লেখকঃ শাহরিয়ার হোসাইন ঠেসুন
বাসায় যখন ছোট্ট সোনামণি-বাবুটা আসে তখন কতই না আদর করা করা হয়।আদরে আদরে আদরিত হয়ে যায় সবায়।বিচিত্র সব শব্দের মাধ্যমে আদর প্রকাশ করা হয়। এই যেমন ধরেনঃকুডুকুডু ছোণামণিটা, ওলেলেলে আমার বাবুটা (এইটা মনে হয় অন্য কিছুতেও ইউজ করা হয়:)।
ত যখন বাবুটা একটু বড় হয় তখন আদর এর সাথে আরেকটা জিনিস ও যোগ হয়,একটু একটু
সুড়সুড়ি দেওয়া..... বগলে, ঘাড়ে,পেটে বা কারো কারো ত পীঠেও হয়।কিন্তু কেন!!!!!!
কেনই বা হাতের আঙুল দিয়ে স্পর্শ করলেই শরীরে এমন অনুভুতি হয়!!!
কেনই বা আপনার হাসি পায়!!হাসিতে হাসিতে মাঝে মাঝে কাশিত ও হয়ে যায় অনেকে..কেন!!!
আবার সুরসুড়ি জিনিস টা বড়ই পাজি!!
আপনি করলে হবে না।আপনাকে তার পছন্দ না,আপনার আঙুল গুলো তার পছন্দ না, তার পছন্দ অন্যের স্পর্শ....ব্যাটা পাজি কোথাকার!!!কে রে তুই সুরসুরি না তুরতুরি!! যা ভাগ!!
যাই হোক,যদি কারো শরীরের কোনো অংশে হালকাভাবে স্পর্শ করলে (সাধারণত বগলে,ঘাড়ে,পেটে,বা কখনো কখনো পায়ে....মূলত ত্বকের বিভিন্ন অংশে)
যদি অনিচ্ছাকৃত ভাবে সে ব্যাক্তি ঝাঁকুনি খায়,বা হাসিতে ফেটে পড়ে বা হাসির অনুভুতি সৃষ্টি হয় তখন তাকে বলা হয় সুড়সুড়ি।
সুড়সুড়ি শব্দটার ইংরেজী শব্দ "Tickle"।"Tickle" শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে মধ্য ইংরেজী সময়কার (1150 থেকে 1500) "Tikelen" শব্দ থেকে।
সুড়সুড়িকে দুইভাগে ভাগ করা হয়।১৮৯৭ সালে দুজন সাইকোলজিস্ট Granville Stanley Hall এবং Arthur Allin সুড়সুড়িকে দুইভাগে ভাগ করেন।
১.নিসমেসিস(knismesis) ও ২.গারগালেসিস(gargalesis)
১.নিসমেসিস(Knismesis):
নিসমেসিস শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ নিসমস{Knismos(κνησμός)} যার অর্থ চুলকানো।নিসমেসিসে সাধারণত তেমন হাসি বা ঝাকুনির অনুভুতি জাগায় না।শুধুমাত্র আপনার শরীর নিশপিশ করার মত অনুভুতি সৃষ্টি করতে পারে।শরীরের সংবেদী অংশগুলোতে খুবই হালকা উদ্দীপনার মাধ্যমে এই নিসমেসিস হয়।
মনে করুন আপনার পীঠে কোনো পোকা বা পরজীবী হাটছে।তখনো আপনার নিসমেসিস হতে পারে।এছাড়াও সুড়সুড়ির দেওয়ার স্থানে খুবই হালকা ঘর্ষণ লাগাতে হতে পারে নিসমেসিস সুড়সুড়ি।
আরে আরে দেখেন পোকাটা যেন আবার কামড় না দেয়!!!
বিভিন্ন ধরনের প্রাণির মধ্যেও নিসমেসিস একই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।যেমনঃশার্ক ।শার্কদের স্নাউট বা তুন্ডের(কোনো প্রাণির নাক, মুখ এবং চোয়াল সমন্বিত মুখের বর্ধিত অংশ হলো তুন্ড। ) নিচে সুড়সুড়ি দেওয়া যায়।
এবার আসা যাক গারগালেসিস এর কথায়,
২.গারগালেসিস(Gargalesis):
গারগালেসি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ গারগালিজো { gargalizo (γαργαλίζω)}থেকে যার অর্থ সুড়সুড়ি দেওয়া।কাউকে সুড়সুড়ি দিয়ে অনেক হাসানো বা উক্ত ব্যাক্তি যদি অনিচ্ছাকৃত ভাবে ঝাকুনি খায় তখন তাকে বলা হয় গারগালেসিস।
গারগালেসিস সুড়সুড়ি প্রাইমেটদের হয়
এবং সম্ভবত অন্য প্রজাতিদের উপরও হয়।যেমন:ইঁদুর দের।যদি কটনবাড দিয়ে ইঁদুরের পেটে আলতো ছোয়া দেন তাহলে তারা সুড়সুড়িত হবে ইয়ে মানে হাসবে যাকে বলা হয় গিগল(giggle)।কিন্তু তা হয় 50কিলোহার্টজ এর ।তাই আমরা তা শুনতে পাইনা।কিন্তু গোরিলার হাসার কথা ত সবাই জানি।গোরিলাকে সুড়সুড়ি দিলে সে মানুষের মতোই হাসে।
বিশ্বাস হয়না?চেষ্টা করে দেখতে পারেন
হাইপারগারগালেস্থিয়া(Hypergargalesthesia) হল সুড়সুড়ির চরম উদ্দীপনা।
কিন্তু সুড়সুড়ি কীভাবে কাজ করে?কেনই বা আমরা হাসি সুড়সুড়ি দিলে?
যখন কেউ আমাদের বগলে অথবা গলায় অথবা পায়ের নিচে স্পর্শ করে তখন ত্বকের উপরের অংশ বা এপিডার্মিস মস্তিষ্কে ইলেক্ট্রিক সিগন্যাল পাঠায়।আর যখন কেউ আমাদের সুড়সুড়ি দেয় তখন সোমাটোসেনসোরি কর্টেক্স( somatosensory cortex) সেই সিগন্যাল বহন করে নিয়ে যায় সাথে অগ্র সিনগোলেট করটেক্স(anterior cingulate cortex) ও এই সিগন্যাল এনালাইস করে।মস্তিষ্কের এই অংশ আরামদায়ক অনুভুতি সৃষ্টি করে।
জীববিজ্ঞানী এবং স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মনে করেন সুড়সুড়ি দিলে আমরা হাসি কারণ স্পর্শের সিগন্যাল থেকে মস্তিষ্কের হাইপোথেলামাস আমারদের হাসার অনুভুতি সৃষ্টি করে এবং একই অংশ আমাদের ব্যাথার অনুভুতিও সৃষ্টি করে তখন।
আচ্ছা,এসব ত বুঝা গেল কিন্তু যখন আমরা নিজেরাই নিজেদের সুড়সুড়ি দেই তখন কেন আমাদের সাথে বেইমানী করে এই সুড়সুড়ি!ইয়ে মানে তখন কেন সুড়সুড়ি হয়না?
যখন আপনি নিজে নিজেকে সুড়সুড়ি দিতে যান তখন আপনার মস্তিষ্কের সেরিবেলাম আপনাকে আগেই বলে দেয় যে আপনি এখন নিজেকে নিজেই সুড়সুড়ি দিবেন।তাই আপনার মস্তিষ্ক আপনার অতি মূল্যবান সময় এই সিগন্যাল গুলো গ্রহণ করে নষ্ট করতে চায়না।আর তাই আপনি নিজেকে নিজে সুড়সুড়ি দিলে তা হয়না।
অনেক ত শুনলাম।কিন্তু সুড়সুড়ির কি কোনো উপকারিতা আছে নাকি?
সুড়সুড়ির অনেক উপকারিতা রয়েছে।সুড়সুড়ি আপনাকে করতে পারে স্লিম! কারণ সুড়সুড়ির ফলে মানুষ হাসে।আর যার ফলে ক্যালরি বার্ণ হয়।ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব অবেসিটি(International journal of obesity) জানায় যে ১০-১৫ মিনিটের হাসিতে একদিনে ১০-৪০ ক্যালরি বার্ন হয় যা বছরে এক থেকে ৪ পাউন্ড হতে পারে।
সম্পর্ক গঠনেও সুড়সুড়ির ভূমিকা আছে।চার্লস ডারউইন লিখে গিয়েছিলেন যে সামাজিক বন্ধন সৃষ্টিতে সুড়সুড়ি একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
সুড়সুড়ি স্ট্রেস হরমোন{করটিসল (cortisol)} নিঃসরণ কমায়।কারণ সুড়সুড়ির ফলে হাসি হয়।ফলে তখন এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসরণ হয় যা স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ কমায়।একই সাথে মানবদেহে শ্বেত রক্তকণিকা বৃদ্ধি হয় যা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
সুড়সুড়ির ফলে সৃষ্ট হাসি আপনার মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে,আর রাগ কমায়।তাই আপনার রাগান্বিত বন্ধুকে এখনি সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু করুন।তবে বেশি দিবেন নাহ😁।
হাসলে মন আর শরীর দুটোই ভালো থাকে।এছাড়াও সুড়সুড়ির আরো বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে।
যাক ভালোই ত উপকারিতা আছে।অপকারিতা আছে কী?🤔🤔
সুড়সুড়ির ফলে অপকারিতা ও কম নয়।
বাচ্চাদের সুড়সুড়ি দিলে আমাদের মনে হয় তারা সেটাতে অনেক আনন্দ পাচ্ছে।তাই আরো বেশি করে দেই।কিন্তু এটা ঠিক না।বাচ্চাদের সুড়সুড়ি দিলে ব্রেইনের সিগন্যাল দেওয়ায় তারা হাসে।কিন্তু এটা যে সবসময় তারা উপভোগ করে তা নয়।কারণ তখন তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।হাসার ফলে তারা বলতেও পারে না যে এখন "সুড়সুড়ি দেওয়া বন্ধ কর!!"
হতে পারে বেদনা দায়ক ও।
শুনে অবাক হতে পারেন,
টর্চার করার জন্য ও সুড়সুড়ি দেওয়া হয়!!!
চায়নার হান রাজবংশের সময় তখন কার অপরাধীদের টর্চার করার একটা মাধ্যম ছিল সুড়সুড়ি দেওয়া।
জাপানেও অনেক জনপ্রিয় ছিল এই সুড়সুড়ি নামক টর্চার যার জন্য আলাদা একটা নাম ও দেওয়া হয়ঃমার্সিলেস টিকলিং বা সুড়সুড়ি{Merciless tickling (kusuguri-zeme)}।
হাইপারগারগালেস্থিয়া(Hypergargalesthesia) এর ফলে অক্সিজেন গ্রহনে ব্যাঘাত ঘটে।যার ফলে অনেক সময় বমি এমন কি ব্যাক্তি অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
অপরাধীদের ত রিমান্ডে নিয়ে কতভাবেই না টর্চার করা হয়(যদিও আমার এমন কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই)।কিন্তু সুড়সুড়ি দেওয়া অপরাধীদের টর্চার করার একটা মাধ্যম যেটা অনেক দেশেই অবলম্বন করা হয়।
এমনকি সুড়সুড়ি দেওয়ার ফলে ব্যাক্তি মরেও যেতে পারে।অনেক্ষণ ধরে সুড়সুড়ি দিলে ব্যাক্তি হার্ট এট্যাক(heart attack) এ ও মারা যেতে পারে।
আপনাকে যদি একটা চেয়ারে বসিয়ে টানা কয়েকঘন্টা হাইপারগারগালেস্থিয়া টাইপের সুড়সুড়ি দেওয়া হয় তাহলে আপনার হয়ত একটা কথাই মনে হতে পারেঃএর চেয়ে আর বেশি নির্যাতন করার উপায় হয়ত আর নেই!!!!
তাই যদি আপনার আশেপাশে এমন কোনো ব্যাক্তি থেকে থাকে যে আপনাকে মারাত্মক রকমের সুড়সুড়ি দিতে থাকে যখন খুশি তখনি তাহলে তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।অথবা সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিন "No More Tickling"
অথবা আমরা আন্দোলনেও নামতে পারি।
source:
1.
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Tickling
2. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Knismesis_and_gargalesis
3. https://www.livescience.com/33378-ticklish-animals.html
4. https://www.cuteness.com/blog/content/are-animals-ticklish
5. https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/17675169/
6. https://video.nationalgeographic.com/video/news/00000158-4f43-d711-a959-cf6fda130000
7. https://www.newscientist.com/article/2112319-giggling-rats-reveal-the-most-ticklish-part-of-our-brains/
8. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5383284/
9. https://www.healthline.com/health/why-are-people-ticklish
10. https://jamaicahospital.org/newsletter/interesting-facts-about-tickling/
11. https://www.everydayhealth.com/healthy-living-pictures/tickle-me-pink-12-fun-facts-about-tickling.aspx
12. https://culturacolectiva.com/history/tickling-torture-method-can-cause-aneurysm
শাহরিয়ার হোসাইন থেসুন।
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান।