লেখক: আবু রায়হান
সুনামি :
সুনামি (Tsunami) 'সুনামি’ জাপানি শব্দ। বাংলায় এর অর্থ ‘পোতাশ্রয়/বন্দর ঢেউ’। সাগর বা নদী বা অন্য কোনো জলক্ষেত্রে ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, আগ্নেয়গিরির উদগিরণ কিংবা অন্য কোনো কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসকেই বলা হয় সুনামি।
কারণ সমূহ :
বিভিন্ন কারণে সুনামির সৃষ্টি হতে পারে। কারণগুলো হলো :
১। ভূমিকম্প(Earthquake),
২। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত (Volcanic Eruption),
৩। ভূমিধ্বস (Landslide),
৪।তুষারধ্বস
৫। উল্কাপাত
আর নিউক্লিয়ার বোমা টেস্ট করতে গিয়ে বা ইচ্ছাকৃতভাবে নিউক্লিয়ার বোমা দ্বারা কৃত্রিমভাবেও সুনামিও ঘটানো যাবে।
যাহোক, সুনামি সংঘটনের অনেক কারণের মধ্যে প্রধান কারণটি হলো সমুদ্রতলে টেকটোনিক পেটের আকস্মিক উত্থান-পতন এবং তার ফলশ্রুতিতে সমুদ্রতলে ভূমিকম্প সংঘটন।
আজকের আলোচনা মূলত এ প্রধান কারণটা নিয়েই।
১। ভূমিকম্প দ্বারা সুনামি :
সমুদ্রতলে ভূমিকম্প হলে তা সমুদ্র তলদেশের মাটিকে যেমন নাড়া দেয় তেমনই স্বাভাবিকভাবেই সমুদ্রতলের উপরিস্থ পানিতেও তার কম্পন সৃষ্টি হয়। ভূমির কম্পন যখন পানিতে সঞ্চালিত হয়, তখন তার ফলে সুনামির উৎপত্তি হতে পারে। এছাড়াও সাধারণত ভূমির অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া হতে থাকে। এভাবে কখনো কোনো একটি প্লেট অপর প্লেটের দিকে অনবরত ধাক্কা দিতে থাকলে তখন সেখানে একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের ওপর উঠে যায়। তখন ওই স্থানের ভূ-ত্বক আচমকা উঁচু হয়ে ছোটো টিলা থেকে পাহাড় সমান পর্যন্ত উঁচু হয়ে যেতে পারে। ফলে সে উঁচু হওয়া সমুদ্র অংশের পানি তার সাম্যাবস্থা বা স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বিশাল উঁচু ঢেউয়ে পরিণত হয়।
এরপর সে উঁচু হওয়া ঢেউ অগ্রসর হয়ে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলোর দিকে ধাবিত হয় এবং ঢেউ যদি বেশি উঁচু হয়ে থাকে তবে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলো ঢেউয়ের নিচে পড়ে ভেসে যায়। সমুদ্রের পানি স্থলে প্রবেশ করে এবং তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষদের জীবন ভয়াবহ সংকটের মাঝে পড়ে যায়।
সমুদ্র, নদী, জলাশয় কিংবা বৃহৎ জলক্ষেত্রের পানিও হঠাৎ ফুলে উঠে সুনামির সৃষ্টি হয়। (এসব কেমনে হয়, কেন হয় বিস্তারিত আসছে)
গভীর জলে সুনামি প্রতি ঘণ্টায় ৬০০ মাইল (প্রায় ৯০০-৯৫০ কিলোমিটার) গতিরও হতে পারে। সুনামির ঢেউ সাধারণত ধারাবাহিক হয় এবং একটি ঢেউয়ের চূড়া থেকে আরেকটি ঢেউয়ের চূড়ার দূরত্ব (তরঙ্গদৈর্ঘ্য) ১০০ মাইলের (১৬০ কিলোমিটার) মতো হতে পারে। তাই একটি বড়ো ঢেউ আঘাত করার মোটামুটি ১ ঘণ্টা বা সামান্য বেশি সময় পর দ্বিতীয় আরেকটি এবং আরও ১ ঘণ্টা পর তৃতীয় আরেকটি, এভাবে ঢেউগুলো ভূ-ভাগে এসে আঘাত করতে পারে।
সুনামি হওয়ার কারণ হিসেবে মূলত পৃৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া, উত্থান-পতন এবং সে নড়াচড়ার কারণে সমুদ্রের ভূ-ত্বক উঁচু হওয়াকে প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা যায়, যদিও আরও কারণ আছে।
এখন প্রশ্ন হলো-
১। সমুদ্রের মাঝখানের ভূ-ত্বক উঁচু হয় কেন ?
২। টেকটোনিক প্লেট নড়াচড়া করে সমুদ্রতলের
ভূ-ত্বক কীভাবে উঁচু করে দিতে পারে ?
৩। উঁচু হয়েই কীভাবে সুনামি ঘটায় ?
ওপরের দুইটি প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আমাদের জানা প্রয়োজন টেকটোনিক প্লেট কেন নড়াচড়া করে এবং পৃৃথিবীর ভূস্তরগুলো কেমনে কী।
এসব জানতে বা বুঝতে পারলে ওপরের দুটি প্রশ্নের উত্তর বুঝতে পারা সহজ হয়ে যাবে।
টেকটোনিক প্লেট কেন সরে যায় ? টেকটোনিক প্লেট সরে গিয়ে কীভাবে সুনামি ঘটে ?
