রাজেশ মজুমদার
হলিউডের চলচ্চিত্রে অনেকেই বিশাল এক রেডিও টেলিস্কোপ দেখেছেন। বিশেষ করে জেমস বন্ডের ‘গোল্ডেন আই’ ছবিটিতে এ টেলিস্কোপ বিশেষভাবে দেখানো হয়েছিল। পুয়ের্তো রিকোতে অবস্থিত আইকনিক টেলিস্কোপটি ৫৭ বছর ধরে জ্যোতির্বিদদের মহাকাশের বিভিন্ন গবেষণায় সাহায্য করে যাচ্ছিল। কিন্তু গত মঙ্গলবার ভেঙে পড়েছে বিশাল ওই টেলিস্কোপ।
আরেসিবো টেলিস্কোপটি অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পর্যবেক্ষণাগার ‘আরেসিবো পর্যবেক্ষণাগার’ এ।আরেসিবো পর্যবেক্ষণাগারটি ‘The National Astronomy and Ionosphere Center (NAIC)’ নামেও পরিচিত।এটি ক্যারিবীয়ান দ্বীপের পুয়ের্তো রিকোতে অবস্থিত।যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন (এনএসএফ) এর অধীনে কার্যরত পর্যবেক্ষণাগারটির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট হলোঃ ( www.naic.edu )। পর্যবেক্ষণাগারের বর্তমান পরিচালক হলেন ফ্রান্সিসকো কর্ডোভা। পর্যবেক্ষণাগারটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬৩৪ ফুট উপরে অবস্থিত।পর্যবেক্ষণাগারের প্রধান টেলিস্কোপ ছিল ‘আরসিবো টেলিস্কোপ’; যেটি প্রায় ৩০৫ মিটারের গোলীয় প্রতিফলক ডিশ রেডিও টেলিস্কোপ।পর্যবেক্ষণাগারটিতে আরো একটি ১২ মিটারের রেডিও টেলিস্কোপ, একটি লাইডার ফ্যাসিলিটি এবং একটি ভিজিটর সেন্টার রয়েছে। মূল টেলিস্কোপটি ধ্বংস হওয়ার পরও পর্যবেক্ষণাগারের এই অংশগুলো সচল থাকবে।
পর্যবেক্ষণাগারটিতে রয়েছে ‘এঞ্জেল রামোস ভিজিটর সেন্টার’ যেটি ১৯৯৭ সালে চালু করা হয়েছিল।এই সেন্টারে মূলত পর্যবেক্ষণাগারে অবস্থিত বিভিন্ন টেলিস্কোপের কার্যাবলী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং অন্যান্য বায়ুমন্ডলীয় ঘটনাবলী প্রদর্শন করা হয়।এছাড়াও ক্যারিবিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞান সোসাইটির সহায়তায় সেন্টারটিতে পুরো বছর জুড়ে রাতের আকাশের বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা এবং বহির্জাগতিক গ্রহ সম্পর্কে সিরিজ প্রদর্শন করা হয়।এই সেন্টারটির মূল উদ্দেশ্যহলো সাধারণ জনগণের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা এবং পর্যবেক্ষণাগারের গবেষণা সম্পন্ন করা।
কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
আরেসিবো টেলিস্কোপটির উন্মেষ ছিল ৩০৫ মিটার।টেলিস্কোপের ডিশের উপর একটি ১৫০ মিটারের ট্রান্সমিটার ছিল যেটি মহাকাশে বিভিন্ন সংকেত ছড়িয়ে দিত।১৯৬৩ সালে কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর ৫৩ বছর ধরে এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় সিঙ্গেল অ্যাপারেচার টেলিস্কোপ।২০১৬ সালের জুলাই মাসে চীন তাদের ৫০০ মিটার উন্মেষ বিশিষ্ট ‘FAST’ রেডিও টেলিস্কোপ তৈরি করার পর টেলিস্কোপটি তার প্রথম স্থান হারায়।টেলিস্কোপটির সাহায্যে ১লা নভেম্বর,১৯৬৩ সালে সর্বপ্রথম গবেষণা শুরু হয়।
