লেখকঃ আতিকুর রহমান পাই
ডক্টর রড্রিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে যারপরনাই অবাক হলো জেরি।কাচা পাকা চুল দারি,চোখে মোটা ফ্রেমের একটা চশমা, দীপ্তিময় চেহারায় বিষ্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। ল্যাবের এপ্রনটা এখনো পড়ে আছেন। ল্যাব থেকে ছুটে আসছেন নাকি? জেরি ডক্টর রড্রিকে জানে একজন গম্ভীর মানুষ হিসেবে যে কিনা ল্যাবে দারিয়ে টেস্ট টিউব নাড়াচাড়া করে দু তিনটা রাসায়নিক মিলিয়ে চুপচাপ তা পর্যবেক্ষণ করতে ভালবাসে। তাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে অবাক না হয়ে পারলো না জেরি।
-" জেরিন তুমি ভাবতেও পারবে না কি হয়েছে! " এক নিশ্বাসে বলল ডক্টর রড্রি।
জেরি আবারো অবাক হলো। কারণ এর আগে ডক্টর রড্রি ওকে 'আপনি' বা 'মিস জেরিন' ছারা সম্মোধন করেনি কখনো। জেরি স্পষ্টই বুজতে পারছে ডক্টর রড্রি কোন কারনে খুব খুশি।
- "আমার এতদিনের গবেষণা এত দিনের পরিশ্রম আজ সফল হয়েছে জেরি। তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না আজ আমি কত খুশি। "
আজ জেরিও খুব খুশি। এই মানুষটা তার খুশি ভাগাভাগির জন্য তাকে বেছে নিয়েছেন এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে! অজান্তেই জেরির কোমল গাল বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল……
এই গল্পের ডক্টর রড্রি বা কোন সাইন্স ফিকশন মুভির কোন রসায়নবিদের কারিশমা দেখে আমরা যতটা না অবাক হই বাস্তব জীবনে রসায়ন বা কেমিক্যাল এর প্রতি তার থেকেও ঢেড় বেশি ভীতি প্রদর্শন করি। আমাদের কাছে কেমিক্যাল মানেই খারাপ কিছু। তার প্রমাণ বাজারে গেলেই মিলে। বাজারে আমরা কেমিক্যাল ফ্রি জিনিস খুজি, তা খাবার ই হোক বা কসমেটিকস(কেমিক্যাল ফ্রি ১০০% ভেষজ পাতাঞ্জলি ক্রিম)। ছাত্র জীবনে ফিজিক্স বা বায়োলজি কে যতটা ভালবেসে পড়েছেন সেটুকু ভালবাসা রসায়ন সাবজেক্টটার জন্য দেখালে এত দিনে এটা জানা বাকি থাকতো না যে সব কিছুই কোন না কোন কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি( হ্যা ভাই সব কিছু বলতে সব কিছু।আপনি,আমি,আপনার মাথার উকুন, আমাদের সুর্যিমামা সব কিছ)।
আচ্ছা "ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান" বলতে আসলে আমরা কোন বিজ্ঞানকে বোঝাই? ব্যাঙের ছাতায় আদোও কোন বিজ্ঞান আছে কি?
মোটাদাগে বলতে গেলে বায়োলজি আর কেমিস্ট্রি দুটোই আছে। আবার রসায়ন এর সাথে বায়োলজি বা ফিজিক্স দুটোরই ডায়রেক্ট লিংক আছে। এখানে আমরা রসায়নের ডাবল ধামাকা দিয়ে দেখার চেষ্টা করব ব্যাঙের ছাতা (মাশরুম) এর আদ্যপ্রান্ত। সাথে আছে দারুণ দারুণ এক্সপেরিমেন্ট!
ব্যাঙের ছাতা বা মাশরুম কি?
