লেখক: মনিফ শাহ চৌধুরী
(১)
আমার বাবার দুটো ফসলি জমি ছিল, আর হালচাষের জন্য চারটা ষাঁড়। তিনি পেশায় একজন কৃষক।
আমার নাম অভি। আমি পেশায় একজন নভোচারী। বোটানিতে ডিগ্রী নিয়ে নাসায় হালের বলদের মত হাড়ভাঙা ট্রেনিং নিয়ে নভোচারী হবার পথে বাবা তার সেই শেষ সম্বলগুলোও বিকিয়ে দেন। চাষার ছেলেকে চাষাই হতে হবে এমন কথায় কান দেননি কখনোই। তার এই অপরিশোধয় আত্নত্যাগের সুবাদে আজ আমি International Space Station (ISS) এ গবেষণা করার সোনালী সুযোগ পেয়েছি। আমার কাজ?
চাষ করা।
জ্বী, ঠিকই শুনেছেন। যতই রাঙিয়ে-চাঙিয়ে, নাক উচু করে বলি যে আমি স্পেস স্টেশনে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে উদ্ভিদের ওপর নানান ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাই এবং কী করে তাদের মাঝে জিনগত পরিবর্তন এনে তাদের টিকে থাকা আরো নিশ্চিত করা যায় স্পেসশিপ বা মঙ্গলের মাটিতে, তাই নিয়ে গবেষণায় মজে থাকি, তাও এ সত্য এড়ানো যাবে না যে আমি সাদা স্পেসস্যুট পরিহিত বোটানিক্যাল ডিগ্রীধারী একজন চাষা।
ভ্রূ কুচকান কেন? ডিগ্রী আছে, নাসায় নিয়েছে মানে আমার মাঝে কিছুটা হলেও মকরন্দ আছে তো, নাকি? আচ্ছা, আপনাকে আমার ভার বুঝানোর জন্য আমার চাষবাস নিয়ে বকবক করব কিছুক্ষন, ঠিক আছে?
প্রথমেই শুরু করি স্পেস ফার্মিং বা মহাকাশে চাষ কী। মুলত, মহাকাশের প্রতিকূল পরিবেশে গাছপালা তেমন ভাল জন্মে না। রেডিয়েশন বেশি, তাপ অনেক কম, মাইক্রোগ্র্যাভিটি ইত্যাদি আরো নানান কারণে গাছপালা তেমন সুবিধা করতে পারে না। তবে কিছু গাছ আছে ব্যতিক্রম। তাদের সহ্যক্ষমতা বেশি। কোন গাছের সহ্যশক্তি কত ভাল, বা কীভাবে তাদের আরো উন্নত করা যাবে এগুলো নিয়ে কাজ করাই হল স্পেস ফার্মিং।
স্পেস ফার্মিং এর প্রয়োজনীয়তা কী? অন্যভাবে বললে কেন মহাকাশে গাছ জন্মাতে হবে আমাদের? এর কারণ বেশ কয়েকটা। আপনারা জানেন কি, স্পেস স্টেশনে কত জিনিস রিসাইকেল করতে হয়? বা কত কিছু তৈরী করতে হয়? যেমন পানি। পানি থাকে সীমিত, তাই খুব বেশি খরচ করা যায় না। পানি রিসাইকেল করতে হয়। প্রসাব, ঘাম আর অন্যান্য ময়লা পানি মেশিনে ফিল্টার করে আবার ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হয়। সেই ফিল্টার করা পানি পান করা হয়, খাবার ভেজানো হয় বা অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়। এরপর প্রসাব, ঘাম তৈরী হলে আবার রিসাইকেল কর, আবার ব্যবহার কর। যতই নাক সিটকান, এই পানি পৃথিবীর অধিকাংশ সুপেয় পানি থেকেও পরিষ্কার আর জীবাণুমুক্ত।
এরপর আসে প্রাণবায়ু অক্সিজেন। অক্সিজেন তৈরী করতে হয় কষ্ট করে। স্পেস স্টেশনের বিশাল সোলার সেলগুলো থেকে পাওয়া ইলেক্ট্রিসিটি দিয়ে পানিতে থাকা হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনকে আলাদা করতে হয়। কেমিস্ট্রিতে পড়ে থাকবেন, এটাকে ইলেক্ট্রোলাইসিস বলা হয়। অক্সিজেন নাক দিয়ে টেনে নেয়া হয়। আর হাইড্রোজেন ভাবছেন কী হয়? ওটা ব্যবহার হয় চিনি তৈরীতে। যদিও এটা প্রচন্ড দাহ্য হওয়ার কারণে বেশিরভাগ সময়ই বাইরে বের করে দেয়া হয়।