আমরা অনেকেই বাসায় বিভিন্ন জাতীয় খাবার চুলায় সিদ্ধ করে থাকি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যখন চুলার তাপ বৃদ্ধি পেয়ে পানি ফুটতে শুরু করে তখন রান্না করা খাবারগুলো গতিপ্রাপ্ত হয়ে দ্রুত পানির ওপরের দিকে ঠেলে উঠতে থাকে এবং এ প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত তাপ প্রবাহ বিদ্যমান থাকে।
যখন তাপপ্রবাহ কমতে থাকে অথবা পানি শীতলতর হতে থাকে তখন আবার খাবারগুলো ধীরে ধীরে নিচে নামে এবং পানির নিচের স্তরে জমা হয়। যেহেতু পাত্রের নিচের দিকে তাপমাত্রা বেশি তাই সেই অংশ থেকে খাবারগুলো ওপরে উঠে আসে খুব দ্রুত এবং পাত্রের ওপরের তাপমাত্রা তুলনামূলক কম থাকায় সেখানে খাবারগুলো তুলনামূলক ঠান্ডা হয়ে, ঘনত্ব বেড়ে গিয়ে ভারী হয়ে অভিকর্ষের টানে নিচের দিকে পতিত হয়। আবার সেগুলো নিচে এসে তাপ পেয়ে হালকা হয়ে বা ঘনত্ব কমে আবার ওপরে উঠে যায়, আবার নিচে নামে। এভাবে এ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে। ফলে এ চক্রটিতে একটি কনভেকশন সেল সৃষ্টি করে
(চিত্রে দেখুন কনভেকশন সেল)
খেয়াল করবেন যে পানি যখন ওপরে টগবগ করে ওঠে তখন সে ফুটন্ত পানির টগবগ করার কারণে পানির ওপরে কোনো কিছু ভেসে থাকলে তার সরণ হয়, টগবগে পানির কারণে পানির ওপরে ভাসমান কোনো কিছু আর স্থির বা নড়াচড়াহীন হয়ে ভাসমান অবস্থায় থাকতে পারে না, নড়াচড়া করতে বাধ্য হয়, স্থান পরিবর্তনে বাধ্য হয়। এভাবে তাপের সঞ্চারণকে Thermal Convection (তাপের পরিচলন) বলে।
এ পদ্ধতিতে তাপ কোনো পদার্থের অণুগুলোর চলাচলের দ্বারা উষ্ণতর অংশ থেকে শীতলতর অংশে সঞ্চালিত হয়।
বিশেষত তরল ও বায়বীয় পদার্থগুলোতে এ পদ্ধতিতে তাপ সঞ্চালিত হয়। তাপ গ্রহণ করে পদার্থের উষ্ণতর অংশের অণুগুলো শীতলতর অংশের দিকে প্রবাহিত হয়, এভাবে অন্য অণুগুলো স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজ গতির সাহায্যে তাপ সঞ্চালিত করে।
পৃথিবীর ভূগর্ভের অভ্যন্তরে ঠিক একই প্রক্রিয়া ঘটে এবং এই ধর্মের প্রভাবে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া হয় বলে মনে করা হয়।
পৃথিবীর ভূগর্ভের গঠন চিত্রে দেখুন।
এই গঠনটি কিছুটা পেঁয়াজের মতো, পেঁয়াজকে কাটলে অনেকগুলো স্তর পাওয়া যায় এবং একেক স্তরের পুরুত্ব একেক রকম। টেকটোনিক প্লেট নিয়ে আলোচনায় সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো ভূঅভ্যন্তরের গঠন জানা, Lithosphere ও Crust এর গঠন এবং কার্যপ্রণালী বিস্তারিতভাবে জানা।
টেকটোনিক প্লেট কী ?
পৃথিবীর কেন্দ্রে যে গোলাকার রক্তিম বলয়টি (Inner core) থাকে সেটা অত্যন্ত উত্তপ্ত এবং এর তাপমাত্রা সূর্যের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রার কাছাকছি। ইনার কোর (Inner core) মূলত কঠিন লৌহ পদার্থের তৈরী। এরপর যে আউটার কোর (Outer core) দেখা যাচ্ছে সেটা আসলে লৌহ এবং নিকেলের তৈরী তরল স্তর (Fluid layer)। এর ওপরে সলিড Mantle অবস্থিত। 'জার্নি টু দ্য সেন্টার অভ আর্থ' লেখাটা পড়ুন, ধারণা আরও সমৃদ্ধ হবে।
ম্যান্টেলের সবচেয়ে বাইরের দিকে Asthenosphere স্তর দেখা যাচ্ছে, সেটিও কঠিন পাথর, কিন্তু এটি বেশ দুর্বল স্তর, কারণ এটি আলকাতরা বা পিচের মতো (যেমন Tar) যেটিকে উত্তপ্ত করলে গলিত হয়ে গঠন পরিবর্তন করে এবং শীতল হলে আবার কঠিনে পরিণত হয়। মানে এ স্তরটি কঠিনও নয় তরলও নয়।
এর ওপরে যে ভাসমান কঠিন অশ্মমণ্ডল (Lithosphere) দেখা যাচ্ছে, সেখানেই টেকটোনিক প্লেট (Tectonic plate) এর অবস্থান। আমাদের ভূপৃষ্ঠ এসব কিছু খণ্ড খণ্ড টেকটোনিক প্লেটের সমন্বয়ে জিগস পাজলের মতো হয়ে তৈরি।
টেকটোনিক প্লেট Lithospheric plate নামেও পরিচিত। Crust হচ্ছে পৃথিবীর পৃষ্ঠতল। ওপরের ছবিতে Crust এবং Lithosphere কে আলাদা স্তর হিসেবে দেখানো হলেও ভূতত্ববিজ্ঞানে আলোচনার সুবিধার্থে আমরা এ দুই স্তরকে একটি স্তর হিসেবে ধরে নিতে পারি। অর্থাৎ, Crust হলো Lithosphere এর একটি উপ-স্তর।
অশ্মমণ্ডল বা Lithosphere স্তর বেশ শক্তিশালী এবং দৃঢ় পাথর দিয়ে তৈরী। এ স্তরটি সাধারণত দুইভাগে বিভক্ত :
একটি হলো Oceanic crust (পৃথিবীর যে অংশে সাগর) এবং আরেকটি হলো
Continental crust (স্থলভাগ)।
নিচের ছবিতে মাঝের উঁচু কালো অংশটা হলো Continental crust এবং দুইপাশের ঢালু (পানির নিচের) কালো অংশ হলো Oceanic crust।
Oceanic crust এর পুরুত্ব খুব পাতলা (মাত্র ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার।) অন্যদিকে Continental crust- এর পুরুত্ব অনেক গভীর (প্রায় ৩০-৫০ কিলোমিটার)।
Lithosphere স্তর-এর ভূমির অভ্যন্তরীণ গঠনের জটিলতা এবং বৈচিত্র্যতার কারণে নানা সময়ে আমাদের প্রাকৃতিক আকস্মিক বিপর্যয় (যেমন : ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, সুনামি ইত্যাদি)-এর সম্মুখীন হতে হয়েছে। নিচের মানচিত্রে কালো মোটা দাগ দিয়ে টেকটোনিক প্লেটগুলোর সীমানা ভাগ করে দেখানো হয়েছে।
এবার চলুন আসল প্রশ্নের উত্তরে আসি।
টেকটোনিক প্লেট কেন সরে যায় ?
প্রথমেই আমি ফুটন্ত পানিতে রান্না করা খাবারের উপমা দিয়ে বস্তুর গতির ধরণ বোঝাতে চেয়েছিলাম। তাপ প্রবাহের কারণে বস্তুর কণাগুলো ওপরে উঠে এবং তাপমাত্রা শিথিল (শীতল) হলে কণাগুলো নিচে নামে এবং এই ধর্মকে একটি চক্রাকার আবর্তন হিসেবে কল্পনা করা যায়।
পদার্থবিজ্ঞানে এটাকে থার্মাল কনভেকশন/তাপীয় পরিচলন (Thermal convection) বলে, থার্মাল কনভেকশন একধরণের হিট ট্রান্সফার (Heat transfer) প্রক্রিয়া (দেখতে কিছুটা নিচের ছবির মতো)।
এবার নিচের ছবিটি দেখুন, ওপরের ছবির সাথে কোনো মৌলিক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় কি না। এখানে মূলত যে ঘটনাটি ঘটছে সেটি হলো Inner core এর প্রচণ্ড উত্তপ্ততার কারণে Outer core উত্তপ্ত হচ্ছে। ফলস্বরূপ ম্যান্টলের বাহ্যিক অংশ (Asthenosphere) এতটা উত্তপ্ত হয়ে যায় যে অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারের উপরিভাগ (লিথোস্ফিয়ার) পিচ্ছিল স্তরে (Lubricated layer) পরিণত হয় এবং যে-কোনো কঠিন পদার্থও (লিথোস্ফিয়ারে তৈরি হওয়া টেকটোনিক প্লেটগুলো) এই স্তরের ওপর ধীরে ধীরে পিছলিয়ে গিয়ে বা সরণ হয়ে একটি আরেকটির সাথে ধাক্কা খায়। ম্যান্টেল থেকে প্রভাবিত ও পরিচালিত পরিচলন প্রক্রিয়ার কারণে ম্যান্টলের ওপরে ভাসমান লিথোস্ফিয়ারেরও সরণ বা নড়াচড়া হতে থাকে এবং লিথোস্ফিয়ারের সরণের কারণে এর ওপর ভাসমান টেকটোনিক প্লেটগুলোরও সরণ ঘটে।
মনে করেন, কোনো ঠান্ডা স্থির পানির ওপরে কিছু শুকনো পাতা রেখে দিয়েছেন। পাতাগুলো মোটামুটি স্থির হয়ে ভেসে আছে। তারপর পানিকে ফুটতে দিন। দেখতে পাবেন টগবগ করে নিচের গরম পানি ফুটে ওপরে উঠে গিয়ে সে টগবগিয়ে ওঠা পানি তার ওপর ভাসমান পাতাগুলোকে নড়াচড়া করছে বা পাতাগুলোকে স্থির থেকে গতিশীল করছে।
পাতাগুলো কেন নড়াচড়া করছে ?
