লেখক- সমুদ্র জিত সাহা
মহাবিশ্বের অন্যসব জায়গায় প্রান খোজার আগে আমাদের আগে বুঝতে হবে প্রান কত প্রকার ও কী কী। প্রানের বৈশিস্ট্য কী, প্রান তার গ্রহ বা উপগ্রহে কেমন প্রভাব ফেলে হ্যান ত্যান….! কিন্তু আমরা এখনো পর্যন্ত শুধু এক প্রকার প্রানের ব্যাপারে জানি, DNA based life. আমাদের দেখা সকল জীব DNA/RNA ভিত্তিক। সবাই কোষ দ্বারা তৈরি। আমাদের এই এক প্রকার প্রান সৃস্টি ও বিকাশের জন্য জৈব যৌগ আর শক্তির উৎসের আগে প্রথম শর্ত হলো তরল পানি, Liquid water. যার ফলেই আমাদের কোষের আকৃতি বজায় থাকে, কোষ ঝিল্লির অনুগুলোর হাইড্রোফিলিক ও হাইড্রোফোবিক প্রান্তগুলো মিলে একটা বদ্ধ কাঠামো গঠন করে। ঠিক এজন্যই, পৃথিবীর বাইরে প্রানের অস্তিত্ব খোজার জন্য আগে আমরা তরল পানি খুজি। এখান থেকেই আসে কোন প্লানেটারি সিস্টেমের হ্যাবিটেবল জোন বা গোল্ডিলক জোনের ধারনা। হোস্ট স্টারের থেকে যে দুরত্বে থাকলে গ্রহের তাপমাত্রা পানি বাস্পীভূত হওয়ার মত বেশি হবেনা আবার পানি বরফে পরিনত হওয়ার মত কমও হবেনা। অর্থাৎ, কোন সোলার সিস্টেমের যে রেঞ্জে তরল পানি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাকে বলা হয় গোল্ডিলক জোন। এক্সোপ্লানেট খোজার ক্ষেত্রে আমরা শুরুতেউ গোল্ডিলক জোনের দিকে তাকাই। কিন্তু আসলেই এর দরকার আছে কী? গোল্ডিলক জোনের বাইরে প্রান থাকার সম্ভাবনা নেই?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুজে পাই আমরা দশকের পর দশক ধরে মহাকাশে পাঠানো স্পেস প্রোবগুলোর কল্যানে। এখন আলোচনা করব, আমাদের সোলার সিস্টেমে গোল্ডিলক জোনের বাইরে প্রানের সম্ভাবনা ও লিকুইড ওয়াটার নিয়ে।
Enceladus:
শনির সামান্য এক ছোট খাটো উপগ্রহ, বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কোন কারনই ছিলনা এর প্রতি। ইন্টারেস্টিং কিছু পাওয়ার কোন আশাই ছিলনা। বরফাবৃত উপগ্রহ, সূর্যের থেকে এত দূরে থাকায় আলো, উষনতার অভাবে তরল পানি থাকার কোন সম্ভাবনাই ছিলনা আপাত দৃস্টিতে। কিন্তু শনিকে প্রদক্ষিন করে ঘোরা ক্যাসিনি স্যাটেলাইটের তোলা এক ছবি বিশ্লেষন করে বিস্ময়কর জিনিস দেখা গেল। ঝর্নার মত পানি ছিটকে বের হচ্ছে ক্যাসিনি থেকে! বরফের ফুটো থেকে পানি ছিটে বের হচ্ছে!! কাছ থেকে দেখার জন্য ক্যাসিনিকে চালানো হলো এর দিকে, Enceladus এর সার্ফেস হতে বিপজ্জনক পরিমান উঁচুতে ক্যাসিনিকে চালানো হল। কারন একটাই, ক্যাসিনিতে ছিল যৌগ ডিটেকশন করার যন্ত্র, মূল উদ্দেশ্য ছিল শনির বলয়ের বস্তুগুলো কী দিয়ে তৈরি দেখা।
যাহোক, ইউসেলেডাসের সেই পানি বিশ্লেষন করে দেখা গেল এতে আছে লবন ও কিছু জৈব যৌগ! বিচার বিবেচনা করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে ইউসেলেডাসে তরল পানির সাগর আছে বরফ স্তরের নিচে। এই সাগর এতই গভীর যে নিচের খনিজপূর্ন তলে গিয়ে ঠেকেছে, যা কীনা এই লবনের উৎস। আর জৈব যৌগ গুলোর উৎস সাগরের তলের থার্মাল ভেন্টগুলো। কিন্তু কীভাবে সম্ভব সূর্য থেকে এত দূরে এত কম তাপমাত্রায় তরল পানি। ইউসেলেডাস তো সেরকম জিওলজিক্যাল এক্টিভিটির জন্য যথেস্ট ভারীও না, উত্তপ্ত কোর এর তো প্রশ্নই আসেনা।
সমাধান টা হলো টাইডাল হিটিং।