মাশরুম হলো ফাঙ্গাই (Fungi) যা কিনা উদ্ভিদ বা প্রাণী কোনটাই না! এরা সুগঠিত নিউক্লিয়াস যুক্ত, তার মানে এরা ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়া থেকেও আলাদা। এরা গাছের মত অভিস্রবণ প্রকৃয়ায় জৈব অনু আহরণ করে কিন্তু এদের গঠন আর প্রজনন গাছ থেকে ভিন্ন। আবার প্রানির মত এরা নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে না,খাদ্যের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল। দৈহিক দিক থেকে এর দুটি অংশ রয়েছে, এক- মাইসেলিয়াম যা কিনা মাটির নিচে থাকে এবং জৈব অনু সংগ্রহে সাহায্য করে, দুই - ফ্রুট বডি(এটাকেই অনেক সময় মাশরুম বলা হয়ে থাকে)।
অনেক মাশরুমই খাবার উপযোগী এবং পুষ্টিকর ও বটে। মাশরুম অনেক রাসায়নিক যৌগ সমৃদ্ধ যা সহজেই পরিক্ষা করে বের করা যায় ( পরবর্তিতে আমরা সেটাই পরিক্ষাকরে দেখব)। শর্করা, আমিষ, চর্বি ভিটামিন, খনিজ লবণ কি নেই এতে! পুষ্টি গুনের দিক থেকে এতে আছে সোডিয়াম ( Na), ক্লোরাইড (Cl⁻) এবং ফসফেট(PO₄³⁻) আয়ন যা আমাদের পানি সাম্যতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফসফেট(PO₄³⁻) আয়ন দাত ও হাড়কে দৃঢ়তা প্রদান করে এবং লোহিত রক্তকনিকা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এতে আছে Vitamin C (এসকরবিক এসিড : C₆H₈O₆ ) যা কোষের প্রতিরক্ষায় সাহায্য করে এবং আয়ন সঙ্গবদ্ধনে ভুমিকা রাখে।
এবার চলুন এইগুলার উপস্তিতি প্রমাণ করি বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্ট এর মাধ্যমে।
এক্সপেরিমেন্ট -০১ঃ প্রোটিন টেস্ট
Biuret Test এর মাধ্যমে মাত্র ৫ মিনিটেই মাশরুমে প্রোটিন উপস্থিত কিনা তা নির্ণয় করা সম্ভব।
🔹কি কি লাগবেঃ
🔸কপার(II) সালফেট / ব্লু বিট্রিয়ল বা তুতে ( CuSO₄. 5H₂O) সলিউশন (1mol/L)
🔸সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড (NaOH) সলিউশন ( 1mol/L)
🔸ফ্রেশ মাশরুম,ছুরি এবং পিপেট/ড্রোপার
🔹পদ্ধতিঃ
মাশরুম কে দুভাগে কেটে কাটা সার্ফেসে পিপেট দিয়ে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড(NaOH) সলিউশন এর পাতলা লেয়ার যোগ করি৷
এর পড় সেখানে কয়েক ফোটা কপার(II) সালফেট(CuSO₄. 5H₂O) যোগ করি।
প্রোটিন উপস্থিত থাকলে কপার(II) সালফেট এর হালকা নীল রঙ চেঞ্জ হয়ে গাঢ় নীল বা বেগুনি রঙ ধারন করবে( চিত্র-০১)।
🔹কারণঃ
প্রকৃত পক্ষে এই পরীক্ষা দ্বারা পেপটাইড বন্ধন(দুটি অ্যামিনো এসিড এর মাঝে C—N বন্ধন) শনাক্ত করা হয়।প্রোটিন অসংখ্য পেপটাইড বন্ধন দিয়ে তৈরি, সুতরাং এর মাধ্যমে প্রোটিন শনাক্ত ও সম্ভব। ক্ষারিয় মাধ্যমে কপার(II) আয়ন পেপটাইড বন্ধনে প্রোটিন-কপার কমপ্লেক্স গঠন করে। তার কারনেই রঙের পরিবর্তন ঘটে। এখানে NaOH ক্ষারিয় মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
এক্সপেরিমেন্ট -০২ঃ ভিটামিন-সি (এসকরবিক এসিড : C₆H₈O₆) পরীক্ষা ।
🔹কী কী লাগবে-
🔸পটাসিয়াম ফেরিসায়ানাইড K₃[Fe(CN)₆] এর 1% w/w সলিউশন স্প্রে যন্ত্রতে।
🔸আয়রন(III) ক্লোরাইড (FeCl₃) সলিউশন
🔸ফিল্টার পেপার, ফ্রেশ মাশরুম ও ছুড়ি।
🔹পদ্ধতিঃ
আয়রন(III) ক্লোরাইড (FeCl₃) সলিউশন দিয়ে ফিল্টার পেপার ভাল করে শোক করে নিতে হবে,এর পর ৩০ মিনিট ধরে এটাকে শুকাতে হবে। ফিল্টার পেপার এর রং হবে ফেরিক ক্লোরাইড এর উজ্জ্বল হলুদ রং।
অর্ধেক করে কাটা মাশরুম এর কাটা অংশ ফিল্টার পেপারে চাপ দিয়ে ধরে এর ছাপ নিতে হবে। এর পর নিরাপত্তা সহকারে পটাসিয়াম ফেরিসায়ানাইড সলিউশন ফিল্টার পেপারে স্পে করতে হবে।