কারণ তাপের পরিচলন প্রক্রিয়ার দ্বারা তাপের ট্রান্সফার হচ্ছে, নিচের গরম পানি ওপরে ওঠে তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে, ওপরে ওঠে ঠান্ডা হয়ে পানি আবার নিচে নেমে যাচ্ছে। এর ফলে পানিতে এরূপ ক্রমান্বয়ে পরিচলন প্রক্রিয়া সংঘটিত হওয়ায় টগবগে পানি এর ওপরে ভাসমান পাতাগুলোকেও স্থির অবস্থা থেকে গতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসছে, পাতার সরণ ঘটছে, নড়াচড়া করছে। একই প্রক্রিয়ায় টেকটোনিক প্লেটগুলোও নড়ছে, স্থান পরিবর্তন করছে।
সহজ ভাষায় এভাবে বোঝা গেলেও ব্যাপারটি এতটা সরল নয়। কেন নয় তা সামনে আসছে।
সুনামি সংঘটনের মূল কারণের মধ্যে ভূমিকম্প অন্যতম, আর ভূমিকম্পের পেছনে টেকটোনিক প্লেটগুলোর বিভিন্ন রকম চলাচল ও নড়াচড়া দায়ী।
যাহোক, আগেই বলেছি Oceanic crust এর পুরুত্ব খুবই কম এবং অন্যদিকে Continental crust বেশ পুরু। কিন্তু গঠনগত উপাদানের ভিন্নতার কারণে ওশেনিক ক্রাস্টের ঘনত্ব কন্টিনেন্টাল ক্রাস্টের চেয়ে অধিক।
দুটি টেকটোনিক প্লেটের পারস্পরিক সংঘর্ষই ভূমিকম্পের প্রধান কারণ। প্লেটের সংঘর্ষের সময় যেটির ঘনত্ব বেশি সেটা গ্র্যাভিটির কারণে অন্য প্লেটটার নিচে তলিয়ে যায় যে ঘটনাকে Subduction (অবনমন) বলা হয়। যে প্লেটটা তলিয়ে যায় সে প্লেটটাকে subducted plate এবং যে প্লেটটা ওপরে অবস্থান করে তাকে overridding plate বলে।
এর ফলে এ দুই প্লেটের ঘর্ষণস্থলে এবং ম্যান্টেলে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। অবনমিত প্লেটের চাপে ম্যান্টেল থেকে ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠ ভেদ করে ওপরে উঠে আসে। তখন সমুদ্রতলে পানির নিচে বা কোনো দ্বীপে আগ্নেয়গিরির উদগিরণ ঘটতে দেখা যায় এবং প্লেটগুলোর একে অপরের সাথে ঘর্ষণে সমুদ্রতলে প্রচণ্ড কম্পন সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রতিতে
সমুদ্রতলে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয় এবং সাথে সাথেই তার প্রভাবরূপে সুনামি সৃষ্টি হয়ে যায়। সকল সুনামি ধ্বংসাত্মক নয় বলে আমরা ধ্বংসাত্মকগুলো বাদে বাকিগুলোর ওপর নজর দিই না।
যাহোক, টেকটোনিক প্লেটের বিভিন্ন রকম সরণ নিয়ে আলোচনা করছিলাম।
টেকটোনিক প্লেটগুলোর বিভিন্ন রকম সরণ হয়।
বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা বিজ্ঞানীরা টেকটোনিক প্লেট/পাতগুলির প্রান্তসীমানায় প্রধানত তিনটি গতি লক্ষ করেছেন।
1. অভিসারী পাত সীমানা ( Converging Plate Boundary)
2. প্রতিসারী পাত সীমানা ( Divergent Plate Boundary)
3. প্রতিগামী পাত সীমানা ( Transfom Plate Boundary)
1.অভিসারী পাত সীমানা (Converging Plate Boundary) :
কনভেকশন কারেন্টের কারণে পাতগুলো কখনো একে অপরের দিকে বা বিপরীত দিকে অথবা সমান্তরাল হয়ে সরে যেতে পারে বা নড়াচড়া করতে পারে।
দুই বিপরীত দিক হতে পরস্পর মুখোমুখি দুটি পাত যখন পরস্পরের দিকে গতিশীল হয় তখন তাকে অভিসারী পাত সীমানা বলে।
এতে পরস্পর অভিমুখে আগত পাত দুটির মধ্যে একটি যদি মহাসাগরীয় পাত হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই মহাদেশীয় পাতের নিচে প্রবেশ করে যা ওপরেই বলেছি।