টেলিস্কোপটি মূলত বেতার জ্যোতির্বিজ্ঞান, বায়ুমণ্ডলীয় ঘটনা এবং রাডার জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত। এছাড়াও এর সাহায্যে বহির্জাগতিক প্রাণেরও খোঁজ করা হতো।এই টেলিস্কোপের সাহায্যে ‘নাসা’ পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থিত বিভিন্ন বস্তু পর্যবেক্ষণ করতো। টেলিস্কোপটির দারুণ ডিজাইনের কারণে এটিকে বিভিন্ন চলচ্চিত্র এবং গেইম তৈরির কাজে ব্যবহৃত হত। ২০০৮ সালে টেলিস্কোপটিকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। গত মঙ্গলবার টেলিস্কোপটি পুরোপুরি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেলেও এর আগে ২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় মারিয়া এবং ২০১৯ সালে ভূমিকম্প দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় টেলিস্কোপটি।
টেলিস্কোপটির গাঠনিক বৈশিষ্ট্য অনেক ভালো ছিল।টেলিস্কোপটির ব্যাস ৩০৫ মিটার হলেও এর গোলীয় ব্যাসার্ধ ছিল ২৬৫ মিটার। টেলিস্কোপের ডিশটির পৃষ্ঠ তৈরি করা হয় ৩৮,৭৭৮ টি এলুমিনিয়াম প্যানেল দ্বারা; যেগুলো স্টিল ক্যাবল দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল।টেলিস্কোপটিতে ছিল তিনটি রাডার ট্রান্সমিটার। যখন সংকেত গ্রহণ এবং প্রেরণের জন্য রিসিভার ও ট্রান্সমিটারটিকে বিভিন্ন দিকে ঘোরানো হত তখন টেলিস্কোপের মূল ডিশটি স্থির থাকতো।
অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করা হয়েছে এই টেলিস্কোপের মাধ্যমে। টেলিস্কোপটির কাজ শুরুর কিছু দিনের মধ্যে;৭ ই এপ্রিল, ১৯৬৪ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই টেলিস্কোপ ব্যবহারের মাধ্যমে জানতে পারেন বুধ গ্রহের ঘূর্ণন পর্যায়কাল ৮৮ দিন নয়,বরং মাত্র ৫৯ দিন। ১৯৬৮ সালে এই টেলিস্কোপের মাধ্যমেই আবিষ্কার করা হয় ‘কাঁকড়া পালসার’ এর পর্যায়কাল(৩৩ মিলিসেকেন্ড); যা নিউট্রন নক্ষত্রের অস্তিত্বকে নিশ্চিত করেছিল। ১৯৭৪ সালে ‘হালস’ এবং ‘টেইলর’ নামে দু'জন বিজ্ঞানী টেলিস্কোপটির মাধ্যমে প্রথম বাইনারি পালসার (PSR B1913+16) আবিষ্কার করে,যার উপর ভিত্তি করে তারা পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।১৯৮২ সালে প্রথম মিলিসেকেন্ড পালসার (PSR B1937+21) আবিষ্কার করা হয়; যেটি সেকেন্ডে ৬৪২ বার ঘূর্ণন সম্পন্ন করে।
১৯৮০ সালে ‘টেলিস্কোপটির মাধ্যমে প্রথম কোনো ধূমকেতুর (Encke) সন্ধান করা হয় রাডার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। ১৯৮৯ সালের আগস্ট মাসে টেলিস্কোপটির মাধ্যমে একটি গ্রহাণু (4769 Castalia) -র ছবি তোলা হয়। এর পরের বছরই টেলিস্কোপটির সাহায্যে পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী Aleksander Wolszczan আরেকটি পালসারকে(PSR B1257+12) ঘিরে তিনটি গ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন। এরাই ছিল প্রথম বহির্জাগতিক গ্রহ! ১৯৯৪ সালে ‘জন হারমন’ নামে এক বিজ্ঞানী এই