এরপর আসে যেই বদ্ধ জায়গায় আপনি কাজ করছেন সেটার বাতাস পরিষ্কার করার বিষয়টা। আপনি অক্সিজেন নিয়ে যেই কার্বন ডাইঅক্সাইড ছেড়ে দেন সেটা জমতে জমতে বাতাস বিষাক্ত হয়ে যায়। তাই সেই কার্বন ডাইঅক্সাইডকে শুষে নিতে হয় সিলিকা জেল দিয়ে। এরপর সেগুলোকে ফেলে দেয়া হয়।
ভবিষ্যতে হাইড্রোজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডকে বিক্রিয়া করে মিথেন তৈরী করার জন্য মডেল তৈরী করা হয়েছে।
এরপর চিন্তা করেন আপনার মলের কথা। সেগুলো থেকে রেহাই পেতে হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, মল তৈরী করার জন্য যে খাবার খাবেন সেটাও তো এত সুস্বাদু নয়। তাদের টিউব টিপে টিপে পেস্ট করা খাবার খেতে হয় যেটাও সীমিত।
মোটামুটি এইসব হল বিভিন্ন ব্যাপার যেগুলো স্পেস স্টেশনের সামলাতে হয়। এখন ভাবুন তো, পৃথিবীতে এগুলো নিয়ে ভাবতে হয় না কেন আমাদের? কারণ পৃথিবীতে গাছপালা আছে। গাছপালা এই সবকিছু ব্যাপার সামাল দেয়। খাবার তৈরী করে, বর্জ্য কাজে লাগাতে পারে, কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিতে পারে এমনকি অক্সিজেনও তৈরী করে। তাই সেই গাছ যদি স্পেস স্টেশনে ফলানো যায় তাহলে উপরের সব বিষয়গুলো সহজেই সামাল দেয়া যাবে। খরচ অনেক কমে যাবে। এমনকি ক্রুসমেত দূরপাল্লার নভোযাত্রাও সম্ভব হয়ে যাবে।
একটা ছোট্ট বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। একটা বদ্ধ ঘরে কাজ করতে ভাল লাগবে আপনার? কেমন হত যদি গাছগাছালির মাঝে কাজ করতে পারতেন? কেমন প্রশান্তিদায়ক না ব্যাপারটা? আমাদের নভোচারীদেরও প্রচুর ধকলের মাঝে কাজ করতে হয়। অনেক মানসিক চাপ থাকে। এমন জায়গাটা যদি সবুজ-শ্যামল দৃশ্যে ঘেরা থাকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য কতই না ভাল থাকবে চিন্তা করুন।
এখন আশা করি স্পেস ফার্মিং এর গুরুত্ব কিছুটা হলেও বোঝাতে পেরেছি আপনাকে। কী? ভেবেছেন বকবকানি শেষ? হাহা। সূচনা শেষ। এবার বিস্তারিত।
(২)
এবার আমরা কথা বলব কী কী প্রতিবন্ধকতা আছে স্পেসে চাষ করতে গিয়ে।
প্রথমেই আসে মাইক্রো গ্র্যাভিটির কথা। প্রায় ওজনশূন্য পরিবেশে চাষ করাটা মোটেও সহজ নয়। গাছের বিচি থেকে অংকুর গজাতে দেখেছেন কখনো? অনেক চক্ষুশীতল দৃশ্য। খেয়াল করবেন অংকুর সবসময় ওপরের দিকে ওঠে আর মুল বা শেকড়ের মত অংশটা সবসময় নিচের দিকে। গাছের নানা ক্ষমতার মাঝে আছে মাধ্যাকর্ষণ সনাক্ত করা। এটাকে Geotropism বলে। মহাকাশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাধ্যাকর্ষণের কারণে অংকুর আর মূল কোনদিকে গজাবে তা বুঝতে পারে না। আবার পানি আর মাটিকেও একসাথে রাখলে সমানভাবে ছড়িয়ে যায় তাই বাতাসের প্রবাহ ঠিকমতো হয় না। গাছের শেকড় অক্সিজেন পায় না।
আবার আলোর সাপ্লাই দিতে হয়। কারণ সরাসরি সূর্যের আলো দিলে বেচারারা ওখানেই রেডিয়েশনের কারনে মারা পড়বে। তাই LED দিয়ে আলো সাপ্লাই দিতে হয়।