(দুটি পাতের মিলনের ফলে যে পাতটি বেঁকে অন্য পাতের নিচে অবস্থান করে সেই বক্রপাতযুক্ত ভূমিকম্প প্রবণ ঢালু প্লেটের সীমানাতলকে বেনীঅফ জোন বা Beneoff Zone বলে। এই বেনীঅফ জোন ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে 30 ডিগ্রি থেকে 80 ডিগ্রি কোণে অবস্থান করে। তবে সাধারণত 45 ডিগ্রীর কাছাকাছি এই মণ্ডল থাকে)
এই অভিসারী প্লেট সীমানাকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়:
1 . মহাদেশ–মহাদেশ অভিসারী প্লেট সীমান্ত:
2 . মহাসমুদ্র–মহাদেশ অভিসারী পাত সীমানা :
এই ধরনের সীমানা মহাদেশীয় ও মহাসাগরীয় পাতের সংযোগস্থলে পরস্পর আসা পথের সংযোগে হয়ে থাকে। এখানে মহাসাগরীয় প্লেট অপেক্ষাকৃত ভারী শিলা দ্বারা গঠিত বলে এটা মহাদেশীয় পাতের নিচে প্রবেশ করে। প্রকৃতপক্ষে দুটি পাতের মধ্যে মহাসাগরীয় পাতটি বেঁকে ভূগর্ভস্থ Asthenosphere এর উত্তপ্ত পদার্থের মধ্যে প্রবেশ করে এবং ঐ সকল লাভাজাত পদার্থের সঙ্গে মিশে যায়। দুটি পাতের মিলনস্থলে এক সমুদ্রখাতের সৃষ্টি হয়। যেখানে সামুদ্রিক পাত মহাদেশীয় পাতের নিচে নেমে যাচ্ছে তাকে অধঃপাত মণ্ডল বা Subduction Zone বলে।
উদ্ভূত ভূমিরূপ :
ভঙ্গিল পর্বতমালা–মহাসাগরীয় পাত প্রান্তে সমুদ্রখাতের সৃষ্টি হয়। সমুদ্রখাতে পলি সঞ্চিত হয়। পাতের চলন আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে সমুদ্র খাতে সঞ্চিত পলিরাশিতে ভাঁজ পড়ে এবং ওই ভাঁজ বৃদ্ধি পেলে ভঙ্গিল পর্বতমালার সৃষ্টি হয় এবং সুনামি সৃষ্টির পরিবেশ সৃষ্টি করে যেহেতু সমুদ্রতলে পর্বত সৃষ্টি হয়েছে। তবে দীর্ঘকাল ধরে সৃষ্টি করলে সুনামির ভয় নেই।
এরই অনুগামী ঘটনা হিসেবে থাকে চ্যুতি ও ব্যাসল্ট এবং অ্যান্ডিসাইট জাতীয় লাভার নিঃসরণ হয় যা সুনামি সৃষ্টির আরেকটি পরিবেশ সৃষ্টি করে।
3. মহাসমুদ্র – মহাসমুদ্র অভিসারী পাত সীমান্ত :
যখন দুটি মহা সামুদ্রিক প্লেট পরস্পরমুখী হয় তখন সংঘর্ষের ফলে একটি অপরটির নিচে নিমজ্জিত হয়। এর ফলে ওই অংশ থেকে লাভা প্রবাহিত হয়ে ভূপৃষ্ঠের ওপরে বা নিচে সঞ্চিত হয়ে হয়ে আগ্নেয়দ্বীপশিলার উৎপত্তি ঘটে।
উদ্ভূত ভূমিরূপ :
আগ্নেয় দ্বীপমালা–যদি দুটি মহাসাগরীয় পাত পরস্পরের সম্মুখীন হয় তাহলে সামনাসামনি ধাক্কা বা সংঘর্ষের ফলে একটি অপরটির নিচে নিমজ্জিত হয় এবং নিমজ্জমান অংশ হতে লাভা প্রবাহিত হয়ে ভূপৃষ্ঠের ওপরে বা নিচে সঞ্চিত হয়ে সৃষ্টি হয়ে আগ্নেয় দ্বীপমালার। উদাহরণস্বরূপ : প্রশান্ত মহাসাগরের অ্যালুউশিয়াল দ্বীপপুঞ্জ এবং জাপান ও ফরমোসা দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সৃষ্ট দ্বীপমালা উল্লেখযোগ্য।
2। প্রতিসারী পাত সীমানা (Divergent Plate Boundary) :
যখন দুটি পাত স্থানচ্যুত হয়ে পরস্পরের বিপরীত দিকে দূরে চলে যায় তখন তাকে প্রতিসারী পাত সীমানা বলে। বৈজ্ঞানিকগণ পাতের এইরূপ চলনের কারণ হিসেবে ভূ-অভ্যন্তরস্থ পরিচলন স্রোতের (কনভেকশনাল কারেন্ট) কথা উল্লেখ করেছেন। পরিচলন স্রোত ঊর্ধ্বগামী হয়ে পাতকে চিত্রের মতো বিপরীত দিকে চালিত করে।
উদ্ভূত ভূমিরূপ :
শৈলসিরা–যখন দুটি সামুদ্রিক পাত স্থানচ্যুত হয়ে পরস্পরের বিপরীত দিকে সরে যেতে থাকে তখন তাদের সীমান্তে বিকর্ষণের চাপ অনেকাংশ হ্রাস পায়। চাপ হ্রাসের কারণে ঐ সময় ভূ-গর্ভস্থ পদার্থ তরল পদার্থে পরিনত হয়। ঐ সকল তরল পদার্থ (লাভা) বাইরে এসে পাতসীমার শূন্যস্থানে সঞ্চিত হয়ে থাকে। এভাবে ক্রমাগত লাভা নিঃসরন হয়ে সমুদ্রগর্ভে বিস্তীর্ন অঞ্চল লাভা দ্বারা আবৃত করে দেয় ও সমুদ্রগর্ভে কঠিন তলদেশ গঠন করে। দীর্ঘ দিন পাত সীমানায় লাভা সঞ্চিত হলে তা উঁচু হয়ে মহাসাগরীয় শৈলশিরা গঠন করে যা সুনামির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
সামুদ্রিক শৈলশিরা (submarine ridge):
গভীর সমুদ্রের তলদেশে অবস্থিত পর্বতশ্রেণীর মতো উঁচু, সুদীর্ঘ ও প্রশস্ত ভূ-ভাগকে সামুদ্রিক শৈলশিরা বলে। কয়েক কিলোমিটার প্রশস্ত ও সুদীর্ঘ শৈলশিরাগুলো পর্বতশ্রেণীর মতো সমুদ্র তলে অবস্থান করে।
3. সংরক্ষনশীল বা প্রতিগামী পাত সীমান্ত
(Transform Plate Boundary) :
অনেক সময় দুটি পাত পরস্পরের পাশাপাশি বিপরীত দিকে চলমান হয়। তখন এ পাতদ্বয় একে অপরের সঙ্গে বিনা সংঘর্ষে নিজেদের মধ্যে পাশাপাশি স্থান পরিবর্তন করে বিপরীত দিকে চলতে থাকে, এরকম পাত সীমানাকে সংরক্ষনশীল বা প্রতিগামী পাত সীমান্ত বা Transform Plate Boundary বলা হয়।
এই পাত সীমায় কোনো নতুন পাত সৃষ্টি হয় না আবার কোনো পাতের বা ভূ-ত্বকের ধ্বংস হয় না। কারণ পার্শ্ববর্তী পাতগুলির পরস্পর সংঘর্ষ এবং বিপরীতমুখী না হওয়ার জন্য এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তবে এরূপ চলনে দুই পাতের পাশাপাশি চলনে ঘর্ষণের ফলে ভূমি আলোড়িত হয়ে ভূমিকম্প সংঘটিত হতে দেখা যায় এবং তার ফলে সুনামি ঘটতে পারে।
অনেক সময় দুইয়ের অধিক প্লেটের মাঝে পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ হয়ে ভূমিকম্প হয়ে তারপর সুনামি হতে পারে।
সমুদ্রতলে উঁচু ভূমির উত্থান কীভাবে সুনামি সৃষ্টি করে ?
টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া ও ঘর্ষণের কারণে
সাগরতলের কোনো অংশ হঠাৎ উঁচু হয়ে যাওয়া এবং সমুদ্রতলের কোনো অংশ ভূমিকম্পের কারণে নিচু হয়ে গেলে সমুদ্রের সে স্থানের ওপরের ঢেউয়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
টেকটোনিক প্লেটগুলোর ধাক্কার কারণে
সমুদ্রতল কেঁপে উঠে সমুদ্রতলে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। এতে তার ওপরে থাকা জলরাশিও কেঁপে উঠে এবং নিচের উত্থিত সমুদ্রতলের ঊর্ধ্বমুখী ধাক্কায় ওপরের পানি আরও ওপরে উঠে যায়। যার ফলে চারপাশে নিচু জলীয় অংশ সৃষ্টি হয়। ফলে পানি সে নিচু হওয়া জলীয় স্তরকে সাম্যাবস্থায় আনতে উঁচু অংশের চারপাশে অগ্রসর হতে শুরু করে। পুকুরে ঢিল ফেললে যেভাবে ঢেউ সৃষ্টি হয় সেরকমভাবে ঢেউ চতুর্পাশে অগ্রসর হয়।
এভাবে অগ্রসর হতে হতে এক সময় তীরবর্তী শহর, বন্দর সবকিছু ভাসিয়ে দেয়।
স্বাভাবিকভাবেই আপনি যদি কোনো পুকুরে নেমে, সে পুকুরের মাঝখানে গিয়ে পুকুরের সে অংশটা কোনো উপায়ে উঁচু করে দেন তাহলে কি পুকুরের সে অংশের পানি আগের মতোই স্থির অবস্থানে থাকবে না কি ওই উঁচু করে দেওয়া স্থানের ওপরের পানি আরও উঁচু হবে ?
অবশ্যই আরও উঁচু হবে। শুধুই কি পানি উঁচু হয়ে বসে থাকবে না কি চারপাশের নিম্নবর্তী এলাকায় পানির প্রবাহ ছুটে যাবে ?
হ্যাঁ, পানি চারদিকেই ঢেউ আকারে ছুটে যাবে এবং ঢেউয়ের উচ্চতা যদি বেশ উঁচু হয়, তবে সে ঢেউ এমনকি পুকুরের পাড়েও কিছুটা উঠে যেয়ে পাড়কে ভিজিয়ে দিতে পারবে। এ জিনিসটাই সমুদ্রে ঘটে থাকে।
তবে এ সুনামির সাথে জোয়ার-ভাটাকে মিলাবেন না আবার। জোয়ার-ভাটা হয় চন্দ্র-সূর্যের আকর্ষণে আর সুনামি হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু কিছু কারণে। আর জোয়ার-ভাটার ঢেউয়ের তরঙ্গদৈর্ঘ্য এত দীর্ঘ হয় না। আর জোয়ার-ভাটা হওয়ার পেছনে সুনামির কোনো কারণ জড়িত নেই।
ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানীরা টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার পেছনে মেকানিজম নিয়ে এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। মত বিরোধ রয়েছে প্রচুর। তবে কিছু বিষয় যা ওপরে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো মোটামুটি বিজ্ঞান সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।
২। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত (Volcanic Eruption) দ্বারা সুনামি :
ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো ও ধ্বংসাত্মক সুনামিগুলোর নাম নিলে ২৬শে অক্টোবর, ১৮৮৩ এ ইন্দোনেশিয়ার সুনামিটার নাম সহজেই মনে পড়ে যাওয়ার কথা। এ সুনামিতে প্রায় ৩৬,৪১৭ জন লোক মারা গিয়েছিল। এ সুনামিতে ঢেউয়ের উচ্চতা সর্বোচ্চ ১৩৫ ফুট পর্যন্ত হয়েছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৯০ সালে গ্রিসের মিনোয়ান সভ্যতার ধ্বংসের পেছনেও Aegean সাগরে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতকেই সম্ভাব্য দায়ী বলে মনে করা হয়।
এক্ষেত্রে সমুদ্রতীরবর্তী বা সমুদ্রের কোনো দ্বীপে থাকা আগ্নেয়গিরিতে হঠাৎ অগ্ন্যুৎপাতের ফলে এমনটা ঘটতে পারে।
এ পর্যন্ত প্রায় ১১০টি ছোটো-বড়ো সুনামি এ কারণেই ঘটেছে।
অনেক কারণেই আগ্নেয়গিরির উদগিরণ ঘটতে পারে। আর সে উদগিরণের মাত্রা যদি প্রবল মাত্রায় হয় এবং লাভার স্রোত যদি সমুদ্রতলে জমা হয় তবে সমুদ্রের সেখানে ম্যাগমা এসে জমা হয়ে উঁচু আগ্নেয় ভূমিরূপ সৃষ্টি করবে। আর সে ভূমিস্তর যদি যথেষ্ট উঁচু হয়ে যায় তবে সেখানে থাকা সমুদ্রের পানি (overlaying water) ভূমিকম্পের মতো আলোড়িত হয়ে সুনামি সৃষ্টি করবে।
কখনো কখনো সমুদ্র তীরবর্তী বা দ্বীপের আগ্নেয় পাহাড়-পর্বতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত সৃষ্টি হয়ে ভূগর্ভ থেকে উঠে আসা ম্যাগমা নিকটবর্তী সমুদ্রের ওপরে ভেসে যায়। তারপর সমুদ্রের পানিতে নেমে সেখানে সেসব ম্যাগমা ঠান্ডা হয়ে সমুদ্রতলে নতুন ভূমি গঠন করে সমুদ্রতলের উচ্চতা হঠাৎ করে অনেক উঁচু করে দেয়।
অথবা সমুদ্রতলে প্লেটগুলোর ফাটল দিয়ে মাঝেমাঝে ম্যাগমা ভূগর্ভ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং সমুদ্রতলে সেসব ম্যাগমা জমা হয়।
সেখানে যথেষ্ট ম্যাগমা জমে গেলে নতুন উঁচু ভূমি বা শৈলশিরা সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে সমুদ্রের সেখানের পানির ওপর তার প্রভাব দৃশ্যমান হয়। সেখানের ঢেউ ভূমিকম্পের সময়ের মতো উঁচু হয়ে সমুদ্রে সুনামি পরিস্খিতি সৃষ্টি করতে পারে।
ভূমিকম্পের সময় সমুদ্রতল উঁচু হয়ে যেভাবে সুনামি সৃষ্টি করে, সেভাবে আগ্নেয়গিরির উদগিরণেও ভূমিকম্পে সুনামি সৃষ্টি হতে পারে।
তাছাড়া প্রতিসারী পাত সীমানায় (Divergent Plate Boundary) দুটো প্লেটের বিপরীতমুখী চলনে দুটি প্লেটের মাঝে ফাঁকা স্থান সৃষ্টি হয়। প্লেট দুটোর মাঝে ঘনত্ব কমে যায় বা মাঝখানের সে অংশের ক্রাস্ট ছিদ্র হয়ে ভূগর্ভ থেকে ম্যাগমার উদগিরণ ঘটাতে পারে এবং সেখানে ম্যাগমা জমে উঁচু হয়ে সেখানকার জলীয় অংশে আন্দোলন সৃষ্টি করে সুনামি সংঘটন করতে পারে।
৩। ভূমিধ্বস (Landslide) :
কোনো কারণে সমুদ্র তীরবর্তী বা দ্বীপের পাহাড়-পর্বত হতে বৃহৎ শিলাখণ্ড নিকটবর্তী সমুদ্রের ওপর ধসে পড়ে সুনামি পরিস্খিতি সৃষ্টি করে। সাধারণত ভাঁজ পর্বতের নিকট অধিক ভূমিকম্প
হয়।
তাছাড়া অনেক সময় সমুদ্রতলের বিশাল এলাকার ভূমিস্তর আলগা হয়ে যায় এবং কখনো হালকা কোনো ভূকম্পনে সেখানের সে সমুদ্রতল ধ্বসে যায় যা সমুদ্রের উপরিতলের পানিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং সে আলোড়ন যথেষ্ট বেশি হলে তা সুনামির পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
৪। হিমবাহের প্রভাবে :
কখনো কখনো প্রকাণ্ড হিমবাহ পর্বতগাত্র হতে হঠাৎ নিচের সমুদ্রে পতিত হয়। এতে সাগরজলে সুনামির পরিস্খিতি সৃষ্টি হতে পারে।
৫। উল্কাপাত (Meteorites) দ্বারা সুনামি:
কখনো যদি কোনো সমুদ্রে বা জলরাশির ওপর উল্কা পতিত হয় তাহলে সেটা ভূমিকম্পের মতোই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। উল্কাটা যথেষ্ট বড়ো হলে মুহূর্তের মাঝেই তা সাগরে সুনামি সৃষ্টি করতে যথেষ্ট। এক্ষেত্রে উল্কার কারণে সাগর জলের আলোড়নই সুনামি সৃষ্টির মূল কারণ।
সুনামির ঢেউ :
সাগরতল কিন্তু সর্বত্র সমান নয়। তীর থেকে যতই নিচে নামবেন ততই এর গভীরতা বৃদ্ধি পাবে।
সুনামি যখন গভীর সমুদ্র থেকে তীরমুখী হয়ে এগিয়ে যায় তখন তীরের দিকে সমুদ্রের তলে পৃথিবীর পৃষ্ঠ ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে যাওয়ায় সুনামি তীরের দিকে এগিয়ে আসতে গিয়ে ক্রমান্বয়ে উঁচু হয়ে যাওয়া পৃৃথিবীর সমুদ্রতলের ভূস্তর দ্বারা এর গতি বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে সুনামির গতি ধীরে ধীরে কমে যায়, কিন্তু সে সমুদ্রতলের সাথে ধাক্কা খেয়ে সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতা আরও বেড়ে যায়। কারণ সমুদ্রের গভীর দিয়ে প্রবাহিত ঢেউ যখন সমুদ্রতলের বাধার কারণে সামনে এগিয়ে যেতে বাধার মুখোমুখি হয়, তখন সে গভীর জলের ঢেউগুলো ওপরের পানিকে আরও ওপরে ধাক্কা দেয় যাতে সে গভীর ঢেউগুলোর সম্মুখমুখী রাস্তায় প্রবাহিত হওয়াটা সহজ হয়। এর ফলে ওপরের ঢেউ আরও ওপরে যেয়ে সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতা বাড়িয়ে দেয় এবং আরও ধ্বংসাত্মক রূপে পরিণত হয়।
তার মানে, সুনামি তীরের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে সুনামির শক্তি ধীরে ধীরে কমে কিন্তু উচ্চতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তাছাড়া ঢেউয়ের তরঙ্গদৈর্ঘ্যও হ্রাস পায়।
সুনামি যে সবর্দা বিশাল ঢেউ হয়ে আসে এমনটাও ঠিক নয়। কখনো কখনো এমনও হতে পারে, সমুদ্রের গভীরে থাকাকালীন সুনামির ঢেউটি জাহাজের নিচ দিয়ে চলে গেছে অথচ টেরই পাওয়া যায়নি। এর মূল কারণ হলো সমুদ্রের নিচ অনেক গভীর হয়ে থাকে এবং ফুলে উঠা পানি সুনামি হওয়ার মতো ভয়ংকর পরিবেশ হওয়ার আগেই সহজেই স্থিতাবস্থায় আসার মতো তল পেয়ে গেছে হয়তো।
এভাবে সুনামি সৃষ্টি হয়। আর কিছু সুনামি আমাদের জন্য নিয়ে আসে অবর্ণনীয় ভয়ংকর পরিস্থিতি।
এ ধরনের আকস্মিক সুনামিতে উপকূলীয় অঞ্চলে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে।
মেগাথ্রাস্ট ভূমিকম্প ও সুনামি :
২০০৪ সালের ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ। এদিন ইন্দোনেশিয়ার উত্তরাঞ্চলের দ্বীপ সুমাত্রার আচেহতে আঘাত হানে ৯ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প মেগাথ্রাস্ট । এর পরপরই সৃষ্টি হয় ভয়াবহ সুনামি যা সোমালিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
সুনামিটি ভারত মহাসাগরের অনেক দেশেই আঘাত হানে। কেবল ইন্দোনেশিয়াতেই ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়। নিহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল আচেহ প্রদেশে। এ সুনামিতে বিভিন্ন দেশের আরও প্রায় ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। সব মিলিয়ে আনুমানিক মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে যায় প্রায় (উইকিপিডিয়া মতে ২ লাখ ২৭ হাজার ৮৯৮ জন)। এটাকে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়।
তথ্যসূত্র :
[1]https://en.wikipedia.org/wiki/Tsunami
[2] https://www.worldatlas.com/articles/how-do-tectonic-plates-move.html
[3]
[4]
[5]
http://volcano.oregonstate.edu/tsunamis
[6]
[7]
https://nctr.pmel.noaa.gov/faq_display.php?kw=16%20April%202010%20Interview%20with%20Marie%20Eble
লেখক: আবু রায়হান
ব্যাঙের ছাতা বিজ্ঞান
ধন্যবাদ অজস্র
উত্তরমুছুন