🔹পর্যবেক্ষণ ও কারণঃ
পটাসিয়াম ফেরিসায়ানাইড ফিল্টার পেপারের রং কে হালকা নীল এ রুপান্তর করবে কারণ সেখানে পরশিয়ান ব্লু বা টার্নবুলস ব্লু উৎপন্ন হবে।ভিটামিন সি উপস্তিত থাকলে Fe(III) আয়ন এর বিজারন ঘটে Fe(II) উৎপন্ন হবে ফলে গাঢ় নীল রং দিবে।
পটাসিয়াম ফেরিসায়ানাইড এর সাথে বিক্রিয়া
K⁺ + Fe³⁺ + [Feᴵᴵ(CN)₆]⁴⁻
➡ KFeᴵᴵᴵ[Feᴵᴵ(CN)₆]
এসকরবিক এসিড ( C₆H₈O₆) এর সাথে বিক্রিয়া
2Fe³⁺ + C₆H₈O₆ ➡ 2Fe²⁺ + C₆H₆O₆⁺ + 2H⁺
আরও কিছু টেস্টঃ
🔷পটাসিয়াম(K) ও সোডিয়াম(Na) টেস্টঃ
শিখা পরীক্ষা(Flame Test) এর মাধ্যমে পটাসিয়াম ও সোডিয়াম টেস্ট করা সম্ভব।
🔹কি কি লাগবেঃ
🔸শুকনো মাশরুম
🔸বুনসেন বার্নার
🔸চিমটা ও কোবাল্ট গ্লাস
🔹পরীক্ষা ও সিদ্ধান্তঃ
চিমটা দিয়ে এক টুকরো শুকনো মাশরুম বুনসেন বার্নার এর শিখায় ধরো। শিখার রং পর্যবেক্ষণ কর। সোনালি হলুদ শিখা দেখা যাচ্ছে। এটা সোডিয়াম উপস্থিতি প্রমাণ করে। কিছুক্ষণ পর হালকা বেগুনি ও হলুদ মিশ্র রঙ এর শিখ দেখা যাবে। বেগুনি রঙ পটাসিয়াম এর উপস্থিতি নির্দেশ করে। বেগুনি রঙ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য কোবাল্ট গ্লাসের ভিতর দিয়ে শিখা দেখতে হবে। কোবাল্ট গ্লাস সোডিয়াম এর হলুদ রং কে ফিল্টার করে পটাসিয়াম এর বেগুনি রঙের শিখা পর্যবেক্ষণে সাহায্য করে।
🔷ফসফেট আয়ন (PO₄³⁻) টেস্টঃ
🔹যা লাগবেঃ
🔸অ্যামনিয়াম হেপ্টা-মলিবডেট [(NH₄)₆Mo₇O₂₄] সলিউশন
🔸লঘু নাইট্রিক এসিড (HNO₃) ( 2 mol/l)
🔸মাশরুম এর ছাই
🔸পাতিত পানি,ফিল্টার পেপার,টেস্ট টিউব,ফ্লাস্ক,বুনসেন বার্নার ইত্যাদি
🔹পদ্ধতি ও পর্যবেক্ষণঃ
শুকনো মাশরুম পোরসেলিন ডিস্কে করে পুরিয়ে তার ছাই করতে হবে। এর পর তা ১০ মি.লি পাতিত পানিতে দ্রবীভূত করে ফিল্টার পেপার দিয়ে ছেকে ফিল্টার করা তরল টেস্ট টিউব এ সংরক্ষণ করতে হবে।এর পর সংরক্ষিত তরলে ২/৩ মি.লি লঘু নাইট্রিক এসিড যোগ করে এসিডিক করি (এই সলিউশন পরবর্তী টেস্ট এর জন্য সংরক্ষণ করে রাখব)।
৫ মি.লি পরিমাণ এসিডিক ক্রিত মাশরুম ছাইয়ের সলিউশন নিয়ে ১০ ফোটা অ্যামনিয়াম হেপ্টা-মলিবডেট [(NH₄)₆Mo₇O₂₄] সলিউশন যোগ করি।এর পর ২ মিনিট বুনসেন বার্নার এ উত্তপ্ত করি।
অম্লীয় মাধ্যমে ফসফেট আয়ন অ্যামনিয়াম হেপ্টা-মলিবডেট [(NH₄)₆Mo₇O₂₄] এর সাথে বিক্রিয়া করে অ্যামনিয়াম ফসফো-মলিবডেট [(NH₄)₃PMo₁₂O₄₀] যৌগ তৈরি করে যা হলুদ বর্ণের অধঃক্ষেপ দেয়।
🔷ক্লোরাইড আয়ন (Cl⁻) টেস্টঃ
🔹যা যা লাগবেঃ
🔸এসিডিক ক্রিত মাশরুম ছাইয়ের সলিউশন ( পুর্বের টেস্ট থেকে সংরক্ষিত)
🔸সিলভার নাইট্রেট (AgNO₃) সলিউশন (5%w/w)
🔸টেস্ট টিউব,পিপেট
🔹পদ্ধতি ও পর্যবেক্ষণঃ
২/৩ মি.লি এসিডিক ক্রিত মাশরুম ছাইয়ের সলিউশন নিয়ে তাতে কয়েক ফোটা সিলভার নাইট্রেট (AgNO₃) সলিউশন যোগ করি।
ক্লোরাইড আয়ন সিলভার নাইট্রেট (AgNO₃) এর সাথে বিক্রিয়া করে সিলভার ক্লোরাইড(AgCl) এর সাদা অধঃক্ষেপ দিবে।
তথ্যসূত্রঃ
https://www.scienceinschool.org/content/natural-experiments-chemistry-mushrooms
DOI: 10.1016/B978-0-444-63601-0.00009-0
https://www.scienceinschool.org/content/natural-experiments-chemistry-mushrooms
https://www.chemistrylearner.com/biuret-test.html
DOI: 10.1016/B978-0-444-63601-0.00009-0
আতিকুর রহমান পাই,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।