এনসেলেডাসের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার, অর্থাৎ শনিকে প্রদক্ষিনের কোন পর্যায়ে এটি গ্রহের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে, আবার কোন সময়ে অনেক দূরে। যখন শনির খুব কাছাকাছি অবস্থান করে তখন বিশাল ভরযুক্ত শনির তীব্র মহাকর্ষ বল আর গ্রাভিটির ইনভার্স স্কয়্যার সূত্র অনুসারে এনেসেলেডাসের শনির কাছের অংশ আর বিপরীত অংশের প্রতি শনির টানের পার্থক্য বিশাল হয়। ফলস্বরুপ, এনসেলেডাসের ক্রাস্ট ভেঙ্গে উঠে আসতে চেস্টা করে, এনসেলেডাসের আকৃতি পরিবর্তন হয়। ক্রাস্টের এই উঠে আসার চেস্টায় ঘর্ষনে প্রচুর পরিমানে তাপ উৎপন্ন হয়, আর এটাই যথেস্ট তরল পানির জন্য।
এখন আসি এনসেলেডাসে প্রানের সম্ভাবনা নিয়ে। এরকম গভীর তলদেশে উত্তপ্ত পরিবেশে জৈব যৌগ আর খনিজ পদার্থের সমারোহে প্রানের বিকাশ সম্ভব কী!?
পৃথিবীতেই তো এরকম পরিবেশ আছে সমুদ্র তলদেশে, আর সেখানে প্রান শুধু কোন মতেই বাচেনা, প্রচুর ভ্যারাইটি নিয়ে বিশাল পরিমানে প্রানী বাস করে। They just don’t survive, they trive!! আর পৃথিবীতে প্রানের উৎপত্তি নিয়ে সবচেয়ে লজিকাল ও বিখ্যাত ধারনাগুলোর একটাই হলো এই উপায়ে প্রানের বিকাশ। এনসেলেডাসে প্রানের সম্ভাবনা অনেক অনেক বেশি! এজন্যই শনিকে প্রদক্ষিন করা ক্যাসিনির জ্বালানী শেষ হয়ে গেলে একে এনসেলেডাসের আশেপাশে না রেখে শনির আবহাওয়ায় প্রবেশ করিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়, এনসেলেডাসের বিকাশমান প্রানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারত ওখানে ক্র্যাশ করলে!! ভবিষ্যতে এনসেলেডাসে ক্যামেরা, ড্রিল সহ রোভার(!) পাঠানোর চিন্তাভাবনা চলছে।
Europa:
গ্রহরাজ বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপার গল্পটাও অনেকটা একই। এর গায়ের বরফের প্যাটার্ন দেখে বোঝা যায় এর নিচেও বিশাল সাগর থাকতে পারে। ইউরোপার ভর যথেস্ট সমুদ্র তলদেশের জিওলজিক্যাল এক্টিভিটি, থার্মাল ভেন্টের জন্য। এখানেও তরল পানিতে প্রানের সম্ভাবনা রয়েছে, হয়ত কিছু মাইক্রোবস এখনই বাস করে সেখানে।
Titan:
সৌরজগতের সব উপগ্রহের মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হলো শনির উপগ্রহ টাইটান। ঘন মেঘে আবৃত বায়ুমন্ডলের জন্য এর সার্ফেসের প্রায় কিছুই দেখা যায়না পৃথিবী থেকে। সেই মেঘের উপর সূর্যের আলোর রিফ্লেকশনের বর্নালী পরীক্ষা করে বোঝা যায় এর অধিকাংশই মিথেন, CH4; জ্বী হ্যা, আপনার বাড়ির গ্যাসের সিলিন্ডারে অবস্থিত গ্যাস, বিপুল পরিমানে। চাঁদের পর টাইটানই একমাত্র উপগ্রহ যার সারফেসে ল্যান্ডার ফেলা হয়েছে, সেই ল্যান্ডারের ছবিতে দেখা গেছে লেক, নদী, পাহাড়, প্রবাহির ঘর্ষনের ফলে গোলাকৃতির পাথর! কিন্তু সূর্য থেকে এত দূরে -১৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এসব!! আসলে পানি ০ ডিগ্রীতেই বরফ হলেও, ০ ডিগ্রীতে গ্যাস মিথেন -১৮০ ডিগ্রীতে তরল মিথেন। হ্যা, টাইটানে মিথেনের নদী বইছে। আর ঐ পাহাড়গুলো সব বরফের পাহাড়। চিন্তা করুন টাইটানের লেকে নৌকা বেয়ে চলা! পাহাড়-নদীর সুন্দর (হলদে!) ভিউ এঞ্জয় করা! টাইটানে জৈব যৌগের অভাব নেই। এত কম তাপমাত্রায় টাইটানে প্রান আছে কীনা বলা মুশকিল, সম্ভাবনা কম। তবে ধারনা করা হয় সূর্যের শেষ বয়সে যখন এটি রেড জায়ান্টে পরিনত হবে তখন পৃথিবীকে খেয়ে ফেলার মত বড় হবে, আর টাইটান থাকবে পার্ফেক্ট তাপমাত্রায়। হয়ত তখন টাইটানে খেলে বেড়াবে সম্পূর্ন নতুন ধরনের প্রানীরা!