তাদের স্পেশাল গ্রোথ চেম্বারে চাষ করা হয় যেখানে তাপ, আলো ইত্যাদি বিষয় কন্ট্রোল করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু নির্দিষ্ট ওয়েভলেংথের আলো গাছের পাতা বেশি শোষণ করে। যেমন, লাল আর নীলের সংমিশ্রণের মভ আলো।
স্পেস স্টেশনে জায়গাও অল্প। এত অল্প জায়গায় গাছ চাষ করে যথেষ্ট খাবার উৎপাদন সম্ভব না। এরজন্য প্রয়োজন অনেক জায়গা।
গাছের সব অংশ খাওয়ার উপযোগীও না। সেসব অংশ ঘাসফড়িংদের খাওয়ানো যেতে পারে। এতে তারা জৈব সার উৎপাদন করতে পারবে আর চাইলে তাদেরও প্রোটিনের উৎস হিসেবে খাওয়াও যাবে। আর দূরপাল্লার যাত্রার ক্ষেত্রে সিল্কওয়ার্মের তৈরী সিল্ক দিয়ে দড়ি ও কাপড় তৈরী করা সম্ভব। জ্বী, এগুলোও স্পেস ফার্মিং এর অংশ।
একমিনিট। ভাবছেন কবে কী না মানুষ সাইফাই সিনেমার মত দূরপাল্লার মহাকাশ যাত্রা করবে তখন এসব কাজে লাগবে, তা এখন এগুলো কি উপকারে লাগবে? লাগবে লাগবে। বলছি, শুনুন।
(৩)
পৃথিবীতে চাষযোগ্য জমি কম এটা জানেন? জানবেন কীভাবে? থাকেন তো চাষোপযোগী দেশগুলোর মাঝে অন্যতম একটায়। আর এদিকে খাবার চাওয়ার মুখ যে দিনকে দিন বেড়েই চলছে সে হিসেব রাখছেন?
পৃথিবীতে ভার্টিক্যাল ফার্মিং শুরু করলে অনেক দক্ষতার সাথে জমির ব্যবহার করা যাবে। বহুতল বিশিষ্ট গ্রীনহাউজ। এখানে স্পেস ফার্মিং এর বিভিন্ন ব্যাপার কাজে লাগানো যাবে। যেমন আলোর ব্যাপারটাই ধরেন। মনে আছে বলেছিলাম যে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন নির্দিষ্ট ওয়েভলেংথের আলো গাছের জন্য বেশি উপযোগী? সেই আলো ব্যবহার করা যেতে পারে। কীভাবে অল্প পানি ব্যবহার করা যায় এবং অপচয় বাচানো যায় সেই জ্ঞানও কাজে লাগানো যাবে। আরো বেশী করে ফলন হবে, উৎপাদন বাড়বে।
কীংবা মনে আছে স্পেসে বাতাস পরিষ্কার করার কথা বলেছিলাম? ওয়েল বাতাসে ethylene নামের এক কেমিক্যালের উপস্থিতি ফল তাড়াতাড়ি পাকিয়ে ফেলে এবং তাড়াতাড়ি পচিয়েও ফেলে। এটা বেশ বড় সমস্যা স্পেস ফার্মিং এর। তবে এর সমাধান সেই ১৯৯০ এর দিকেই হয়ে গেছে। Wisconsin Center for Space Automation and Robotics এর সাথে নাসার একটা প্রজেক্টে তারা বাতাস থেকে ethylene শুষে নেয়ার জন্য একটা মডেল প্রস্তুত করে এবং সেটা বেশ ভালোই কাজ করে।
তবে আশ্চর্যের সাথে আবিষ্কার হয় যে এই মডেলটা অত্যন্ত সাফল্যের সাথে বিভিন্ন বায়ুবাহিত ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, ফাংগাস, মাইকোটক্সিন ইত্যাদিও সরিয়ে ফেলতে পারে উচ্চ দক্ষতার সাথে। এই টেকনোলজি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন সুপারমার্কেট, স্টোরেজ হাউজে, রেস্টুরেন্টে ও খাবার তৈরীর ফ্যাক্টরিতে যাতে খাবার ও ফলফলাদি তাড়াতাড়ি পচে না যায়।
এছাড়াও বিভিন্ন হাসপাতালে, ক্লিনিকে, স্কুলেও এটা ব্যবহার করা হচ্ছে রোগ জীবাণুর বিস্তার কমানোর জন্য। দেখলেন তো? কত উপকারে লাগছে স্পেস ফার্মিং।
স্পেস ফার্মিং করতে যেয়ে সারাক্ষণ গাছের ওপর চোখ সেটে রাখাটাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই গাছের কখন পিপাসা পেয়েছে তা গাছ আমাকে নিজেই টেক্সট করে পাঠিয়ে দেয়। অবাক হলেন?
AgriHouse ও BioServe দুটো কম্পানি একত্রে তৈরী করেছেন এমন কিছু সেন্সর যা গাছের পাতার পুরুত্ব মেপে বুঝতে পারে পাতাতে পানি কতখানি আছে। পানি কম মনে হলে সেন্সর সেই ডাটা নিয়ে আমার কম্পিউটারে পাঠিয়ে দেয়। আমি তখন তাদের পানি দেই।
এই বিষয়টা কাজে লাগিয়ে স্বয়ংক্রিয় কোনো সিস্টেমের সাথে জুড়ে দিলে পৃথিবীতে ভার্টিকেল ফার্মে পানির অপচয় একেবারেই কমে আসবে। পানি শুধু তখনই দেয়া হবে যখন প্রয়োজন।
(৪)
তো বুঝতে পারলেন স্পেস ফার্মিং কী জিনিস? এসব বিষয়ে গবেষণা বাড়লে নিজ গ্রহ ছাড়িয়ে মঙ্গলেও আমরা বসতি স্থাপন করতে পারব, পৃথিবীর বাড়তে থাকা মুখে খাবার যোগাতে পারব। নিজ সৌরজগৎ পেরিয়ে যাত্রা করতে হলে স্পেস ফার্মিং এর বিকল্প নেই। তাই চাষাদের সম্মান দিন। সাদা স্যুট পরিহিত চাষাদের যেমন, তেমনই কোমরে গামছা প্যাচানো ঘর্মাক্তদেরও।
"আমার দেশের সকল চাষা
সােনার চেয়েও খাঁটি
মায়ের মত আগলে রাখে
ফসল ফলার মাটি।।
নতুন ধানের গন্ধ পেতে করে আবাদ চাষ
একটু সুখের আশায় তারা খাটছে বারাে মাস।
অনেক দামেও যায় না কেনা
চাষার গায়ের ঘাম
সােনার ফসল ফলেও তারা
নেয় না ঘামের দাম।
এত খাটা খেটেও জোটে পান্তা ভাতের জল।
তবুও যে হারায় না ভাই তাদের মনােবল।"
--আমার দেশের চাষা
-- মোহাঃ মাজেদ হোসেন
(সমাপ্ত)
রেফারেন্স লিংকঃ
1. স্পেসে ফার্মিং এর যত সমস্যা
2. আরেকটা
4. আরেকটা লিংক
5. জার্নাল
6. স্পেস ফার্মিং এ পৃথিবীর লাভ কী
7. স্পেস ফার্মিংকে পৃথিবীতে কাজে লাগানো যাবে
8. ISS এ কীভাবে ময়লা পানি রিসাইকেল করে দেখুন
লেখক: মনিফ শাহ চৌধুরী
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান
জোস...
উত্তরমুছুনআহা, এডমিন সাহেব নিজেই বলেন “জোশ”
মুছুনবলতে হবে “লেখাটা জোশ ছিলো” :p
দারুন ❤️❤️
উত্তরমুছুন