টেলিস্কোপের সাহায্যে বুধ গ্রহের মেরু অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি করেন। ২০০৮ সালে ‘galaxy Arp 220’এ অবস্থিত মিথানিমাইন এবং হাইড্রোজেন সায়ানাইড এর মেঘ শনাক্ত করা হয়। এছাড়াও বৃহস্পতি এবং সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্র পরীক্ষা করা হয় এই টেলিস্কোপের সাহায্যে। এছাড়াও ১৯৭৪ সালে,বহির্জাগতিক প্রাণীর উদ্দেশ্যে, প্রায় ২৫০০০ আলোকবর্ষ দূরে একটি মেসেজ পাঠানো হয়, যা আরসিবো মেসেজ নামে পরিচিত। এরকম অসংখ্য আবিষ্কার ও গবেষণায় সহযোগিতার মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করে আসছিল টেলিস্কোপটি।
কিন্তু গত মঙ্গলবার এই টেলিস্কোপটির ৯০০ টন যন্ত্রপাতি ৪৫০ ফুট ওপর থেকে রিফ্লেকটর ডিশের ওপর পড়ে যায়। যে অ্যান্টেনা ভেঙে পড়েছে তার ওজন ছিল প্রায় ৫.৪৪ লক্ষ কেজি। এনএসএফ জানিয়েছে, গতকাল স্থানীয় সময় ৭টা ৫৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা ৫ মিনিট) এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে বিশাল ডিশটি ভেঙে গেছে এবং আশপাশের স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে। ওই টেলিস্কোপে এক হাজার ফুট প্রশস্ত রেডিও ডিশ ও ৪৫০ ফুট ওপরে ঝুলন্ত যন্ত্রপাতি ছিল। তিনটি বিশেষ টাওয়ার থেকে তারের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করা ছিল। দুর্ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে।
এর আগে গত আগস্ট মাসে দুটি তার ছিঁড়ে যাওয়ার পর ওই কাঠামোর ক্ষতি হয়েছিল। তখনই কর্মকর্তারা এ অবজারভেটরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। গত মাসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার পর যন্ত্রাংশ ভেঙে পড়ার ঝুঁকির কথাও বলা হয়েছিল। এটি ঠিক করার কোনো পথ ছিল না। এনএসএফের কর্মকর্তারা বলছেন, পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হবে এ রেডিও টেলিস্কোপ। মোট ৮৯ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে টেলিস্কোপটি ভেঙে পড়ে।
টেলিস্কোপটি ভেঙে পড়ার ফলে দেশ তথা পৃথিবীর যে কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল তা সাধারণ মানুষ সেভাবে বুঝতে না পারলেও বিজ্ঞানীরা ভালোই বুঝতে পারছেন। এই দুর্ঘটনার কথা শুনে আবহাওয়াবিদ থেকে শুরু করে বহু বিজ্ঞানীর চোখে জল এসে গেছে। ১৯৬০ সালে এই বিশাল টেলিস্কোপটির কাজ শুরু হয়েছিল, সম্পূর্ণ হতে লেগেছিল ৩ বছরের দীর্ঘ সময়। তারপর থেকে বহুবার মহাজাগতিক বিপদ যেমন এস্টেরয়েড, উল্কার হাত থেকে বাঁচার জন্য আগামী সতর্কতা পাওয়া গেছেই টেলিস্কোপের জন্যই।
সূত্রঃ
১.(https://en.m.wikipedia.org/wiki/Arecibo_Observatory)
২.(https://en.m.wikipedia.org/wiki/Arecibo_Telescope)
৪.(https://www.nature.com/articles/d41586-020-03421-y)
রাজেশ মজুমদার,
ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান