লেখক : ধ্রুব নাথ
ইদানীং অনেকেই হয়তো এনএফটি (NFT : non-fungible token) বা ক্রিপ্টোকারেন্সির যেমন : Bitcoin, OneCoin, Litecoin, Ripple, Dogecoin ইত্যাদির কথা শুনেছেন হয়তো।
এক কথায় বললে ক্রিপ্টোকারেন্সি হল এক রকমের ডিজিটাল কারেন্সি। আর এই মুদ্রা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলছিল অনেকদিন ধরে। সংকেতরীতি বিদ্যা বা ক্রিপ্টোগ্রাফি (Cryptography) থেকে যে এমন একটি মুদ্রা আবিষ্কার করা সম্ভব, সেটা গবেষকেরা জেনেছেন আশি'র দশকে (১৯৮২ রএ দিকে)। কিন্তু কয়েকটি সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হন তাঁরা। ২০০৮ সালে সাতোশি নাকামোতো (Satoshi Nakanoto) নামে এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সেসব সমস্যার সমাধান দিয়ে একটি গবেষণাপত্র ইন্টারনেট ফোরামে পাঠান। বিস্ময়করভাবে তার সমাধান কাজে লাগে। তার সমাধানের নাম ব্লক চেইন।
আরেকটি কথা বলে রাখি, এই এনএফটির কনসেপ্টও এসেছে ব্লকচেইন থেকে।
এখন কথা হলো,
ব্লকচেইন কি?
প্রথমেই এই নামেটির দিকে একটু ভালো করে লক্ষ্য করুন। ব্লক বললেই কোনো একটি আবদ্ধ অংশকে বোঝাচ্ছে আর চেইন কী তা আমরা সবাই জানি। অনেকগুলো বস্তু পাশাপাশি একটির সাথে আরেকটি যোগ করার মাধ্যমে সেগুলোকে সারিবদ্ধ করাকেই চেইন বলা হয়। তাহলে এক কথায় বলা যায় ব্লকচেইন মানে বলা হচ্ছে ব্লক দিয়ে তৈরি চেইন বা ব্লকের চেইন।
যে ব্লকগুলোর দ্বারা এই চেইনটি তৈরি করা হয় সেই ব্লকগুলো সাধারণত ইনফরমেশন জমা করে রাখে।
ব্লকচেইন হচ্ছে একটি ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার (যার মধ্যে ট্রান্সজেকশন এর তথ্য জমা থাকে), যেটা সকলের জন্য উন্মুক্ত। ব্লকচেইনকে এক প্রকারের ডেটাবেজও বলা যায়।যখন নতুন ডেটা আসে তা নতুন একটি ব্লক এ সংযুক্ত হয়। এবং ব্লকটি এর আগের ব্লকের সাথে সংযুক্ত হয়।বিভিন্ন ধরণের ইনফরমেশন ব্লকচেইন এ রাখা যায় কিন্তু ট্রান্সজেকশন এর লেজার হিসেবে ব্লকচেইন বেশি ব্যবহৃত হয়। ব্লকচেইনের ব্লকগুলোর মধ্যে যখন একটি তথ্য বা ডেটা ইনপুট দেওয়া হয়, তখন ওই ডেটাটিকে ডিলিট করা বা ডেটাটির কোনো ধরনের পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব।
ব্লকগুলোর মধ্যে প্রত্যেকটি ব্লকে মূলত তিনটি জিনিস থাকে - ডেটা, হ্যাশ এবং চেইনে তার আগের ব্লকটির হ্যাশ। এই ব্লকগুলো এক ধরণের হ্যাশিং এলগরিদম ব্যবহার করে। ব্লকচেইনের থাকা প্রত্যেকটি ব্লকে থাকে সেই ব্লকটির নিজস্ব ডেটা বা তথ্য, ব্লকটির নিজের হ্যাশ এবং তার আগের ব্লকটির হ্যাশ। হ্যাশ হচ্ছে মূলত একটি আইডেন্টিফায়ার (শনাক্তকারী)। প্রত্যেকটি ব্লকের হ্যাশ এবং প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট।
দুটি ব্লকের হ্যাশ কখনো মিলে না। আর এই হ্যাশগুলো তৈরি করা হয় প্রত্যেকটি ব্লকের স্টোর করা ডেটা অনুযায়ী। যার মানে, একটি ব্লকের ডেটা যদি কোনোরকম পরিবর্তন করা হয়, তাহলে ওই ব্লকটির হ্যাশও চেঞ্জ হয়ে যাবে। এবং সেই ব্লকের আগের হ্যাশটিও সংযুক্ত থাকায় অন্য ব্লকগুলোর ডেটাও চেঞ্জ হয়ে যাবে। এজন্য প্রত্যেকটি ব্লক এ তার আগের ব্লকের হ্যাশও থাকে। তাই ব্লকচেইনে ইনপুট করা প্রত্যেকটি ডেটা ডিলিট করা বা চেঞ্জ করা প্রায় অসম্ভব। কারণ, এক্ষেত্রে আপনি যদি একটি ব্লকে থাকা ডেটা চেঞ্জ করতে চান, তাহলে ব্লকচেইনটি ভ্যালিডিটি হারিয়ে যাবে এবং এটি আর কাজ করবেনা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে,
এই ব্লক চেইন প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে?
এই ব্লকচেইন নেটওয়ার্ক এ দুই ধরণের কী (key) থাকে, একটি হলো পাবলিক কী ,অন্যটি প্রাইভেট কী। পাবলিক কী হলো, একটি এড্রেস যেটা নেটওয়ার্ক এর প্রত্যেকে এক্সেস করতে পারে। আর প্রাইভেট কী হলো ইউনিক এড্রেস যেটি শুধু ইউজার জানে।
একটি ছোট্ট উদাহরণ এর মাধ্যমে ব্লকচেইন কীভাবে কাজ করে তা দেখে আসি।
ধরুন, এখানে দুজন ব্যক্তির প্রথম জন কিছু সংখ্যক বিটকয়েন দ্বিতীয় জনকে পাঠাতে চায় একটি হ্যাশিং এলগরিদম এর মাধ্যমে। এবং এই সম্পর্কিত সবগুলো তথ্য যেমন, দুই জনের ওয়ালেট এড্রেস ইত্যাদি ট্রান্সজেকশন ডিটেইলস হিসেবে গণ্য হবে। এবং এই ট্রান্সজেকশন ডিটেইলস এনক্রিপশন এলগরিদম এর মাধ্যমে এবং ইউনিক প্রাইভেট কী ব্যবহার করে এনক্রিপটেড থাকে।যখন এটি এনক্রিপ্টেড এবং ডিজিটালি সাইনড হয় তখন দ্বিতীয় জনের পাবলিক কী ব্যবহার করে এই মেসেজ নেটওয়ার্ক এ পাঠানো হয়। তখন এই ট্রান্সজেকশন এর ডিটেইলস দ্বিতীয় জনের প্রাইভেট কী ডিক্রিপ্ট করে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির তথ্য ব্লকচেইনের ব্লক এ সংরক্ষিত হয়।বিভিন্ন ধরণের কারেন্সির জন্য ভিন্ন ভিন্ন হ্যাশিং এলগরিদম থাকে। যেমন : Bitcoin ব্যবহার করে SHA-256 algorithm। Etherium ব্যবহার করে ETHASH।
নিশ্চই বুঝে গিয়েছেন যে ব্লকচেইন টেকনোলজি কীভাবে সিকিউরিটি (নিরাপত্তা) নিশ্চিত করে। এই ধরণের ট্রান্সজেকশন সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ঘঠছে। কিন্তু ব্লকচেইন সিকিউর হওয়ার আরেকটি বড়ো কারণ হচ্ছে, এই নেটওয়ার্ক ডিসট্রিবিউটেড। ব্লকচেইন মূলত একটি পিয়ার টু পিয়ার (P2P) নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যেখানে ব্লকচেইনের প্রত্যেকটি ব্লকের ডেটা ইন্টারনেটে কানেক্টেড থাকা যে-কোনো ব্যক্তি ব্লকগুলোকে ভেরিফাই করতে পারে।
এবার এই নতুন ব্লকটি ব্লকচেইনে কানেক্টেড থাকা সবার সামনে আসবে ভেরিফাই করার জন্য। তারা সবাই যখন এই ব্লকটিকে ভেরিফাই করবেন বা নিশ্চিত করবেন যে সব ঠিক আছে, তখন এই ট্র্যানজেকশন রেকর্ডটি ব্লকচেইনে স্থায়ীভাবে থেকে যাবে এবং ট্র্যানজেকশনটি কমপ্লিট হবে। বিটকয়েনের ক্ষেত্রে এই ব্লক ভেরিফাই করার কাজটি যারা করে থাকে তাদেরকেই বলা হয় বিটকয়েন মাইনার। মাইনারদের কিছু জটিল ম্যাথম্যাটিকাল প্রভলেম সলভ করতে হয় এবং তারা কিছু সংখ্যক বিটকয়েন রিওয়ার্ড পায়। এই প্রসেসকে বলে Proof of work।
ইদানীং এই ব্লকচেইন এর জনপ্রিয়তা প্রচুর বাড়ছে। যেহেতু এটি অনেক সিকিউর এবং তথ্য পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব তাই এর ব্যবহার সরকারিভাবেও বাড়ছে। আমরা তো ধারণা করতেই পারি, ভবিষ্যতে সকল ধরণের ডিজিটাল বিনিময় হবে ব্লকচেইন কেন্দ্রিক?
রেফারেন্স :
https://en.wikipedia.org/wiki/Blockchain
https://www.investopedia.com/terms/b/blockchain.asp
https://www.simplilearn.com/tutorials/blockchain-tutorial/blockchain-technology#
ধ্রুব নাথ,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।