্থ কি দাঁড়ায় এই সব সংজ্ঞা পরিবর্তনেরঃ

এখন কি কিলোগ্রাম নতুন কিছু? আগের কেজি কি আর নেই? আসলে, না। মানে অধিকাংশ মানুষের জন্য এই পরিবর্তনের বাস্তবে বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই। মানে হল আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এতদিন আমরা ১ কেজি বলতে যা বুঝে এসেছি, যেই ভরে আমরা বাজার থেকে চাল, ডাল, ফল কিনেছি, সেগুলোর কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে না। এতদিন ১ কেজি চাল বা ১ কেজি আপেল বলতে যতটুকু যা ছিল, এখনও তাই আছে আর তাই থাকবে। আমার ওজন এখন যে কেজিতে পরিমাপ করি, ভবিষ্যতেও তাই করা হবে। কোনো স্থানের তাপমাত্রা আমরা যেভাবে পরিমাপ করি, এই পরিমাপ বলতে যা বুঝায় সেগুলোও একই থাকবে। অর্থাৎ সবকিছুই যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখি, করি, বলি বা যাই করি, সবকিছুই অপরিবর্তিত থাকছে।


এমনকি বলা যায় অপরিবর্তিত থাকবে স্কুল কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষাও। কারণ স্কুল, কলেজ বা অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়েও সাধারণত এই ধ্রুবকগুলোর দশমিকের পর মোটামুটিভাবে ২-৫টি অংক নিয়ে গাণিতিক হিসেবগুলো করা হয়, দেখাই যাচ্ছে এই সীমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনা ই। তাহলে এই পরিবর্তনে লাভ হল কাদের? উদ্দেশ্যই বা কী ছিল?


উদ্দেশ্য আসলে এটাই ছিল, বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত সব পরিমাপ সিস্টেমে কোনো রকম পরিবর্তন না এনে শুধু ধ্রুবক ও এককগুলোকে এমনভাবে নির্ধারণ করা যা বাকি সবকিছুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেই সাথে এগুলো সম্পূর্ণ নিশ্চিত, অপরিবর্তনশীল এবং কোনোরকম ভৌত পদার্থের ওপর নির্ভরশীল না। এই সংশোধনের উদ্দেশ্য কোনো কিছুকে পরিবর্তন করা না, বরং সবকিছুকে পরিবর্তন ও ভৌত নির্ভরশীলতা থেকে বের করে এনে চিরতরে অপরিবর্তনশীল আর সকলের জন্য নির্ভরযোগ্য করা। এর মাধ্যমে যে কেউ এখন যে কোন স্থানে এইসব স্থির মান ব্যবহার করে অত্যন্ত সঠিক, সূক্ষ্ম পরিমাপ করতে পারবে।


কিন্তু এতকিছুর পরে এই সব পরিবর্তন আসলে খুবই সূক্ষ্ম, সামান্য একটা পরিবর্তন, আর সেটাও অনেক ছোটো পরিসরে, অল্প কিছু মানুষের জন্য (পৃথিবীর সকল মানুষের তুলনায় যদি ধরি)।


শেষকথা

তাহলে শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, এত কিছু পরিবর্তন আসলে আমাদের বাস্তব জীবনে কোনো কাজের না, বা আমরা আসলে কখনও বুঝতেও পারব না আদৌ কোথায় কী পরিবর্তন হল। কিন্তু সেটাই এই সংশোধনের উদ্দেশ্য।


আমাদের চারপাশের জগৎ, এই মহাবিশ্ব, মহাকাশ একটা বিশাল রহস্যের ভান্ডার। আর পরিমাপ বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। সৌরজগতে গ্রহের গতিপথের ব্যাখ্যায় কেপলারের সূত্র, বা গ্রহ গুলোর অবস্থান সম্পর্কে টাইকো ব্রাহের অত্যন্ত নির্ভুল ব্যাখ্যা, সবকিছুই সম্ভব হয়েছে সঠিক পরিমাপের জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে বোসন কণার অস্তিত্ব আবিষ্কার বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শনাক্তকরণ- এসব ঘটনাকে বলা যায় মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, যার মূলে রয়েছে সূক্ষ্ম ও নির্ভুল পরিমাপ।


পরিমাপ যে-কোনো রহস্য নির্ভুলভাবে সমাধানের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। আমরা যত নির্ভুলভাবে এসব পরিমাপ করতে পারব, মহাজগতের কোনো কিছু কীভাবে কাজ করে সেটা আরও নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারব বা বুঝতে শুরু করব। ২০১৮ সালের এই সংশোধনের মাধ্যমে নির্ভুল পরিমাপের সূক্ষ্মতাকে আরও একধাপ এগিয়ে নেওয়া হল। এখন আর আমরা মানুষের তৈরি কোনো বস্তু দিয়ে পরিমাপের মৌলিক এককগুলোকে সংজ্ঞায়িত করব না, বরং এখন এগুলোকে সংজ্ঞায়িত করা হবে ঠিক যেভাবে আমাদের মহাজগত চলে আসছে, যেভাবে প্রকৃতি পরিচালনা হয়ে আসছে সেভাবে।


[তথ্যসূত্রঃ The Verge, Veritasuim, The Guardian, Forbes, Wired, CNET, Wikipedia]

(Originally Written in November 2018).


লেখক : ওমর খালিদ সোহাগ

ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান 

Tags

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Top Post Ad

Below Post Ad

advertise