Pluto:
দশকের পড় দশক ধরে আমরা প্লুটোকে ধূসর কোন ছোট পাথর খন্ড বলেই জেনেছি, এতই ছোট যে জিওলজিকাল এক্টিভিটি তো দূরের কথা, নিজের কক্ষপথেরই শাসক নয় প্লুটো। যে কারনে একে গ্রহের মর্যাদা থেকেও বাতিল করা হয়েছে। এমনিতেই সাইজে ছোট, তার উপর সূর্য থেকে এত্ত দূরে, প্রানের সম্ভাবনা শূন্যেরও কম ধরে নেওয়ার মত ছিল!! কিন্তু আমাদের অবাক করে দিল New Horizon স্যাটেলাইটের পাঠানো ছবি, প্লুটো যে এত সুন্দর সেটা ধারনার অতীত ছিল, সে কথা নাহয় বাদই দিলাম। প্লুটোর গায়ের বরফের একদিকে পাওয়া গেল এক ধরনের প্যাটার্ন, যা শুধু তরল ও কঠিন হওয়ার চক্রে দেখতে পাওয়া যায়, অর্থাৎ, ঐ অংশের নিচে তরল পানি আছে! কিন্তু কীভাবে সম্ভব!? এর উত্তর আজও নিশ্চিতভাবে জানা নেই, তবে ধারনা করা হয় ওখানে কোন বড়সড় উল্কা পড়ে ভেতরে ঢুকে গেছে, যা ঐ তাপের উৎস। প্লুটোর কক্ষপথে তো এসবের অভাব নেই! তবে দু:খজনক ভাবে আমরা প্লুটোর শুধু একদিক পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি, এখানে প্রানের আশা করাটা অতিরিক্ত মনে হলেও
অসম্ভব কিছু না।
Jupiter and Saturn:
দুই গ্যাস-জায়ান্ট বৃহস্পতি আর শনি, বিশাল সাইজের এই গ্রহদুটোর প্রায় পুরোটাই গ্যাস, একদম ভেতরে হয়ত কঠিন সার্ফেস আছে, হয়ত নেই। থাকলেও অত গভীরে ভয়াবহ চাপে প্রানের সম্ভাবনা একেবারেই নাই! তারপরও কেন ঢুকালাম এদের এই তালিকায়!? কারন শনি বা বৃহস্পতির উপর থেকে যতই গভীরে যাওয়া যায় ততই চাপ বাড়তে থাকে, চাপ বাড়তে বাড়তে নি:সন্দেহে এমন বিশাল এক লেয়ার আছে যেখানে তরল পানি পাওয়া যাবে, জিওলজিকাল এক্টিভিটির জন্যও গ্রহ দুটো যথেস্ট(!) বড়। আর প্রান সৃস্টিও এত কঠিন বা অস্বাভাবিক বিষয় না। সুতরাং, আশা রাখা যেতেও পারে।
পরিশেষঃ
আজকের আলোচনা শেষ করব আমার খুব প্রিয় একটা ছবি দিয়ে। New Horizon যখন প্লুটোকে পার করে সৌর জগতের বাইরের দিকে যেতে থাকে তখন শেষবারের মত তার ক্যামেরা ঘুরিয়ে একটা ছবি নেয় প্লুটোর, যেখানে সূর্য ঠিক বিপরীতে, আর সূর্যের আলো পড়ছে প্লুটোর বায়ুমন্ডলে, সুন্দর নীলচে পাতলা মনোমুগ্ধকর বায়ুমন্ডল। ছবিটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি অনেকসময়। এই ছবিটা অনেক কিছু তুলে ধরে, স্পেস এক্সপ্লোরেশন শুরু করেছি আমরা মাত্র কয়েক দশক ধরে। অনেক দূর পৌছেছি আমরা, অনেক দূর। কিন্তু এটাই শুরু, এই অনেক দূর মহাজাগতিক ক্ষেত্রে সামান্য দূর, কেবল সৌরজগতের বাইরে যাচ্ছে আমাদের যন্ত্রগুলো। আমাদের আরো আগাতে হবে, যতদূর এসেছি তা থেকে অনুপ্রানিত হয়ে আরো দূর যেতে হবে।
লেখক- সমুদ্র জিত সাহা